ঘরে বসেই রিটার্ন দাখিল, সুযোগ দিয়েছে ডিজিট্যাক্স
গতানুগতিক পন্থায় ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ এবং সম্পদের হিসাব-নিকাশ করার জন্য আমরা একজন আয়কর আইনজীবীর শরণাপন্ন হই। সংশ্লিষ্ট সব ধরনের তথ্য সরবরাহ করে তার মাধ্যমে রিটার্ন দাখিল করি। অত্যন্ত জটিল ও ভোগান্তির কাজটি খুবই সহজে ঘরে বসে অনলাইনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করতে চালু হয়েছে ‘ডিজিট্যাক্স’ নামের এক ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ)।
এটি নিয়ে এসেছে ‘দেশ ইউনিভার্সেল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ডিজিট্যাক্স প্রতিষ্ঠার পেছনের কারণ, কীভাবে এটি কাজ করে, এর সুবিধা-অসুবিধা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা সৈয়দ আবদুল্লাহ আস-সাঈদ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শফিকুল ইসলাম।
সৈয়দ আবদুল্লাহ আস-সাঈদ
ডিজিট্যাক্স ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের (অ্যাপ) প্রকল্প ও তথ্য-ব্যবস্থাপনা বিষয়ক উপদেষ্টা। ১৯৯৩ সালে বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেডে যোগ দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে ২৭ বছর ধরে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন।
আইটি প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ আস-সাঈদ অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এএনইউ) থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনসহ মার্কেটিংয়ে এমবিএ করেন। অস্ট্রেলিয়ায় অনলাইন ট্যাক্স রিটার্নের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ডিজিট্যাক্স’ নামের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন। দেশ ইউনিভার্সেলের ডিজিট্যাক্স অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ঘরে বসে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলসহ খুব সহজে করা যায় সম্পদের হিসাব-নিকাশ।
ঢাকা পোস্ট : ডিজিট্যাক্স কী এবং কীভাবে এটি কাজ করে?
আবদুল্লাহ আস-সাঈদ : ডিজিট্যাক্স হলো অনলাইনে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আয়কর দেওয়ার একটি মাধ্যম। গতানুগতিক পন্থায় ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণ এবং সম্পদের হিসাব-নিকাশ করার জন্য আমরা একজন আয়কর আইনজীবীর কাছে গিয়ে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করে রিটার্ন দাখিল করি। ডিজিট্যাক্স এসব কাজ খুব সহজে ঘরে বসেই করে দেবে। যারা চাকরি করছেন, ব্যাংকে এফডিআর, গাড়ি-বাড়ি আছে— এমন ব্যক্তিগত শ্রেণির ছোট করদাতাদের জন্য এটি খুবই সুবিধাজনক প্রক্রিয়া। গ্রাহকরা যেকোনো সময় ঘরে বসেই ডিজিট্যাক্স ডটকমে ঢুকে এ সেবা নিতে পারবেন। রিটার্ন ফাইল দাখিলের পাশাপাশি এর মাধ্যমে নেওয়া যাবে আয়কর সংক্রান্ত সব সেবা।
আরও পড়ুন >> তিন মাসে রেকর্ড ৩ লাখ ৩৩ হাজার রিটার্ন দাখিল
ঢাকা পোস্ট : ডিজিট্যাক্সের ধারণা কীভাবে মাথায় এলো এবং কেন উদ্যোগটি আপনি গ্রহণ করলেন?
আবদুল্লাহ আস-সাঈদ : ব্যক্তিগতভাবে আমি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি অটোমেশন (স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা) পদ্ধতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ব্যাংক খাতে যখন অটোমেশন হয় তখন আমি সরাসরি এখানে কাজ করেছি। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে নতুন এ ধারণা মাথায় আসে। কারণ, আমাদের দেশে ট্যাক্স দেওয়া অত্যন্ত ভীতিকর বিষয়। এটি দূর করে ঘরে বসে কীভাবে একজন ব্যক্তি নিজেই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ-সম্পদের হিসাব করে আয়কর দিতে পারেন— এমন ধারণা থেকে ডিজিট্যাক্সের সৃষ্টি।
মানুষ এখন সবকিছু অনলাইনে করতে পারছে। এমনকি ঘরে বসে অফিস সামলানো যাচ্ছে। আমি মনে করি বর্তমান ডিজিটাল যুগে সময়োপযোগী উদ্যোগ এটি। এ ধরনের সেবা জনপ্রিয় করতে পারলে মানুষ ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে ট্যাক্স দেওয়ার জন্য উৎসাহিত হবেন।
ঢাকা পোস্ট : দীর্ঘদিনের গতানুগতিক পদ্ধতি রেখে কেন গ্রাহক ডিজিট্যাক্সে আসবেন?
আবদুল্লাহ আস-সাঈদ : একজন করদাতা, তিনি করের হিসাব-নিকাশ, আইন-কানুন বা নিয়ম-নীতি কিছুই জানেন না। শুধুমাত্র তথ্য দিয়ে খুব সহজেই তিনি ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঘরে বসে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারেন।
গ্রাহককে প্রথমে সাইটে ঢুকতে হবে। এরপর একটা ফরম আসবে। সেখানে কিছু তথ্য চাওয়া হবে। যেসব তথ্য আছে, আর যেগুলো নাই— তা উল্লেখ করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে তাকে কত টাকা ট্যাক্স দিতে হবে।
ডিজিট্যাক্সে ঢুকে আয়কর ফরমে করদাতা টিক মার্ক দেবেন যে আমার স্যালারি এত টাকা। এফডিআর আছে এত টাকার, গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। এসব টিক মার্ক দিয়ে জানিয়ে দিলেই ট্যাক্স ক্যালকুলেশন করে দেবে। আপনাকে নতুন করে ট্যাক্স পলিসি জানতে হবে না। শুধু কী আছে, আর কী নাই— এসব তথ্য দিলেই হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন >> টাকা বৈধ করতে করদাতাদের অনাগ্রহ
গ্রাহকদের সুবিধার্থে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই সফটওয়্যারটি ব্যবহারের সুযোগ আছে।
আইনজীবীদের কাজ সহজ করে দেবে ডিজিট্যাক্স। আমরা নিজেদের একটি ডিজিটাল আইনজীবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করি। আমাদের কাজ আয়কর ডিজিটালি পরিশোধ করা। আমরা আইনজীবীদের জন্য একটি অপশন রেখেছি। তারা তাদের ক্লায়েন্টকে একটি ব্লকের মাধ্যমে একত্রিত করে সুবিধা নিতে পারবেন। অর্থাৎ একজন আইনজীবীর কোন গ্রাহক কত টাকা দিয়েছেন, কে টাকা পরিশোধ করেননি, গ্রাহকের ট্যাক্স ও ফি কত— এসব তথ্য ডিজিট্যাক্সের মাধ্যমে মনিটরিং করা সম্ভব। একই সঙ্গে কোন গ্রাহকের বকেয়া কত, কোন কোন তথ্য বা কাগজপত্র দেননি— তাও জানা যাবে। পাশাপাশি সময় সময় নোটিফিকেশন যাবে। ফলে গ্রাহককে কোন সময় কোন তথ্য জমা দিতে হবে, খুব সহজেই তা জানা যাবে।
ডিজিট্যাক্সে আইনজীবীদের ট্যাক্স ফাইল ম্যানুয়ালি করতে হবে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্যালকুলেশন হয়ে যাবে। আইনজীবীরা পুরো প্রক্রিয়াটি পেপারলেস সিস্টেমে করতে পারবেন। তারা তাদের ক্লায়েন্টের তথ্য বা ডাটা যার যার নামে ছয় বছরের জন্য সেভ করে রাখতে পারবেন। এতে সময় ও শ্রম দুটোই কমবে।
ঢাকা পোস্ট : ডিজিট্যাক্সে গ্রাহকদের তথ্যের সুরক্ষার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে?
আবদুল্লাহ আস-সাঈদ : বর্তমান বিশ্বে প্রত্যেকের জন্য তথ্যের সুরক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি মাথায় রেখে এবং আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুসরণ করে ডিজিট্যাক্স সিস্টেমটি তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী তথ্য সুরক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আইএসও (আন্তর্জাতিক মানক সংস্থা) সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে আমাদের তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা আছে। পৃথিবীর বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে তথ্য সংরক্ষণ করে আমরাও একই পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ করেছি।
আরও পড়ুন >> আয়কর রিটার্ন ছাড়া ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র নয়
গ্রাহকের তথ্য গোপন রাখার বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা যখন ডেটা আপলোড করি তখন এটি হিডেন থাকে। চাইলেও কেউ দেখতে পান না। তাই কেউ জানতে পারবে না আপনার ফাইলে কী আছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বলতে পারি ডিজিট্যাক্স একটি সিকিউর তথ্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জায়গা।
ঢাকা পোস্ট : ভবিষ্যতে ডিজিট্যাক্স নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
আবদুল্লাহ আস-সাঈদ : আমরা স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের সব ট্যাক্স কার্যক্রম ডিজিটালি অর্থাৎ অনলাইন পদ্ধতিতে হবে। মানুষ খুব সহজে অনলাইনে তাদের আয়কর প্রদান করবে। এ লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি।
ঢাকা পোস্ট : সরকারের কাছে আপনারা কোন ধরনের সহযোগিতা আশা করছেন?
আবদুল্লাহ আস-সাঈদ : আমরা এখন গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করে অনলাইনের মাধ্যমে ফাইল বানিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু ওই ফাইল অনলাইনে এনবিআরে (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) সাবমিট করা যাচ্ছে না। ম্যানুয়ালি সশরীরে লোকাল অফিসে গিয়ে জমা দিতে হচ্ছে। সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া ম্যানুয়ালি নয়, অনলাইনে এনবিআরের সার্ভারে ফাইল জমা দেওয়ার সুযোগ। এটি চালু হলে আয়কর রিটার্নের পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইনে সম্পন্ন করা যাবে। এতে গ্রাহকের সময়, শ্রম ও খরচ— তিনটিই বেঁচে যাবে। এনবিআর যদি আমাদের এ কাজে সহযোগিতা করে তাহলে আমরা তাদের সহযোগী হিসেবে রাজস্ব আদায়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারব।
আরও পড়ুন >> ৪০ ধরনের সেবায় রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দেখানো বাধ্যতামূলক
শুধু ডিজিট্যাক্স নয়, যেসব প্রতিষ্ঠান অনলাইনে এ সেবা দিচ্ছে তাদের সবারই চাওয়া সরকারিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। ডিজিট্যাক্স একজন ইনকাম ট্যাক্স প্রফেশনাল দ্বারা সার্টিফাইড। আমাদের প্রসেস ও ক্যালকুলেশন ঠিক আছে কি না, এগুলো দেখে তারা আমাদের সার্টিফাইড করেছে। আমরা চাই রাজস্ব বোর্ড আমাদের ভেরিফাই করুক যে আমাদের প্রক্রিয়াটি ঠিক আছে। যদি তাদের কাছে আমাদের কাজগুলো সঠিক ও নিরাপদ মনে হয় তাহলে স্বীকৃতি দিক।
এনবিআর যদি অনুমোদন দেয় তাহলে আমাদের কাজ করতে সহজ হবে, মানুষও আস্থা পাবে। তারা উৎসাহী হয়ে সহজে ট্যাক্স দেবে এবং সরকারের রাজস্বও বাড়বে।
এসআই/এমএআর/