এলপিজির দামে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, বেশি নেয়া হচ্ছে ২৩০ টাকা পর্যন্ত
সরকার প্রতি মাসে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দিলেও খুচরা পর্যায়ে গ্রাহক থেকে আরও বেশি টাকা নেন ব্যবসায়ীরা। তবে সেই ‘বেশি’র মাত্রাও এখন অনেক বেশি। এ মুহূর্তে এলপিজির খুচরা বাজারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ীরা মানুষের পকেট কাটছেন নিজেদের ইচ্ছেমতো।
রাজধানীর মুগদা এলাকার বাসিন্দা সোলায়মান হোসেন। ভাড়া বাসায় থাকেন। গ্যাস সংযোগ না থাকায় ব্যবহার করেন সিলিন্ডার গ্যাস। রোববার (১৪ আগস্ট) সকালে রান্না করার সময় তার বাসায় গ্যাস শেষ হয়ে যায়। এলপিজির সিলিন্ডার আনতে যান বাসার পাশের দোকানে। দোকানদারকে দাম জিজ্ঞেস করতেই ঘটল বিপত্তি।
সাড়ে ১২ কেজির যে সিলিন্ডার গত মাসের ১৬ তারিখে ১৩৫০ টাকায় নিয়েছেন সেটির দাম আজ চাওয়া হচ্ছে ১৫০০ টাকা। সরকার এ মাসে এলপিজির দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। সে হিসেবে দাম কমার কথা। কিন্তু উল্টো ১৫০ টাকা বেশি চাচ্ছেন বিক্রেতা। এ নিয়ে শুরু হয় বাগবিতণ্ডা-
ক্রেতার বক্তব্য, অন্য সময় খুচরা পর্যায়ে সরকারি রেটের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি নেয়। এবার দেড়শ টাকা বেশি চাচ্ছে, তাও সরকার এ মাসে দাম কমিয়েছে!
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো এলপিজির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সিলিন্ডার প্রতি দাম বাড়ানো হয়েছে ১৫০ থেকে ২৩০ টাকা পর্যন্ত। সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকায়। যদিও সরকার আগস্ট মাসের জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ ১২৭১ টাকা। মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এ খাতে চলছে ‘নৈরাজ্য’। বেসরকারি কোম্পানিগুলো এবং খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা গ্রাহকের কাছ থেকে এলপিজির দাম আদায় করছে ইচ্ছেমতো। বাড়তি মূল্যে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
বিক্রেতার বক্তব্য, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। ডিলাররা সিলিন্ডার প্রতি ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই ১৫০ টাকা বেশি নিতে হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো এলপিজির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সিলিন্ডার প্রতি দাম বাড়ানো হয়েছে ১৫০ থেকে ২৩০ টাকা পর্যন্ত। সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকায়। যদিও সরকার আগস্ট মাসের জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ ১২৭১ টাকা। মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এ খাতে চলছে ‘নৈরাজ্য’। বেসরকারি কোম্পানিগুলো এবং খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা গ্রাহকের কাছ থেকে এলপিজির দাম আদায় করছে ইচ্ছেমতো। বাড়তি মূল্যে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে সরকার। ফলে এলপিজির সিলিন্ডারের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এলপিজির মূল্য নির্ধারণ না করায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে এ খাত। প্রতি মাসে সরকার এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দিলেও দেড়শ থেকে ২০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। ফলে এলপিজি ব্যবহারে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। অতিরিক্ত মুনাফা লুটছে কোম্পানি, ডিলার ও বিক্রেতারা।
বেশি দামে বিক্রির কথা স্বীকার করছে এলপিজি সিলিন্ডারের ডিলার, উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের দাবি, জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বার বার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে বলার পরও তারা দাম সমন্বয় করছে না।
দেশে এলপিজি সরবরাহকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এখন বছরে চাহিদা ১০ লাখ মেট্রিক টনের মতো। আর বিপিসি সরবরাহ করে মাত্র ১৬ হাজার মেট্রিক টন। সরকারি এলপিজি কোম্পানির দুটি কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ১৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এরমধ্যে চট্টগ্রামের এলপিজি কারখানার ১০ হাজার আর কৈলাসটিলা প্ল্যান্টের ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।
অর্থাৎ চাহিদার সিংহভাগই জোগান দেয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বাজারে বিভিন্ন কোম্পানি এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবসা করছে। এর মধ্যে রয়েছে- বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, পেট্রোম্যাক্স, টোটাল, বিএম এলপি গ্যাস, এনার্জিপ্যাকের জি গ্যাস, লাফ্স গ্যাস, ইউরোগ্যাস, ইউনিভার্সাল, যমুনা ও সেনা এলপিজি।
এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এ দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এটি সৌদি কার্গো মূল্য (সিপি) নামে পরিচিত। এ সৌদি সিপিকে ভিত্তিমূল্য ধরে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)।
সর্বশেষ আগস্ট মাসের জন্য যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে ১২ কেজি এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১২১৯ টাকা আর সাড়ে ১২ কেজির দাম ১২৭১ টাকা।
কিন্তু বাজারের চিত্র ভিন্ন। সেখানে ইচ্ছেমতো আদায় করা হচ্ছে এলপিজির দাম। নির্ধারিত দামের চেয়ে ১৫০ থেকে ২৩০ টাকা পর্যন্ত বেশি নিচ্ছেন খুচরা বিক্রেতারা।
বেশি দামে বিক্রির কথা স্বীকার করছে এলপিজি সিলিন্ডারের ডিলার, উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের দাবি, জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। বার বার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে বলার পরও তারা দাম সমন্বয় করছে না।
দেশে এলপিজি সরবরাহকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এখন বছরে চাহিদা ১০ লাখ মেট্রিক টনের মতো। আর বিপিসি সরবরাহ করে মাত্র ১৬ হাজার মেট্রিক টন। সরকারি এলপিজি কোম্পানির দুটি কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ১৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। এরমধ্যে চট্টগ্রামের এলপিজি কারখানার ১০ হাজার আর কৈলাসটিলা প্ল্যান্টের ৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বসুন্ধরা এলপিজির বিপণন বিভাগের প্রধান জাকারিয়া জালাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারে বেশি দামে এলপিজি বিক্রি করার বিষয়টি ঠিক আছে। কয়েকটি কারণে দাম বেড়েছে। এক. জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এটা শুধু এখন বেড়েছে তা নয়। ৬৫ থেকে যখন বাড়ানো হয় তখন আমরা বলেছি দাম সমন্বয় করার জন্য, কিন্তু করেনি। এখন ১১৪ টাকা, এখনও করছে না। ফলে জ্বালানির দাম বাড়ায় ২০ থেকে ২২ টাকা খরচ বেড়েছে।
এছাড়া বিইআরসি দাম সমন্বয় করার সময় এলসির রেট ধরেছে প্রতি ডলার ৯৮ টাকা। কিন্তু এখন আমাদের এলসি সেটেলমেন্ট করতে ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১০৯ টাকা। এসব মূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে দাম বাড়ছে প্রতি সিলিন্ডারে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। লস দিয়ে তো বিক্রি করা যাবে না। তাই দাম বেশি পড়ছে।
দেশের শীর্ষ এলপিজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের এ কর্মকর্তা জানান, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের (লোয়াব) পক্ষ থেকে বিইআরসিকে একাধিকবার এসব বিষয় জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা আমলে নেয়নি। তবে সবশেষ তারা মৌখিকভাবে জানিয়েছে আমাদের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসবে। গত তিন-চার বছর সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে আমাদের সমস্যা হয়নি, এখন কেন সমস্যা হবে? আমরা চাই বাজার পর্যালোচনা করে একটা সঠিক দাম নির্ধারণ করা হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নেওয়ার কোনো এখতিয়ার কোম্পানিগুলোর নেই। এ ধরনের অভিযোগ পাইনি। কেউ যদি কেনার রশিদসহ আমাদের অথবা ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ করে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
তিনি বলেন, দাম সমন্বয়ের বিষয়সহ কিছু দাবি জানিয়ে এলপিজি কোম্পানিগুলো চিঠি দিয়েছে। খুব শিগগিরই তাদের সঙ্গে বসব, বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চাই যে দাম সরকার নির্ধারণ করে দেবে সেই দামেই বিক্রি হবে। সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এটা নিশ্চিত করবে। তা না হলে ভোক্তারা ঠকবেন।
প্রতি মাসের দাম সমন্বয়ের সুবিধা সাধারণ ভোক্তারা পাচ্ছে না উল্লেখ করে ক্যাব সভাপতি বলেন, গ্রাম পর্যায়ে প্রতি মাসে নতুন দামের তথ্য পৌঁছানো এবং তা বাস্তবায়ন করা কঠিন। তাই প্রতি মাসে না করে তিন মাস পরপর দাম সমন্বয় করা যায় কি না ভেবে দেখা উচিত।
এসআই/এআর/জেডএস