মোবাইলে ১ লাখ কোটি টাকার লেনদেনের রেকর্ড
শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্র দ্রুত টাকা পাঠানোর পাশাপাশি কেনাকাটার বিল পরিশোধ, ঋণ সুবিধাসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যোগ হয়েছে নতুন নতুন অনেক সেবা। ফলে মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) ওপর মানুষের আগ্রহের পাশাপাশি বাড়ছে নির্ভরশীলতা। গ্রাহকের সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণও। এখন দৈনিক তিন হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, রকেট, নগদের মতো সেবার মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের মার্চে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ৭৭ হাজার ২২ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। তবে এখানে ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’-এর তথ্য যুক্ত হয়নি। কারণ, সেবাটি এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়।
চলতি বছরের মার্চে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ৭৭ হাজার ২২ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। এখানে ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’-এর তথ্য যুক্ত হয়নি। নগদের হিসাব যোগ করলে লেনদেনের পরিমাণ আরও ২২ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাবে। সেই হিসাবে এমএফএসে লেনদেন দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা
নগদের হিসাব যোগ করলে লেনদেনের পরিমাণ আরও ২২ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যাবে। সেই হিসাবে এমএফএসে লেনদেন দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা; দৈনিক লেনদেন তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহর কিংবা গ্রাম, একমুহূর্তে দেশের যেকোনো স্থানে টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। দিনদিন গ্রাহক সংখ্যা যেমন বাড়ছে, লেনদেনের পরিমাণও বাড়ছে। এছাড়া করোনার সংক্রামণ ঠেকাতে মানুষ নগদ লেনদেনের চেয়ে ক্যাশলেস লেনদেনে বেশি নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। শ্রমিকদের বেতন-বোনাস, সরকারের সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন ভাতা ও অনুদান যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে বিকাশ, রকেট, ইউক্যাশ, মাই ক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ বিভিন্ন নামে ১৩টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। ২০২২ সালের মার্চ শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ ৩০ হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে গ্রামে পাঁচ কোটি ৬৬ লাখ ৭০ হাজার এবং শহরে পাঁচ কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এছাড়া নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ছয় কোটি ৩১ লাখ ৭৫ হাজার এবং মহিলা গ্রাহক চার কোটি ৫৬ লাখ ২৬ হাজার। আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৫১ হাজার ২১৩ জনে।
মার্চে মোট ৩৬ কোটি চার লাখ ৮৪ হাজার ৯৩২টি লেনদেনের মাধ্যমে ৭৭ হাজার ২১ কোটি ৯০ লাখ টাকা স্থানান্তর হয়েছে। আলোচিত মাসজুড়ে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবগুলোতে টাকা জমা পড়েছে (ক্যাশ ইন) ২৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। এ সময়ে তোলা হয়েছে (ক্যাশ আউট) ২০ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা
বিকাশের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন বিকাশের একটি অ্যাকাউন্ট দিয়ে একজন গ্রাহক তার দৈনন্দিন প্রায় সবধরনের লেনদেন অনায়াসে করতে পারছেন। এ সেবার পরিধি আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এ খাতে নিয়মিত উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, সৃজনশীল ও সময়োপযোগী নানা সেবা সংযোজন হচ্ছে। সাধারণের লেনদেন আরও সহজ, নিরাপদ, সময় ও খরচসাশ্রয়ী হচ্ছে।
‘সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিশেষ করে সরকারি সবধরনের ভাতা, উপবৃত্তি ও প্রণোদনা বিতরণে মোবাইল আর্থিক সেবা খাত ব্যবহারের সিদ্ধান্ত এ খাতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়িয়েছে।’
সবমিলিয়ে সমাজের সব স্তরের গ্রাহকের মাঝে এমএফএস লেনদেনের অভ্যস্ততা তৈরি হচ্ছে এবং নির্ভরতাও বাড়ছে। গ্রাহকদের স্বতঃস্ফূর্ত এমএফএস ব্যবহার এবং করোনা-পরবর্তীতে সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরায় মার্চ মাসে সর্বোচ্চ লেনদেনের পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে। আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে— এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম।
এমএফএস মাধ্যমে গেল মার্চে মোট ৩৬ কোটি চার লাখ ৮৪ হাজার ৯৩২টি লেনদেনের মাধ্যমে ৭৭ হাজার ২১ কোটি ৯০ লাখ টাকা স্থানান্তর হয়েছে। আলোচিত মাসজুড়ে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবগুলোতে টাকা জমা পড়েছে (ক্যাশ ইন) ২৩ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। এ সময়ে তোলা হয়েছে (ক্যাশ আউট) ২০ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা।
মার্চে এমএফএস মাধ্যমে ব্যক্তি হিসাব থেকে ব্যক্তি হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে ২২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বিতরণ হয়েছে দুই হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। বিভিন্ন সেবার বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১২৩২ কোটি টাকা। কেনাকাটার বিল পরিশোধ করা হয়েছে দুই হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা
সম্প্রতি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের পরিমাণ বাড়াতে এর সীমা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে এমএফএস মাধ্যমে গ্রাহকরা দিনে এজেন্ট থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক হিসাব বা কার্ড থেকে ৫০ হাজার টাকা জমা করতে পারবেন। আগে দৈনিক ৩০ হাজার টাকার বেশি জমা করা যেত না। কার্ড থেকে টাকা জমার সীমাও নির্দিষ্ট ছিল না। এখন একজন গ্রাহক আরেকজনকে মাসে দুই লাখ টাকা পাঠাতে পারবেন। আগে এ সীমা ছিল ৭৫ হাজার টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বর্তমানে দেশের সামগ্রিক পরিশোধ ব্যবস্থায় এমএফএস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কোভিড-১৯ এর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এমএফএসের আওতা ও লেনদেনের ব্যাপ্তি প্রসারের পাশাপাশি এ মাধ্যম ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আর্থিক সহায়তা প্রদান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে এমএফএস ব্যবহারের প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং ডিজিটাল লেনদেন উৎসাহিত করতে এমএফএসের ব্যক্তি হিসাবের লেনদেনের সীমা বাড়ানো হয়েছে।
মার্চে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা ৭৭ হাজার ২২ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। এখানে ‘নগদ’-এর তথ্য যুক্ত হয়নি। নগদের হিসাব যোগ করলে লেনদেন দাঁড়াবে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা এমএফএস
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে শুধু লেনদেন নয়, যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নানা সেবা। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবার মূল্য পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রেরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মার্চে এমএফএস মাধ্যমে ব্যক্তি হিসাব থেকে ব্যক্তি হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে ২২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বিতরণ হয়েছে দুই হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। বিভিন্ন সেবার বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১২৩২ কোটি টাকা। কেনাকাটার বিল পরিশোধ করা হয়েছে দুই হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা।
২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেসের যাত্রা শুরু হয়। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। বর্তমানে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সিংহভাগই বিকাশের দখলে। এরপর ‘নগদ’-এর অবস্থান।
এসআই/এমএআর/