শ্রীলঙ্কার ‘ভুল’ থেকে শিক্ষা নিতে হবে এখনই
খাবার সংকট, জ্বালানির অভাব, নেই পর্যাপ্ত ওষুধ— এটা যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন নয়, শ্রীলঙ্কার খবর। দুই কোটি জনসংখ্যার দেশটির আর্থিক ও মানবিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিদেশি ঋণের ঘানি টানতে গিয়ে নাগরিকদের সাধারণ সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমেছে তলানিতে। ফলে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির সক্ষমতা হারাচ্ছে দেশটি। চলছে জরুরি অবস্থা। এসব কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। শ্রীলঙ্কার এ পরিণতির জন্য যেসব বিষয় দায়ী, সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে এখান থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের অর্থনীতি অনেক মজবুত, আমরা অত্যন্ত সতর্ক।’ বুধবার (৬ এপ্রিল) জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিরোধীদলীয় উপনেতা যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শ্রীলঙ্কার বিষয়টি নিয়ে, এটা বাস্তব। তবে আমরা সরকার গঠন করার পর থেকে এখন পর্যন্ত উন্নয়নের ক্ষেত্রে যত ঋণ নিয়েছি তা সময়মতো পরিশোধ করছি। বাংলাদেশ একটি দেশ, যে দেশ কোনো দিন ঋণ পরিশোধে ডিফল্টার (খেলাপি) হয়নি, হবেও না। সেদিক থেকে আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত। সেটা আমি বলে রাখতে চাই। আমরা অত্যন্ত সতর্ক।’
এদিন সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের তার বক্তব্যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের প্রসঙ্গ টেনে ‘বাংলাদেশের অবস্থাও শ্রীলঙ্কার মত হতে পারে’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
শ্রীলঙ্কার অবস্থা এখন কেন এমন— এ প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদরা বলেন, ভুল করনীতি, রাজস্ব আসে না এমন বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ, মাত্রাতিরিক্ত বিদেশি ঋণের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এর মধ্যে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক সংকট। সবমিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটননির্ভর সবচেয়ে শিক্ষিত ও অর্থনৈতিক উদীয়মান দেশটি এখন চরম আর্থিক ও মানবিক সংকটে পড়েছে।
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশেরও এমন সংকটে পড়ার কোনো আশঙ্কা আছে কি না— ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের কাছে। তিনি বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার মতো সংকটে পড়ার মতো অবস্থা এখন বাংলাদেশের নেই। ওদের সমস্যা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এখন রাজনৈতিক সমস্যায় পড়েছে দেশটি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় আছে।’
‘তবে, তাদের যে ভুলগুলো ছিল তা থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, সব দেশকেই শিক্ষা নেওয়া উচিত। এক দিনেই তো শ্রীলঙ্কা এ অবস্থায় পড়েনি। তাই আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, শ্রীলঙ্কার প্রথম সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট। এর মূল কারণ, তাদের রাজস্ব কমে গেছে। রাজস্ব-নীতির কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তাদের আয় কমে গেছে, খরচ বেড়েছে। এখন তাদের সঙ্গে তুলনায় বলা যায় আমাদের রাজস্ব আয় কম। তাই এখন থেকেই আমাদের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।
‘শ্রীলঙ্কার আরেকটি সমস্যা হলো- ঋণ ব্যবস্থাপনা। তাদের বৈদেশিক ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ঋণও বেড়েছে। সবমিলিয়ে তাদের ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি ছিল। তারা যে খাতে ঋণের অর্থ ব্যয় করেছে সেই খাত থেকে আশানুরূপ রিটার্ন/আয় আসেনি। ফলে তারা সংকটে পড়েছে। এছাড়া তাদের ফরেন রিজার্ভ কমে গেছে। পরে অর্থনৈতিক সংকট কমাতে নতুন টাকা ছাপিয়েছে। এতে তাদের মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। সেইসব প্রকল্প থেকে যেন আমাদের অর্থনৈতিক সুবিধা আসে, সেই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। একটা প্রকল্প পাঁচ হাজার কোটি টাকা নিয়ে শুরু করলাম, শেষ করতে গিয়ে দেখা গেল ১৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। এমন প্রকল্প থেকে আমরা কী সুবিধা পাব? তাই প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
‘সমস্যা এক দিনে আসে না। এটা আস্তে আস্তে বড় আকার ধারণ করে। তাই সংকট আসার আগে আমাদের সতর্ক হতে হবে’— বলেন এ অর্থনীতিবিদ।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ধসের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের চাপ। দেশটি বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিদেশি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে। ওই ঋণ থেকে আশানুরূপ আয় আসেনি। তবে, বাংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন। বর্তমানে (৩০ জুন, ২০২১) দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বা পরিমাণ চার হাজার ৯৪৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৩ লাখ ধরে হিসাব করলে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ ডলার। যেখানে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ এক হাজার ৬৫০ ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৩৭ শতাংশের মতো বিদেশি উৎসের ঋণ। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের হার জিডিপির ১৩ শতাংশ। সুতরাং, আপাতত চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মন্তব্য, আইএমএফের হিসাবে এ হার ৫৫ শতাংশের বেশি হলেই বিপদ। এছাড়া এখন বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। যেখানে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের ঋণের হার এখন জিডিপির ৩৮ শতাংশ। গত জুন পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশের মতো বিদেশি উৎসের ঋণ। বিদেশি ঋণের হার এখন জিডিপির ১৩ শতাংশ
বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কার বর্তমান ঋণের হার তাদের জিডিপির ১১৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটি সবমিলিয়ে এক বছরে যে পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে, তার তুলনায় ঋণ বেশি। শ্রীলঙ্কার ঋণের ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছে ঋণ ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ, জাপানের কাছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং চীনের কাছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য বলছে, ঋণের দায় পরিশোধ হিসেবে চলতি বছর শ্রীলঙ্কার সবমিলিয়ে ৫০০ কোটি ডলার পরিশোধ করার কথা। অথচ এখন তাদের হাতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে মাত্র ২৩১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, দৈনন্দিন কাজ চালাতেই নতুন করে ঋণ করতে হচ্ছে দেশটির।
আইএমএফের তথ্য বলছে, ঋণের দায় পরিশোধ হিসেবে চলতি বছর শ্রীলঙ্কাকে সবমিলিয়ে ৫০০ কোটি ডলার পরিশোধ করার কথা। অথচ এখন তাদের হাতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে মাত্র ২৩১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, দৈনন্দিন কাজ চালাতেই নতুন করে ঋণ করতে হচ্ছে দেশটির
শ্রীলঙ্কার বর্তমান যে পরিস্থিতি, বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতিতে পড়ার আপাতত কোনো শঙ্কা নেই। তারপরও বেশকিছু বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা আর বাংলাদেশের অবস্থা এক নয়। আমাদের সঙ্গে তাদের অর্থনীতির তুলনা চলে না। আমাদের উৎপাদনে ঘাটতি নেই। ওদের রিজার্ভ অনেক কম। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত শক্ত অবস্থানে আছে। আমাদের রপ্তানি আয় ওদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।’
বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর মার্চে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যেখানে গত জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কা পণ্য রপ্তানি থেকে আয় করেছে মাত্র ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। তবে, রপ্তানির সঙ্গে ব্যাপক হারে আমদানি বাড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘বেশি আমদানির কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতিতেও নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের দেখতে হবে যে আমদানি কোন পর্যায়ে হচ্ছে। আমদানির পণ্য কোন খাতে যাচ্ছে। তা না হলে আমরাও সমস্যায় পড়ব।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। গত ১৫ বছরে দেশটি সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তাসহ মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। রাজধানী কলম্বোর কাছেই সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে ‘কলম্বো পোর্ট সিটি’ নামে আরেকটি শহর তৈরি করা হচ্ছে। শহরটি হংকং, দুবাই ও সিঙ্গাপুরের মতো করা হচ্ছে। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলঙ্কা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি।
এ বিষয়ে সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা অতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে। আবার ঋণের অর্থ যে খাতে ব্যয় করেছে সেখান থেকে তেমন লাভ আসেনি। আমাদেরও অনেক বড় প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এসব বিষয়ে এখনই নজর দিতে হবে। বিশেষ করে প্রকল্পের ব্যয় যেন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে না যায়। যেটা আমাদের এখানে হচ্ছে।’
‘প্রকল্পের ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। প্রকল্পের অর্থ খরচের জবাবদিহি কম। এছাড়া সময়মতো প্রকল্পের কাজও শেষ হয় না। এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে’— বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর।
বর্তমানে দেশে ১০টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এর একটির কাজও সময়মতো শেষ হয়নি। ফলে সময়ের সঙ্গে ব্যয়ও বেড়েছে। এতে এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক মূল্য কমে যাচ্ছে।
বড় প্রকল্পের কারণে এখন বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের দায় বাড়ছে আগের চেয়ে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ডলারে। আগামীতে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে এ ঋণ পরিশোধের দায় অনেক বেড়ে যাবে; চাপও তৈরি হবে।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হয়ে গেলে আগামীতে কম সুদে আর ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। মিলবে না বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধা। নিতে হবে বেশি সুদে ঋণ। এতে দায় পরিশোধও বাড়বে। ফলে এখন থেকেই ঋণের দায় নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি নিজস্ব আয় বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি করনীতি প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি বহুমুখীকরণে জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
এসআই/এসকেডি/এমএআর/