টেকনাফেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৬১ জনকে হত্যা করেছেন প্রদীপ
আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র টেকনাফেই ১৬১ জনকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। মহেশখালীতে দায়িত্ব পালনকালেও তিনি বন্দুকযুদ্ধের নামে অনেক মানুষকে হত্যা করেছেন।
কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফ ও মহেশখালীতে নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, মোটা অংকের চাঁদা না পেয়ে অথবা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ওসি প্রদীপ এসব মানুষকে হত্যা করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা খুবই নির্মম ও চাঞ্চল্যকর। যা মেনে নেওয়ার মতো নয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টেকনাফ ও মহেশখালীতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দুই শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু মৃত্যুর ঘটনা ছিল লোমহর্ষক ও অত্যন্ত নির্মম। বন্দুকযুদ্ধের নামে একই পরিবারের তিন ভাই, দুই ভাই, বাবা-ছেলে, ভায়রা-ভগ্নিপতিকে একসঙ্গে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
এর মধ্যে দুটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বেশ আলোচনায় ছিল। এর একটি হচ্ছে পূর্ববিরোধের জের ধরে আমানুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক (৩৭) ও আজাদুল ইসলাম আজাদ (২৩) নামে দুই ভাইকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে ধরে টেকনাফে এনে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
নিহতদের মধ্যে আজাদুল ইসলাম আজাদ ঘটনার মাত্র ১০ দিন আগে বাহরাইন থেকে দেশে এসেছিলেন। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কারাগারে গেলে দুই বছর পর এ ঘটনায় মামলা দায়ের করে নিহতদের পরিবার।
গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা মামলার এজাহারে নিহতদের ছোট বোন রিনাত সুলতানা শাহীন উল্লেখ করেছিলেন, ছোট ভাই আজাদুল ইসলাম আজাদ পাঁচ বছর বাহরাইনে কর্মরত ছিলেন। পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের জুন বা জুলাই মাসে তিনি বিদেশ থেকে ফেরেন। বড় ভাই আমানুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক (৩৭) দেশে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করতেন। আজাদ দেশে আসার খবর পান টেকনাফ থানার ওসির দায়িত্বে আছেন প্রদীপ কুমার দাশ।
২০১৮ সালের ১৩ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে চন্দনাইশের কাঞ্চননগর রৌশন হাট ফকিরপাড়ার সামনে রাস্তা থেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে এক দল লোক দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। পরে ১৫ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করা হয়। ওই দিন রাত ১টার দিকে তাদের মায়ের কাছে ফোন করে ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এর মধ্যে ১৬ জুলাই সকাল ৭টায় প্রদীপ কুমার দাশ বাদীর মায়ের মোবাইলে কল করে ফারুক ও আজাদের মরদেহ চিহ্নিত করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। পরে পরিবারের লোকজন গিয়ে তাদের মরদেহ নিয়ে আসে। দুই ভাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন বলে জানানো হয়।
স্বজনদের অভিযোগ, চট্টগ্রামে দায়িত্বে থাকাকালে প্রদীপ কুমার দাশের সঙ্গে দুই ভাই ফারুক ও আজাদের মামলা সংক্রান্ত কারণে বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জের ধরে দুই ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
প্রদীপ কুমার দাশের কথিত বন্দুকযুদ্ধের আরেকটি চাঞ্চল্য ঘটনা ইউপি সদস্য উখিয়ার বখতিয়ার উদ্দীনের মৃত্যু। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগে এ ঘটনা ঘটে। এটি ছিল ওসি প্রদীপ কুমার দাশের শেষ ‘বন্দুকযুদ্ধ’। বখতিয়ার উদ্দীনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে টেকনাফে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়েছিল। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তার বাড়ি থেকে ৫১ লাখ টাকা লুট করেছিল ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও উখিয়া থানার তৎকালীন ওসি মর্জিনা আকতার।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নিহত ইউপি সদস্যের ছেলে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দীন বলেন, আমার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তার টার্গেট ছিল বাবাকে হত্যা করে টাকা লুট করা; সেটি তিনি করেছেন।
হেলাল উদ্দীন বলেন, ওসি প্রদীপ একজন দানব। তার হাতে খুন হয়েছে বহু নিরীহ মানুষ। সর্বশেষ আমার বাবা বখতিয়ার উদ্দীন মেম্বারকে ওসি প্রদীপ হত্যা করেন। আমরা বিশ্বাস করি আমার বাবা নির্দোষ ছিলেন। তাই তাকে নির্মমভাবে হত্যার অভিশাপ পড়েছে ওসি প্রদীপের ওপর। তার জ্বলন্ত প্রমাণ মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে আরেক নির্দোষ ব্যক্তি সিনহাকে হত্যা করে ফেঁসে গেছেন প্রদীপসহ ও তার সহযোগীরা।
একইভাবে টেকনাফের তিন সহোদর, দুই সহোদর, বাবা-ছেলে ও ভায়রা-ভগ্নিপতিকে একসঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার সহযোগীরা। স্বামীকে হত্যার পর স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে থানায় আটকে ধর্ষণের ঘটনাও আছে বেশ কয়েকটি। সে সময় প্রদীপ কুমার দাশের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন। মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করার পর আদালত তদন্তভার দেয় র্যাবকে।
র্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা এজাহারভুক্ত নয়জন এবং নতুন করে আরো ছয়জনকে অন্তর্ভুক্ত করে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এরপর ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেন। তারপর ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য দেন। ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন।
সর্বশেষে ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় দুই পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত ৩১ জানুয়াারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।
রায়ে কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক লিয়াকত আলী এবং টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন সাতজন।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত (৩০), সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), কনস্টেবল সাগর দেব, স্থানীয় বাসিন্দা বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)।
খালাসপ্রাপ্ত হলেন- কনস্টেবল সাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী (৪৭), কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০)।
সাইদুল ফরহাদ/আরএআর