ফেনীতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের মামলায় ৫ মাসে গ্রেপ্তার ২৮৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় ফেনী মডেল থানায় ১৯টি মামলা করা হয়েছে। তার মধ্যে আটটি হত্যা মামলা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা ১১টি। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ২৮৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাদের মধ্যে ৬৯ জন এজাহারনামীয় ও সন্দেহভাজন ২১৫ জনকে আটকের পর গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে পাঁচ জন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
রোববার (৫ জানুয়ারি) রাতে ফেনী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্ম সিংহ ত্রিপুরা ঢাকা পোস্টকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অন্যদিকে ঘটনার পাঁচ মাস হয়ে গেলেও গ্রেপ্তার হয়নি ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অস্ত্রধারীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৪ আগস্ট মহিপাল এলাকা থেকে ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে অন্তত ৩৩ জন অস্ত্রধারীকে গুলি করতে দেখা গেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত অস্ত্রধারীদের মধ্যে ফেনী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওসমান গণি ওরফে লিটন ও শর্শদি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সম্রাট গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের দুজনই দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
সূত্র আরও জানায়, আন্দোলনে টমটম চালক জাফর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাজী রহিম উল্লাহ, এমপি নিজাম হাজারীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) ফরিদ মানিক, ফেনী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওসমান গণি লিটন ও ফেনী সদরের ছনুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল হক রিফাতকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে তারা কেউ আদালতে স্বীকারোক্তি দেননি।
আরও পড়ুন
জাফর হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) নাজমুল হাসান তানিম বলেন, এ মামলায় মোট ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে ১৫ জন এজাহারনামীয় ও অন্যরা সন্দিগ্ধ আসামি। এ মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য হাজী রহিম উল্লাহসহ পাঁচজনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে তারা কেউ স্বীকারোক্তি দেননি।
সরোয়ার জাহান মাসুদ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক বেলাল উদ্দিন বলেন, এ মামলায় ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলায় ফেনী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আমির হোসেন বাহারসহ ১২ জনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ ও নাহিদ নামে দুইজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
জাকির হোসেন শাকিব হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক ওলি আহাদ বলেন, এ মামলায় মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সম্রাটের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।
ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এ হত্যা মামলায় এজাহারনামীয় ১০ জন ও সন্দিগ্ধ ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ মামলায় ৮ জনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে শর্শদি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সম্রাট আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
ওয়াকিল আহমেদ শিহাব হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মোতাহের হোসেন বলেন, এ হত্যা মামলায় এজাহারনামীয় ৮ জন ও সন্দিগ্ধ ২৬ জনসহ মোট ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলায় মেজবাহ উদ্দিন মেজু, এনামুল হকসহ ৪ জনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ওসমান গণি লিটন ১৬৪ ধারায় হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, এ হত্যা মামলায় এজাহারনামীয় ৭ জন ও সন্দিগ্ধ ১৬ জনসহ মোট ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৬ জনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ মামলায় গ্রেপ্তার মুরাদ হাসান বাবু আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
ছায়েদুল ইসলাম হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. মোজাম্মেল হক বলেন, এ মামলায় এজাহারনামীয় ৭ জন ও সন্দিগ্ধ ১৬ জনসহ মোট ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মামলায় শর্শদি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সম্রাটের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সেদিন মহিপালে ৫০ গজের মধ্যে ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ ও ছায়েদুল ইসলাম হত্যার ঘটনা ঘটে। এ দুটি হত্যাকাণ্ডে সম্রাটের জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে।
আন্দোলনে আফসার হোসেন হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, এ মামলায় ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপালে ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গুলি করার কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে ফেনী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি জিয়াউদ্দিন বাবলু ও ফেনী সদরের কাজীরবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। অস্ত্রধারীদের বেশিরভাগই বিভিন্ন উপায়ে ইতোমধ্যে দেশত্যাগ করেছেন।
অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে জানতে চাইলে ফেনী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্ম সিংহ ত্রিপুরা বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে অস্ত্রধারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে সম্রাট ও লিটন নামে দুই অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া অস্ত্রধারীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে অনেককে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে মামলার তদন্ত কার্যক্রম অনেকদূর এগিয়েছে।
তারেক চৌধুরী/এসএসএইচ