বরগুনায় ঐতিহ্যবাহী যাত্রা উৎসবে উপচে পড়া ভিড়
বিজয়ের মাসে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রার প্রাণ ফিরয়ে আনতে বরগুনায় চলছে বিভাগীয় যাত্রা উৎসব। জুলাই বিপ্লবের পর স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পূর্বের ন্যায় শিল্পের সব শাখায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে এ যাত্রা উৎসবের আয়োজন করা হয়। প্রতিদিন হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন যাত্রার পরিবেশনা দেখতে ভিড় করছেন নানা বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশুরা। এমন উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে সব অপসংস্কৃতি দূর হবে বলে মনে করছেন শিল্পীরা।
বাংলাদেশ নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের আয়োজনে এ উৎসবটি গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে বরগুনার বিসিক শিল্পনগরীর মাঠে শুরু হয়েছে। প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত। উৎসব চলবে আগামী ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
যদি তুমি ভয় পাও, তবে তুমি শেষ; যদি তুমি রুখে দাঁড়াও, তবেই বাংলাদেশ এই স্লোগানকে সামনে রেখে শুরু হওয়া যাত্রা উৎসবের সাতদিনে শাহী তলোয়ার, নবাব সিরাজ উদদৌলা, দেবী সুলতানা, আঁধারের মুসাফির, আপন দুলাল, গুনাইবিবি, এজিদ বধ জয়নাল উদ্ধার এ সাতটি যাত্রাপালা পরিবেশনা করা হবে।
প্রতিদিন নারী-পুরুষ ও শিশুদের উপস্থিতিতে প্রাণ ফিরেছে হারিয়ে যাওয়া বাংলার বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম এ যাত্রাপালার।
আরও পড়ুন
বাবার সঙ্গে যাত্রা দেখতে এসে শিশু তাসিন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আমার বাবার সঙ্গে যাত্রা দেখতে এসেছি। বড়দের মুখে শুনেছি যাত্রাপালা বাংলার একটি ঐতিহ্য। কিন্তু যাত্রার যে নাট্য পরিবেশনা তা কখনো নিজের চোখে দেখিনি। আজ তাই দেখতে এসেছি আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পারলাম যাত্রাপালা থেকে।
সালমান নামের আরেক তরুণ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনায় যে যাত্রা উৎসব চলছে এটি সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমরা তরুণ প্রজন্ম চাই আমাদের এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে। আগামীতে শিল্পকলা একাডেমিসহ যত সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে তারা যাতে এমন আয়োজন অব্যাহত রাখে সে আহ্বান জানাই।
বেগম নামের ষাটোর্ধ্ব নারী ছোট বেলায় যাত্রা দেখেছেন। প্রায় ৫০ বছর পর যাত্রা উৎসবের নাম শুনে ছুটে এসেছেন দেখতে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ছোট বেলায় অনেক যাত্রা দেখেছি, এরপর আর দেখা হয়নি। এরকম পরিবেশে যদি যাত্রার আয়োজন করা হয় তাহলে পরিবার নিয়ে আমরা সবাই আবারও যাত্রা দেখতে পারব।
কালের বিবর্তন এবং অপসংস্কৃতির কবলে পড়ে ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্পটি এক প্রকার বিলুপ্ত হওয়ার পথে। নতুন করে আবারও শুরু হওয়ায় এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন জানিয়ে সঞ্চিতা বিশ্বাস নামে এক যাত্রা শিল্পী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে পুরোনো দিনের ঐতিহ্যবাহী যাত্রায় আমরা সামাজিকতা ধর্মীয়তা বজায় রেখে সুন্দরভাবে যাত্রা করতাম। আমরা আগের সেই পরিবেশটাই চাই। আমাদের অনেক শিল্পীই আছেন দরিদ্র। অনেকের যাত্রাপালায় অভিনয় করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার আয়োজন যাতে আগের মত থাকে সরকারের কাছে আমরা এ দাবি জানাই।
বরিশাল থেকে আসা আশীর্বাদ হাওলাদার নামে আরেক যাত্রা শিল্পী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবহমান বাংলার চিরাচরিত পুরোনো সংস্কৃতিই হচ্ছে যাত্রাপালা। কালের বিবর্তনে আমাদের সমাজ থেকে যাত্রাপালা হারিয়ে গেছে। যদি শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার কাজ করে, তাহলে এ যাত্রা শিল্পকে আবারও এগিয়ে নেয়া যায়। এবং সুস্থ ধারার যাত্রার সংস্কৃতি ফিরে আসতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বরগুনা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার তানজিলা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যাত্রাপালায় অশ্লীল গান নৃত্য প্রবেশ করানোর ফলে সুস্থ ধারার যাত্রাপালা ধিরে ধিরে হারাতে বসেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যাত্রা শিল্পের দায়িত্ব নিয়ে লাইসেন্স দিয়েছে এ শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। গ্রাম বাংলার লোক ঐতিহ্য এ যাত্রা হচ্ছে নাটকের একটি নাইট্টিক রূপ। যাত্রার যে উচ্চবাইচ্চ সুর এই সুরেই মানুষ গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ছড়িয়ে যায়। এ লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যাতে পুনরায় যাত্রাপালায় দর্শক ফিরে আসেন। আমাদের এমন আয়োজন ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
পরবর্তীতে লোকনাট্য উৎসব এবং জেলা পর্যায়েও যাত্রাপালার আয়োজন করা হবে বলেও জানান তিনি।
আব্দুল আলীম/এআইএস