বাসস্ট্যান্ড দখলে নিয়ে বিএনপি নেতার চাঁদাবাজি
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রেজাউল কাইয়ুমের বিরুদ্ধে শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ড দখলে নিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন অজুহাতে তোলা অর্থের নির্দিষ্ট একটি অঙ্ক নেন এই বিএনপি নেতা। গত তিন মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করেছেন তিনি। সরকার পতনের পর দখলে নিয়েছেন বাসস্ট্যান্ডের ৫টি পরিবহনের মালিকানাও। শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ড সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কুমিল্লা নগরীর শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ড দখলে নেন বিএনপি নেতা রেজাউল কাইয়ুম। এর আগে এই বাসস্ট্যান্ড দখল করে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত ছিলেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদের অপসারিত ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ নিয়াজ পাভেল।
সূত্রটি জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিনই বিএনপি নেতা রেজাউল কাইয়ুম তার অনুসারীদের নিয়ে শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডটি দখলে নেন। শাসনগাছা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছেড়ে যাওয়া ১২টি বাস কাউন্টার থেকে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
সূত্রটি বলছে, শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ড থেকে কুমিল্লা-সিলেট রুটে কুমিল্লা ট্রান্সপোর্ট নামে ২৬টি বাস চলাচল করে প্রতিদিন। এসব বাস থেকে গাড়ি প্রতি ১১০০ টাকা করে আদায় করে মালিক সমিতি। এর মধ্যে গাড়ি প্রতি ১২০ টাকা দেওয়া হয় শ্রমিক ইউনিয়নকে। শ্রমিক ইউনিয়নের কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পৌঁছায় তার অর্ধেক। বাকি অর্ধেক অর্থাৎ ৬০ টাকা শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত শ্রমিক ইউনিয়ন শাখা অফিসে পৌঁছানোর কথা থাকলেও সরকার পতনের পর থেকে সেখানে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কোনো শাখা বা কমিটি নেই। গাড়ি প্রতি সেই ৬০ টাকার পুরোটা চলে যাচ্ছে রেজাউল কাইয়ুমের পকেটে। কুমিল্লা ট্রান্সপোর্টের ২৬টি বাস থেকে প্রতিদিন ১৫৬০ টাকা চাঁদা পান তিনি। এছাড়া পাপিয়া ট্রান্সপোর্টের ৫২টি গাড়ি চলে প্রতিদিন। এ পরিবহন থেকে ৬০ টাকা করে মোট ৩ হাজার ১২০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়।
বাকি বাসগুলোর মধ্যে ২০টি রয়েল কোচ, ২০টি জনতা, ৩৫টি সততা, ৩৫টি একতা, ২৬টি লাব্বাইক, ৩৫টি সুগন্ধা, ৪০টি এশিয়া, ৩৫টি ফারহানা, ৩৫টি ফারজানা-১ এবং ২০টি ফারাজানা-২ বাস যাতায়াত করে শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ড থেকে। সবগুলো থেকেই চাাঁদা আদায় করা হয়।
সূত্রটি জানিয়েছে, ১২টি পরিবহন প্রতিষ্ঠানের মোট ৩৮৫টি বাস চলাচল করে দৈনিক। এসব বাস থেকে শুধু পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নামেই দৈনিক ২৩ হাজার ১০০ টাকা চাঁদাবাজি করেন বিএনপি নেতা রেজাউল।
সূত্র বলছে, শ্রমিক ইউনিয়নের বাইরেও জেলা বাস মালিক সমিতির নামে বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিদিন প্রায় ৪ লাখ টাকার মতো আদায় হয়। বাস মালিক সমিতির শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় সেসব নেতাদের কোণঠাসা করে আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক টাকা বিএনপি নেতা রেজাউল কাইয়ুমের পকেটে ঢোকে।
সূত্রটি বলছে, ১২টি পরিবহন থেকে এসব টাকা আদায়ের জন্য তিনজন লোক নিয়োজিত রয়েছেন। তারা হলেন- সামছু, খোকন এবং হাসেম। এই তিনজন প্রতিদিন ১২টি কাউন্টারে গিয়ে হিসাব করে এসব টাকা আদায় করেন। একেকজন ৪টি করে কাউন্টার থেকে অর্থ আদায় করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডের যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে বাসস্ট্যান্ডের পক্ষ থেকে ৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ জন সকালে এবং ৪ জন বিকেলের শিফটে কাজ করেন দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি ভিত্তিতে। বাসস্ট্যান্ডের দিক-নির্দেশনা দেওয়া মাইকম্যানকে বাস প্রতি ২ টাকা হারে দিতে হয়। মাইকম্যান ৭৭০ টাকার মতো পান দিনে। শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডে ৫ জন কেরানি নিয়োজিত রয়েছেন। তাদেরকে দৈনিক ৬০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এসব বাদে বাসস্ট্যান্ডের ইজারার অর্থ আদায় করা হয় পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। ইজারার অর্থ তোলার জন্য আলাদা লোক রাখা হয়েছে।
সূত্রটি বলছে, লাইনম্যান, মাইকম্যান, ইজারার অর্থ আদয়াকারী, কেরানিসহ নিয়োজিত সকল শ্রমিকের জন্য আলাদাভাবে অর্থ আদায় করা হয় বাসগুলো থেকে। যে অর্থ শ্রমিকদের নামে তোলা হয় তার একটি নামমাত্র অংশ দেওয়া হয় তাদের। বাকি অর্থ চলে যায় স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণে নেওয়া রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে।
সূত্র জানিয়েছে, শাসনগাছা বাস টার্মিনাল থেকে চলা ফারজানা-১, ফারজানা-২ এবং ফারহানা পরিবহনের বাস তিনটি আওয়ামী লীগ নেতা আহমেদ নিয়াজ পাভেলের দখলে ছিল। গত ৫ আগস্টের পর পাভেল আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর সেগুলো দখল করে পরিবহন তিনটির পুরো টাকাই হাতিয়ে নিচ্ছেন বিএনপি নেতা রেজাউল। এছাড়াও শাসনগাছা থেকে চলা রয়েল কোচ, জনতা এবং লাব্বাইকসহ মোট ৫টি পরিবহনের দখল এখন এই বিএনপি নেতা। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এসব বাস চালু করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাসস্ট্যান্ডের এক কাউন্টার ম্যানেজার ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধুমাত্র চেহারা বদলেছে, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। স্ট্যান্টবাজি, চাঁদাবাজি চলছেই, দেখার কেউ নেই।
নাম গোপন রাখার শর্তে এক পরিবহন শ্রমিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের একটা শ্রমিক ইউনিয়নের শাখা ছিল। সরকার পতনের পর অফিসটা ভাঙচুর করা হয়েছে। এখন আর কোনো কমিটি নেই। কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের নাম করে অর্থ আদায় করা হচ্ছে, আমরা সেগুলো পাচ্ছি না। আমাদের নাম ভাঙিয়ে তোলা টাকা কার পকেটে যাচ্ছে, তা জানলেও আমরা নাম বলতে পারব না।
আরও পড়ুন
পরিবহন মালিক সমিতি কুমিল্লার সভাপতি অধ্যক্ষ কবির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবহন খাতে কোনো নীতিমালা না থাকায় চাঁদাবাজিটা একটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। আমরা বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে এসব চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানিয়ে এলেও কোনো প্রতিকার মেলেনি।
তিনি আরও বলেন, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিএনপি নেতা রেজাউল কাইয়ুমের কিছু কথা আমাদের কানে এসেছিল। পরে আমরা বসে সেসব সমাধান করেছি। এখন তিনি এসব কাজে জড়িত আছেন কি না আমি জানি না।
কুমিল্লা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা শ্রমিকদের নাম করে বাসগুলো থেকে চাঁদা তুলে তা শ্রমিকদের না দিয়ে নিজেরাই আত্মসাৎ করেছেন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আমরা নতুন করে সংগঠনটির দায়িত্ব নিয়েছি। আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় অফিসে শ্রমিকদের জন্য বাস প্রতি ৫০ টাকা করে দেওয়া হয়। আমরা সেসব টাকা পরিবহনে নিয়োজিত শ্রমিকদের পেছনে ব্যয় করছি।
অভিযুক্ত কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রেজাউল কাইয়ুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে এগুলো সঠিক নয়। আমার সেখানে কোনো বাস নেই, কিছু নেই। আপনি ট্রান্সপোর্ট মালিকদের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এদেশে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে দেশকে দখল ও চাঁদাবাজমুক্ত করতে। এত রক্ত ঝরেছে, এসব ব্যর্থ হবে যদি অভিযোগ সত্যি হয়। মাসখানেক আগে রেজাউলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আমার কাছে এসেছিল। আমি তাকে এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সে সবকিছু অস্বীকার করেছে। তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলো সত্য হয়ে থাকলে আমরা দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেব।
আরিফ আজগর/আরএআর