ইলিশের দামে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব
মেঘনার উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। এখানে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীতে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। একসময় মেঘনায় প্রচুর ইলিশ পাওয়া গেলেও বর্তমানে নাব্যতা সংকটের কারণে তা কমে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশ গভীর পানির মাছ। মেঘনায় চর জাগায় এখন নদীতে তেমন ইলিশ পাওয়া যায় না। এর মধ্যে চাল-ডাল ও তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নদীতে গিয়ে জেলেদেরও পোষাচ্ছে না। অল্প সংখ্যক ইলিশ পেয়ে প্রতিদিনই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে তাদের।
জেলে ও আড়তদারদের দাবি, এখন আর নদীতে গিয়ে জেলেদের পোষায় না। আগে যেখানে এক টানে জালে কয়েক শ কেজি ইলিশ মিলত এখন সেখানে ১০-১৫ কেজিও মেলে না। নৌকা, তেল ও জেলে মিলিয়ে এক চালানে যে খরচ, সেই খরচও ওঠে না। এর বাইরে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এখন ঊর্ধ্বগতি। ফলে নদীতে নামতে সাহস দেখাচ্ছেন না স্থানীয় জেলেরা।
আরও পড়ুন
যারা নামছেন, তাদের বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে থাকতে বাড়তি দাম নেওয়া ছাড়া তাদের কোনো উপায়ও নেই বলে জানান তারা।
জেলে ও আড়তদারদের দাবি, এখন আর নদীতে গিয়ে জেলেদের পোষায় না। আগে যেখানে এক টানে জালে কয়েক শ কেজি ইলিশ মিলত এখন সেখানে ১০-১৫ কেজিও মেলে না। নৌকা, তেল ও জেলে মিলিয়ে এক চালানে যে খরচ, সেই খরচও ওঠে না। এর বাইরে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এখন ঊর্ধ্বগতি। ফলে নদীতে নামতে সাহস দেখাচ্ছেন না স্থানীয় জেলেরা
কমলনগর উপজেলার চরকালকিনি ইউনিয়নের বাতিরখাল মাছঘাটের আড়তদার আবদুল বাকের বলেন, ‘তেলের দামের লগে, জাইল্লার লগে পোষে না, এজন্য জাইল্লা গাঙে যায় না। তেলের দাম না কমলে, জাইল্লারা গাঙে কম যাবে। এতে আড়তদারও মরা, জাইল্লাও মরা। গতবার যে মাছ পাওয়া গেছে এবার তার ১২ আনির ৪ আনিই নাই। খরচ হিসেবে মাছের দাম আরও বেশি হওয়া দরকার।’
ইলিশের পাইকার সোহাগ হোসেন বলেন, ‘মাছ আহরণ বেশি হলে দাম কমে। আর আহরণ কম হলে দাম বাড়ে। ফেসবুকে মাছের দাম কমলেও বাস্তবে কমেনি। মাছ আহরণের ওপর দাম ওঠা-নামা করে।’
আরও পড়ুন
হারুন নামের এক মাঝি বলেন, ‘মাছের দাম কম-বেশি জানতে হলে আগে কারণ খুঁজতে হবে। প্রথমে বলতে হবে তেলের দাম বাড়তি কেন? ১০ কেজি (লিটার) তেল খরচ করে নদীতে নেমে জেলেরা যদি দুই-এক কেজি মাছ পায়, তাহলে দাম কেন বাড়বে না? একটা নৌকায় ৬-৭ জন লোক মাছ শিকারে সাগরে যায়। সবারই পরিবার আছে। সবাইকে উপার্জন করে ঘরে ফিরতে হয়। যদি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম না কমে, তাহলে মাছের দাম কমবে না। সরকার যদি সবসময় জেলেদের সহযোগিতা করে তাহলে ইলিশের দাম কমবে। জেলেরাও উপকৃত হবে।’
রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের চান্দারখাল মাছঘাটের জেলে মো. সেলিম বলেন, ইলিশের দাম বাড়তির সঙ্গে তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি যুক্ত। সামনে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান (১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত)। অভিযানকে কেন্দ্র করে অনেকেই বেশি বেশি মাছ কিনে ফ্রিজিং ও লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করছেন। এ কারণেই মাছের দাম বেশি পড়ছে।
কমলনগর উপজেলার বাতিরখাল মাছঘাটে মাছ কিনতে আসা কয়েকজন ক্রেতা জানান, তারা প্রায়ই বাতিরখাল ও মতিরহাট ঘাট থেকে মাছ কেনেন। মৌসুম হলেও ঘাটে এখন আগের মতো ইলিশ দেখা যায় না।
ইলিশের দাম নিয়ে কথা হয় লক্ষ্মীপুর পৌর মাছবাজারের ব্যবসায়ী মো. হারুনুর রশিদ, আবুল বাশার, মো. পারভেজ ও রাকিবুল হাসানের সঙ্গে। তারা জানান, ইলিশের আহরণের তুলনায় চাহিদা বেশি। ফলে দামও বেশি। এ ছাড়া মেঘনার ইলিশের স্বাদ অতুলনীয়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এখানে এসে ইলিশ নিয়ে যান। হাটবাজারেও ইলিশ কম ওঠে। অথচ ক্রেতা থাকে বেশি। আবার ঘাট থেকে তাদেরও বেশি দামে কিনে আনতে হয়।
ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ বলেন, এক কেজি ওজনের ইলিশ ১৮০০ টাকা, ৬০০-৭০০ গ্রামের ইলিশ ১৫০০ টাকা, ৫-৬টা মিলিয়ে এক কেজি ইলিশ ৬০০ টাকা এবং ৩-৪টা মিলিয়ে এক কেজি ইলিশ ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বাড়তির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘মাছ কম কিন্তু চাহিদা বেশি। ঘাটে আমাদের শ্রমিক খরচ ও যাতায়াত খরচ হিসেব করেই মাছ বিক্রি করতে হয়।’
ব্যবসায়ী আবুল বাশার বলেন, মেঘনা নদীর ইলিশের স্বাদ বেশি। এ ছাড়া এবার উৎপাদনও কম। ফলে দাম একটু বেশি।
ব্যবসায়ী মো. পারভেজ বলেন, সামনে নদীতে মাছ শিকার বন্ধ। এজন্য খাওয়ার মাছ কিনতে ক্রেতারা ঘাটে চলে যান। তাদের কারণেই ঘাট থেকে মাছ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আমাদের কাছে যে মাছ ৬০০ টাকায় তারা পেত, সেই মাছ ঘাট থেকে তারা ৯০০ টাকায় কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ ক্রেতাদের দাবি, ঘাটে গেলে তারা তাজা মাছ কম দামে কিনতে পারেন।
ব্যবসায়ী রাকিবুল হাসান বলেন, বাজারের তুলনায় ঘাটে মাছের দাম বেশি। ক্রেতারা দাম জিজ্ঞেস করে চলে যায়। এ ছাড়া আমাদের এখানকার বড় মাছগুলো অন্য জেলায় চলে যায়। এখানে ছোট সাইজের ইলিশের চাহিদা বেশি। আহরণ কম হওয়ায় দামও বেশি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে মা ইলিশ সংরক্ষণে অভিযান শুরু হবে। এ সময় রামগতির আলেকজান্ডার থেকে চাঁদপুরের ষাটনল পর্যন্ত মেঘনা নদীতে সব ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, সর্বোচ্চ দুই বছরের জেলসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন জেলার ৩৯ হাজার ৭৫০ জেলে পরিবারের মাঝে ৯৯৩.৭৫০ টন ভিজিএফ চাল বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে সদরে তিন হাজার ৭৫০ জনকে ১৪৩.৭৫ টন, রামগতিতে ১৭ হাজার জেলেকে ৪২৫ টন, কমলনগরে ১১ হাজার ২০০ জনকে ২৮০ টন ও রায়পুরে পাঁচ হাজার ৮০০ জেলেকে ১৪৫ টন চাল দেওয়া হবে। যদিও লক্ষ্মীপুরে ৫৪ হাজার ৬০ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। এর মধ্যে সদরে সাত হাজার ৭২৯ জন, রামগতিতে ২৫ হাজার ৯১ জন, কমলনগরে ১২ হাজার ৯৩৮ জন এবং রায়পুরে আছেন সাত হাজার ৬৯৮ জন জেলে।
কমলনগর উপজেলার মেঘনা পাড়ের বাসিন্দা সানা উল্লাহ সানু বলেন, ইলিশ গভীর জলের মাছ। এবার নদীতে ইলিশ না পাওয়ার প্রধান কারণ হলো নাব্যতা সংকট। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার রাসায়নিক পদার্থ নদীর পানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। গত ১০ বছরে নদীতে নৌযান চলাচল বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনও নদীতে ইলিশ কম পাওয়ার অন্যতম কারণ।
ইলিশের দাম কেন বেশি— জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, এবার ইলিশের আহরণ কম কিন্তু চাহিদা বেশি। এজন্য দামও বেশি। প্রতি বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে পর্যাপ্ত ইলিশ ধরা পড়ে। এবার ধরা পড়েছে কম।
‘প্রত্যেকটি নৌকায় মাঝিসহ ৪-৫ জন লোক কাজ করেন। এতে তাদের খাবার ও নৌকার তেল খরচ বেশি পড়ে। কিন্তু খরচ অনুযায়ী মাছ তেমন ধরা পড়ছে না। এ কারণেই দাম বেশি পড়ছে।’ জেলায় বছরে প্রায় ২৫ হাজার টন ইলিশ আহরণ হয়। এবার এখনও আহরণের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়নি— জানান এই কর্মকর্তা।
ইলিশের দাম বাড়ার পেছনে ‘নৌকার তেল খরচের’ বিষয়টি আসলেও লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের জনতা ফিলিং স্টেশনের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক রফিকুল উল্যাহ বলেন, বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেল ১০৫ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। জুলাই মাসে যা ছিল ১০৬ টাকা ৭৫ পয়সা। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি কমেছে ১ টাকা ২৫ পয়সা। জ্বালানি তেল নয়, উৎপাদন স্বল্পতার পাশাপাশি চাহিদা বেশি হওয়ায় এবার ইলিশের দাম বাড়তি— মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসকেডি