ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাতে ২১ বছর ধরে সংগ্রাম করছেন মা মরিয়ম
গাইবান্ধায় জীবন যুদ্ধে হার না মানা সংগ্রামী এক মায়ের নাম মরিয়ম। ৪১ বছর বয়সী বিধবা এই নারী একমাত্র সন্তানের জন্য জীবন যুদ্ধে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে সংগ্রাম করে চলেছেন একাকী। আড়াই বছর বয়সে বাবাহারা হয় মিজান। সেদিনের ছোট্ট শিশু মিজান আজ সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কুড়িগ্রামের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। মায়ের স্বপ্ন ছেলেকে অনেক বড় মানুষ বানাবেন, দুঃখ ঘুচবে তার।
সংগ্রামী এই নারীর পুরো নাম মরিয়ম বেগম। মাত্র ১৪ বছর বয়সে একই উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের পশ্চিম হরিপুর গ্রামের মৃত সমেশ উদ্দিনের ছেলে নুরুজ্জামানের সঙ্গে বিয়ে হয় মরিয়মের। বিয়ের দেড় বছরে ঘরে আসে এক পুত্র সন্তান। যার নাম রাখা হয় মনোয়ার হোসেন মিজান।
২০০৩ সালে ১৭ অগ্রহায়ণ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বামীর মৃত্যু হয়। ছোট্ট শিশু সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিজের শখ বিসর্জন দিয়ে জীবন যুদ্ধ শুরু করেন। হাজারো সুযোগ আসলেও কেবল একমাত্র সন্তান মিজানের মুখের দিকে তাকিয়ে নতুন জীবন শুরু করেননি।
মরিয়ম বেগমের স্বপ্ন ছেলেকে মানুষ করবেন। ছেলে বড় হয়ে তার দুঃখ ঘোচাবে। তাই জীবন সংগ্রামে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন বাইরে। গাইবান্ধার একটি ক্লিনিকে ৩ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়ে ২০১৪ সালে ছেলেকে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত কল্পলতা স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। এর মাঝেই গাইবান্ধার একটি প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজে আয়া পদে ৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পান মরিয়ম। তখন সন্তানের পড়ালেখার খরচের নিয়ে খানিকটা চিন্তামুক্ত হন তিনি। পরে মিজান একই প্রতিষ্ঠান থেকে জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পাস করে গাইবান্ধার সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি, একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২১ সালে এইচএসসি পাস করে মিজান। পরে ২০২৩ সালে মেধা তালিকায় কুড়িগ্রাম সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে সিভিল ইঞ্জানিয়ারিং বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায়। সেদিন মা মরিয়ম সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিলেন।
মরিয়ম বলেন, জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। ছোট্ট ছেলেটাকে জমির আইলে বসিয়ে রেখে ধানের বেছন (চারা) তুলেছি। ধান কেটেছি, মাড়াই করেছি। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়েছে, ভাত পায়নি। এসময় হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ওকে ভালো স্কুলে পড়াতে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে যেয়ে ক্লিনিকে আয়ার চাকরি করেছি। এখনও কষ্ট করছি। এখন এসকেএস এনজিওর স্কুলে ৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছি। চাকরির বয়স সাত বছর হয়ে গেল। এই টাকায় অন্য কিছুই করতে পারি না। সবই ছেলেটার পেছনে খরচ হয়। আমার পুজিতো ছেলেটাই। আমার সব স্বপ্ন ওকে নিয়েই।
ছেলে মিজানের ভাবনাও ঠিক মা মরিয়মের মতোই। জানতে চাইলে মিজান বলেন, প্রত্যেকটি পরিবারে রোজগার করে বাবারা কিন্তু আমার ক্ষেত্রে পুরাই ছিল ভিন্ন। ছোটবেলায় বাবা মারা যায় তখন থেকে মা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আমার মুখে ভাত তুলে দেয়। মা আমাকে কখনো বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। মা আমার আগামী দিনের পথ চলার আলোকবর্তিকা। আমি বিশ্বাস করি আমি একদিন অনেক বড় হব, চাকরি করব। মায়ের সকল দুঃখ মুছে যাবে। মায়ের স্বপ্নইতো আমার স্বপ্ন। আল্লাহ যেন আমার মাকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখেন।
বোয়ালি ইউনিয়নের মাসুম বিল্লাহ নামে একজন জানান, স্বামীহারা মরিয়ম আপা একজন অদম্য নারী। তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। গ্রাম থেকে শহরে হেঁটে গিয়ে ক্লিনিকে আয়ার চাকরি করে ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন। এখনো তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনে চাকরি করে ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। তার স্বপ্ন ছেলেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
বোয়ালী ইউনিয়ন পরিষদের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কামাল হোসেন বলেন, অল্প বয়সে বিধবা হয়ে বাচ্চাটাকে মানুষ করতে ওই নারী অনেক সংগ্রাম করেছেন, আজও করছেন। তার এই সংগ্রাম দেশে উদাহরণ হতে পারে। আমি তাকে একজন সংগ্রামী মা হিসেবে স্যালুট জানাই।
রিপন আকন্দ/আরকে