‘আমার আর চাওয়ার কিছু নাই, নাতিরে ফেরত চাই’
‘আমার নাতি আমার জন্য প্রতিবার জাহাজ থিকা আসার সময় আঙ্গুর, মাল্টা আনতো। আট-নয় মাস পর পর বাড়িতে আসতো। আইসাই আমারে খুঁজতো। আমার আর চাওয়ার কিছু নাই। আমি আমার সেই নাতিরে ফেরত চাই। সরকারের কাছে ফেরত চাই।’
কথাগুলো বলছিলেন ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর থার্ড ইঞ্জিনিয়ার ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ছকরিকান্দি গ্রামের তারেকুল ইসলামের দাদী কুলসুম বেগম (৮৫)। বয়সের ভারে তিনি অনেকটা এলোমেলো। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি খবর পেয়েছেন তার আদরের নাতিকে ডাকাতে ধরেছে। এরপর থেকে এলোমেলো কথা বলছেন। একটু পর পর কানে মুঠোফোন ধরে কাউকে কল না করেই বলছেন হাসান (তারেকুলের বড় ভাই) তারেকুলরে বাড়ি নিয়া আয়।
তারেকুল ইসলাম রায়পুর ইউনিয়নের ছকরিকান্দি গ্রামের মো. দোলোয়ার হোসেন (৬৪) ও হাসিনা বেগমের (৬২) দম্পতির ছোট ছেলে। তারেকুলরা তিন ভাইবোন। সবার ছোট তারেকুল। বড় বোন দুলিয়া সুলতানার (৪১) বিয়ে হয়েছে পাশের বোয়ালমারী উপজেলার একটি গ্রামে, বড় ভাই মো. হাসান ইসলাম (৩৬) ঢাকায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। তারেকুল বিয়ে করেছেন ২০১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর নাটোরের গুরুদাসপুর এলাকায়। তার স্ত্রীর নাম নুসরাত জাহান (২১)। তাদের তানজিহা ইসলাম নামে এক বছর বয়সী মেয়ে রয়েছে।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাড়ির পাশের ছকরিকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে ২০০৪ সালে ঢাকার মিরপুর-১২ এলাকায় ডক্টর শহীদুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন তারেকুল। তার বাবা তখন ঢাকার একটি গার্মেন্টসের কর্মকর্তা। সেই সুবাদে পরিবারের সবার বসবাস ঢাকাতেই। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৯ ও ২০১১ সালে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে। সেখান থেকে ১৭ লাখ টাকা খরচ করে পড়াশোনা শেষ করে ২০১৭ সালে চাকরি নেন চায়না কোম্পানির একটি জাহাজে। এরপর আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ঘুরে গত বছরের ১ ডিসেম্বর চাকরি নেন এসআর শিপিং লিমিটেডের এই জাহাজে।
তারেকুলের গ্রামের বাড়ি মধুখালী উপজেলার মাঝকান্দি মোড় পার হয়ে আনুমানিক এক কিলোমিটার দূরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পশ্চিম পাশে। সেখানে এক তলা বিশিষ্ট একটি ভবন রয়েছে।
বুধবার (১৩ মার্চ) বিকেল ৪টার দিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, বাড়িতে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। ঘরের মধ্যে দাদি, মা এবং বাবা ছাড়া কেউ নেই। স্ত্রী নুসরাত মেয়েকে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে আছেন।
তারেকুলের দাদি কুলসুম বেগম বলেন, গত কোরবানির ঈদে আমার দাদুভাই বাড়িতে আইছিল। ওর মেয়ের প্রথম জন্মদিনে আমাগো সবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা কইলো। কথা কইলেই আমারে জিগাইতো দাদি তোমার জন্য কী আনব। আমার সভ্য শান্ত নাতিডারে কোন ডাকাতে ধরল। আমি আমার নাতিরে ফেরত চাই।
আরও পড়ুন
তারেকুলের বাবা মো. দোলোয়ার হোসেন বলেন, গতকাল বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা ৩১ মিনিটে ওর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে আমার নম্বরে হঠাৎ করে তিনটা মেসেজ আসে। সাধারণত ও আমাকে মেসেজ দিত না। সব সময় কলই দিত। গতকাল মেসেজে ও লিখেছে, ‘আব্বু মাফ কইরেন আমাকে, দোয়া করেন আমাদের জন্য।’ এই মেসেজ দেখার পর আমি হকচকিয়ে উঠি। বাবার মন। ও হঠাৎ এমন মেসেজ কেন আমাকে দিল। এই ম্যাসেজের উত্তরে আমি লিখি, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে ফরিয়াদ, তিনি যেন তোমাদেরকে নেক হায়াত দান করেন। শারীরিকভাবে সুস্থ রাখেন, বেশি বেশি হালাল রুজি উপার্জন করার তৌফিক দেন। এরপর ছেলে কোনো উত্তর না দেওয়ায় আবার লিখি, আব্বু কী অবস্থা তোমাদের? আমাকে জানাও। এরপর বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে এই মেসেজের উত্তরে তারেকুল লেখে, ঠিক আছি, টেনশন কইরেন না, দোয়া করেন।
তখনও নিজেদের জিম্মি হওয়ার ঘটনা বাবাকে বলেননি তারেকুল। এর এক মিনিট পর ৩টা ৫৬ মিনিটে সাত লাইনের একটি ইংরেজি বার্তা তিনি বাবার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান। সেখানে জাহাজ ও কোম্পানির নাম লিখে তিনি লেখেন, ২০ জনের বেশি জলদস্যু জাহাজে উঠে গেছে, প্রায় ১০০ জন আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমরা জিম্মি। আল্লাহ জানে কী হবে। শক্ত থাইকেন, দোয়া কইরেন।
এরপর তার বাবা লেখেন, আল্লাহপাকের কুদরতি সাহায্য তোমার কাছে পৌঁছে যাবে। এরপর বিকেল ৫টা ৩৭ মিনিটে তারেকুল বাবাকে শুধু একটাই উত্তর দেন- ইনশাআল্লাহ। এরপর আর ছেলের সাথে তিনি যোগাযোগ করতে পারেননি।
তরিকুলের মা হাসিনা বেগম বলেন, আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে সরকার ও জাহাজ কোম্পানির মালিকের কাছে অনুরোধ করি আমার ছেলেসহ যতজন আটকা পরেছে তাদের যেন জীবিত উদ্ধার করা হয়।
রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ঘটনাটি শোনার পর থেকে আমরা প্রশাসনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছি যেন আমাদের এলাকার তারেকুলসহ জিম্মি সবাই জীবিত ফিরে আসতে পারে।
ছকরিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা কৃষক এমারউদ্দিন মৃধা (৬৬) বলেন, ওদের দুইটা ভাইকেই দেখেছি ছোটবেলা থেকে ওরা শান্ত-শিষ্ট এবং পড়ালেখায় খুবই মনোযোগ ছিল। এলাকায় যতদিন ছিল সুন্দরভাবে লেখাপড়া করেছে এরপর ঢাকা ও চট্টগ্রামে লেখাপড়া করে বড় চাকরি পেয়েছিল। ওরা ছিল এলাকাবাসীর গৌরব এবং অনুকরণীয় ব্যক্তি। ওদের এই বিপদে আমাদের সত্যিই মন খারাপ। আল্লাহ যেন তাকে সহি সালামতে ফিরিয়ে আনেন। মায়ের বুকের সন্তান মায়ের বুকে ফিরে আসুক।
জহির হোসেন/আরএআর