বিচারপতিদের ধোঁকা দিয়ে চারবার জামিন নেন ইউপি চেয়ারম্যান
রংপুরের বদরগঞ্জের কালুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল হক মানিকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের বিচারপতিদের ধোঁকা দিয়ে জামিন নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একটি হত্যা মামলার এই আসামি আত্মসমর্পণ না করেই একে একে ৮ জন বিচারপতির সঙ্গে প্রতারণা করে হাইকোর্ট থেকে চারবার জামিন নিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, হাইকোর্টে সবশেষ গত ২১ জানুয়ারি জামিন পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পরই বেরিয়ে যান কারাগার থেকে। এমন স্মার্ট আসামির অভিনব প্রতারণায় হতভম্ব হয়ে গেছেন চেম্বার জজ।
জানা গেছে, বদরগঞ্জ উপজেলার কালুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল হক মানিক। তিনি ২০০৩ সাল থেকে চেয়ারম্যান হিসেবে কালুপাড়া ইউনিয়নের দায়িত্ব পালন করছেন।
মামলার এজাহার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৮ মে দুপুরে টাকা দেওয়া-নেওয়াকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আব্দুল মজিদকে ইউপি চেয়ারম্যানের গ্রামের বাড়ি শংকরপুর সরকার পাড়ায় তুলে নিয়ে মারধর করেন ইউপি চেয়ারম্যান মানিক ও তার ছেলে তমালসহ কয়েকজন। এরপর ওই দিন রাত ৮টার দিকে মজিদ চেয়ারম্যানের বাড়ির ঘাটের ওপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে দুই ব্যক্তি তাকে ভ্যানে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। এ সময় প্রচার চালানো হয় মজিদ উপজেলার সিও রোডে হঠাৎ মোটরসাইকেল থেকে পড়ে আহত হয়েছেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক মজিদকে মৃত ঘোষণা করলে ওই দুই ব্যক্তি হাসপাতাল থেকে সটকে পড়েন।
ঘটনার ছয় দিন পর ২ জুন মজিদের স্ত্রী বিলকিস বাদী হয়ে দুজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনকে আসামি করে বদরগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, মজিদের সঙ্গে সাবেক ইউপি সদস্য সাইদারের সখ্যতা ছিল। সাইদার নানা কৌশলে তার কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই তাকে মেরে ফেলা হয়।
ওই মামলায় আত্মসমর্পণ না করে আসামি শহীদুল হক মানিক হাইকোর্টকে অভিনব কায়দায় চারবার মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ও তথ্য গোপন করে ধোঁকা দিয়েছেন।
সূত্র বলছে, মামলায় ২০২২ সালের ১১ আগস্ট হাইকোর্টে আগাম জামিন চাইতে যান মানিক চেয়ারম্যান। তাকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এর মেয়াদ শেষ হলে আত্মসমর্পণ না করেই ১৯ অক্টোবর তথ্য গোপন করে ফের আগাম জামিন চান আসামি শহীদুল হক মানিক। এবার অন্য বিচারপতি তাকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু এবারও আত্মসমর্পণ না করে পুরনো কায়দায় আবারও আরেক বিচারপতির বেঞ্চ থেকে একই আদেশ নেন তিনি।
এরই মধ্যে গত বছরের ৩১ মে আব্দুল মজিদ হত্যা মামলার চার্জশিটে ৩ নম্বর আসামি হন শহীদুল হক মানিক। ১৪ নভেম্বর ২০২৩ তিনি আত্মসমর্পণ করে যান কারাগারে। তবে এ বছরের ২১ জানুয়ারি আগের সব তথ্য গোপন করে আব্দুল মজিদ ফের বিচারপতি কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চে জামিন চান। জামিন মঞ্জুর হলে ৪৮ ঘণ্টা যেতে না যেতেই কারাগার থেকে বের হন তিনি। এরপরই শহীদুল হক মানিক চেয়ারম্যানের অভিনব প্রতারণা ও তথ্য গোপনের বিষয়টি ধরে ফেলেন বিচারকেরা।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বলেন, চেয়ারম্যান শহীদুল হক মানিক একটি হত্যা মামলার আসামি। চতুর এই চেয়ারম্যান বারবার প্রতারণার কৌশল অবলম্বন করে নিজের সব তথ্য গোপন রেখে জামিন নিয়েছেন। এসব ব্যাপারে আদালত কিছুই জানতেন না। সেই সুযোগটাই রংপুর থেকে কাজে লাগিয়েছেন আসামি শহীদুল হক মানিক।
অবশেষে পুরো বিষয়টি নজরে আসে রাষ্ট্রপক্ষের। তার জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হয় চেম্বার আদালতে। সব নথি দেখে হতভম্ব হয়ে আদালত মানিককে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে— আদালতে প্রতারণা করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান শহীদুল হক মানিক। বিষয়টি এখন পরিষ্কার। তাই তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমন জালিয়াতিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। বলেছেন, আত্মসমর্পণ না করলে তাকে যেন গ্রেপ্তার করে।
এদিকে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে এখনো চেয়ারম্যান শহীদুল হক মানিক গ্রামে ফিরে আসেননি। বুধবার দুপুরে কালুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে গিয়ে তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে তিনি রাজধানী ঢাকাতেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
তার মোবাইল ফোনে কথা হলে শহীদুল হক মানিক বলেন, আমি কোনো প্রতারণার সঙ্গে জড়িত না। এমনকি ওই হত্যা মামলার সঙ্গেও জড়িত না। আমাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে। পৌর মেয়র ও পুলিশের যোগসাজশে আমাকে হয়রানি করতে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। আমি পর পর চারবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। গ্রাম্য রাজনীতিতে আমাকে নিয়ে আগের মতো এখনো ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আদালতে আমি কোনো তথ্য গোপন করে জামিন নেইনি। বিচারপতিদের সঙ্গে প্রতারণা করার প্রশ্নই ওঠে না। এসব মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাকে বিভিন্নভাবে হেয় করার চেষ্টা চলছে। এখন আমার জামিন বাতিল করার জন্য অপচেষ্টা করছে।
বদরগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ মিঞাকে ফোন করা হলে তিনি কল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে