মিথ্যা তথ্যে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ সাবেক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে
১৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের পর এবার বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরিতে যোগদানের অভিযোগ উঠেছে। তবে শুধু হিংসা ও শত্রুতার বশে এসব মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অধ্যাপক শাহজাহান আলী বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। গত ২২ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে তিনি ওএসডি হন। বর্তমানে তিনি অধিদপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন। আজিজুল হক কলেজে কর্মরত থাকা অবস্থায় সিনিয়র বিসিএস ব্যাচের নারী সহকর্মীর সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে ওএসডি করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১৬ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে ‘সংযুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ অনুযায়ী সহকারী অধ্যাপক এর স্থায়ী পদে নিয়োগের জন্য ডিগ্রি কলেজে ছয় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা চাইলেও অধ্যক্ষ শাজাহান আলীর ওই সময় চাকরির অভিজ্ঞতা ৬ বছর ছিল না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সরকারি কলেজের বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপকের স্থায়ী পদে নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহ্বান করে সংযুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সহকারী অধ্যাপকের স্থায়ী পদে নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর সম্মানসহ প্রথম শ্রেণির স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অথবা প্রথম শ্রেণির সম্মানসহ দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ডিগ্রি কলেজে ৬ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনপত্র গ্রহণের শেষ তারিখ ছিল ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাজাহান আলী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগ থেকে ১৯৮৭ সালের এমএসসি পরীক্ষা দেন ১৯৮৯ সালে। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয় ১৯৯০ সালের মে মাসের ১৩ তারিখে। তার এমএসসি পাশের তারিখ থেকে ‘সংযুক্তি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’ অনুযায়ী আবেদনের শেষ তারিখ ৭ মার্চ ১৯৯৬ পর্যন্ত সময় দাঁড়ায় ৫ বছর ৭ মাস ২৪ দিন। অথচ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে ৬ বছর।
এর আগে সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কলেজের বিভিন্ন ফান্ড থেকে ১৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত বগুড়া জেলা অফিসে একটি অভিযোগ দেন।
অভিযোগে বলা হয়, প্রফেসর শাহজাহান আলী আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারিতে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১৫ কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি। অভিযোগে আরও বলা হয়, কলেজের পাঁচটি পুকুর রয়েছে। এই পুকুরগুলো সরকারি লিজ না দিয়ে নিজস্ব লোক দিয়ে মাছ চাষ ও বিক্রি করতেন শাহাজাহান আলী। নিজ ভবনে কলেজের বাস রেখে গ্যারেজ ভাড়ার মোটা টাকা আদায় করতেন তিনি। এ ছাড়া কলেজের নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবে লেনদেন না করে এক কর্মচারীর মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন করান তিনি।
বিষয়টি আমলে নিয়ে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি কলেজ অধ্যক্ষের কাছে পাঠানো হয়। সেখানে অনুসন্ধানের স্বার্থে অফিসের রেকর্ডপত্র ও তথ্য চাওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের কয়েকজন শিক্ষক জানান, কলেজের অধ্যক্ষ অনিয়ম এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সেটি সঠিক। তিনি কলেজের বিভিন্ন ফান্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া তিনি নিজের খেয়াল খুশি মতো চলেন। কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল থাকা সত্ত্বেও তিনি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর গণিত বিভাগের অধ্যাপক মাহতাব উদ্দিনকে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এটা তো সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ছাড়া তিনি নিজের নামে বেগম রোকেয়া হোস্টেলে ‘শাহজাহান আলী পাঠাগার’ করেছেন।
সরকারি বিধি না মেনে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অধ্যাপক শাহজাহান আলী। তার কাছে থেকে জানা যায়, ১৯৮৯ সালে মাস্টার্স পাশ করেছেন এবং ওই বছরই টিএনটি বোর্ড কলেজে চাকরিতে যোগদান করেন। তবে চাকরি জীবনের শুরু ঢাকার উত্তরার উত্তরখান এলাকায় অবস্থিত হাবিব জামান কলেজ দিয়ে। সেটি ডিগ্রি কলেজ ছিল বলে জানান তিনি।
শাজাহান আলী বলেন, আমাদের নিয়োগ একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়। নিয়োগের আগে আমাদের যাবতীয় কাগজপত্র যাচাই করে দেখে। আমাদের পুলিশ ভ্যারিফিকেশনও হয়েছে। আমি ভুয়া কাগজ দিলে তা এতদিন কেউ ধরতে পারলো না?
হিংসা ও শত্রুতা থেকে এসব মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন শাজাহান আলী। তার ভাষ্য, আমি দীর্ঘদিন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অনেক কাজ করেছি। আমি যতদিন ছিলাম তখন এসব নিয়ে কোনো কথা হয়নি। আমি চলে আসার পর এসব কথা তোলা মানে একটা পক্ষ যারা আমার সঙ্গে সব সময় শত্রুতা করেছে, তারাই এসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য ছড়াচ্ছে।
১৫ কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে শাজাহান আলী বলেন, এটাও হিংসা থেকে করা মিথ্যা অভিযোগ। দুদক আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি সব হিসাব, নথি যাচাই করে দেখতে বলেছি। এসবের কোনো সত্যতা পাওয়া যাবে না।
তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের বগুড়া কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়টি আমরা অনুসন্ধান করছি। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে দুদক।
আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এএএ