৪ হাজার টাকায় শুরু, এখন বছরে আয় ৩ কোটি
স্নাতক পাস করে ২৮৮ টাকা বেতনে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন খুলনার ডুমুরিয়া গ্রামের নান্নু মিয়া। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় বলে চাকরি ছেড়ে মাছ চাষে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখেন। ১৯৯২ সালে চার হাজার টাকা নিয়ে চলে আসেন যশোরের মৎস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত চাঁচড়ার হ্যাচারি পাড়ায়। এখানে একটি পুকুর নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। অল্প পুঁজি নিয়েই নানা জাতের মাছের রেণু উৎপাদন শুরু করেন। এরপর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এরই মধ্যে মাছের রেণু উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছেন নান্নু মিয়া। চার হাজার টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করা নান্নু প্রতি বছর কার্পজাতীয় মাছের প্রায় চার কোটি রেণু উৎপাদন করেন। রেণু থেকে তার বছরে আয় তিন কোটি টাকা।
এরই মধ্যে জেলায় দুই বারের শ্রেষ্ঠ মৎস্য চাষির পুরস্কার পেয়েছেন। তার দেখানো পথে হেঁটে এলাকার অনেক বেকার তরুণ স্বাবলম্বী হয়েছেন। পরিশ্রম, অদম্য ইচ্ছা আর দৃঢ় মনোবলকে পুঁজি করে গড়েছেন ‘নান্নু আদর্শ মৎস্য হ্যাচারি’।
নান্নু মিয়া বলেন, দেশের বৃহৎ মৎস্যপল্লি যশোরের চাঁচড়া। দুই যুগের বেশি সময় ধরে এখানে মাছের রেণু উৎপাদন করি। রেণু দিয়ে আমি শূন্য থেকে কোটিপতি।
তিনি বলেন, তবে এখন আগের মতো ব্যবসা নেই। বর্তমানে অক্সিজেন সংকট, মাছের খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণে আগের মতো ব্যবসা হয় না। সরকারের উচিত রেণু চাষিদের পাশে দাঁড়ানো। সরকারি সহযোগিতা পেলে রেকর্ড পরিমাণ রেণু উৎপাদন হবে।
শুধু নান্নু মিয়া নন; সাদা মাছের রূপালি বিপ্লবের এমন নায়ক আরও অনেকেই। নান্নু মিয়ার মতো শতাধিক হ্যাচারি মালিকের রয়েছে দিনবদলের গল্প। যারা যশোরে মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষে অপার সম্ভাবনা জাগিয়েছেন। দেখিয়েছেন সফলতার পথ।
আশির দশকে শুরু হলেও ২০১০ সালের পর থেকে চাঁচড়া হ্যাচারি পাড়ায় দেশি-বিদেশি মাছের রেণু উৎপাদন হয়। উৎপাদনে রেকর্ডের পাশাপাশি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে এই হ্যাচারিপাড়া।
জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, আশিক দশকে যশোরে মাছের রেণু উৎপাদনের বিস্তার ঘটে। যশোরে ১৩ হাজার ৬২৬ হেক্টর জলায়তনের পুকুর ও ১৩ হাজার ৯৩১ হেক্টর বাঁওড় রয়েছে। হ্যাচারিগুলোতে উৎপাদিত রেণু এসব জলাশয়ে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ। বিশেষ করে যশোর শহরের চাঁচড়াসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে ৮৭টি হ্যাচারি।
রুই, কাতল, থাই পাঙাশ, শিং, কই, মাগুর, সিলভার কার্প, কালিবাউশ, মিরর কার্প, মৃগেল, গ্রাস কার্প, সরপুঁটিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সাত থেকে আট হাজার কেজি রেণু প্রতিদিন উৎপাদন হয়। মাসে উৎপাদন হয় ২৮-৩২ হাজার কেজি রেণু। প্রতি কেজি রেণু গড়ে দুই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। মাসে পাঁচ কোটি ৬০ লাখ থেকে ছয় কোটি ৪০ হাজার টাকার রেণু বিক্রি হয়।
জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতি সূত্র জানায়, এসব রেণু দেশের মোট চাহিদার ৮০ ভাগ পূরণ করছে। পাশাপাশি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে রফতানি হয় এসব রেণু।
তবে বর্তমানে হ্যাচারি মালিকরা অনেক কষ্টে দিন পার করছেন। ব্রুড স্বল্পতা, পুকুর লিজ, মাছের খাবার ও বিদ্যুতসহ উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট সব কিছুর মূল্য বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে রেণু উৎপাদনে পড়েছে বিরূপ প্রভাব। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা। ফলে বিপর্যয়ের মুখে রেণু উৎপাদন। এ অবস্থায় লোকসানের ঝুঁকি নিয়ে রেণু উৎপাদন করছে হ্যাচারিগুলো।
মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাষিদের সমস্যা সমাধানে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে না হ্যাচারি মালিকদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভোর হতেই চাঁচড়া চেকপোস্ট মোড় থেকে বিশাল এলাকায় সড়কের দুই পাশে ট্রাক, পিকআপ, ইঞ্জিনচালিত নছিমন, আলমসাধু দাঁড়িয়ে আছে। এসব গাড়িতে রেণু নিয়ে যান ব্যাপারীরা। বাজার বসে প্রতিদিন ভোর থেকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেণু বিক্রি শেষ হয়ে যায়। প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার রেণু বেচাকেনা হয়।
বাপ্পী রেণু পোনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক বাপ্পী ইসলাম বলেন, মাছের রেণুর জন্য যশোর বিখ্যাত। দেশের চাহিদার সব ধরনের মাছের প্রায় ৮০ ভাগ রেণু এখান থেকে সরবরাহ করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অর্ডার দিলে রেণু পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মানের দিক দিয়েও যশোরের রেণুর সুনাম রয়েছে। কিন্তু মৎস্য বিভাগ কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ দেয় না আমাদের। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা রেণু চাষ করি।
হ্যাচারি মালিক নিজাম উদ্দিন বলেন, বর্তমানে রেণু উৎপাদন কমে গেছে। রেণু উৎপাদনে যে পরিমাণ খরচ হয়; বিক্রি করে চালান ওঠে না। যার কারণে আমরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। আগামীতে রেণুর বাজার ভালো হবে কিনা দুশ্চিন্তায় আছি।
রূপালি পোনা হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী শেখ মেজবাহ উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাষি ও ব্যবসায়ীর হাক-ডাকে মুখরিত থাকত চাঁচড়া মৎস্যপল্লি। বর্তমানে তা নেই। কোনোমতে চলছে ব্যবসা। করোনা শেষ করে দিয়েছে রেণুর বাজার।
দেশ হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী আতিকুর ইসলাম বলেন, তিন বছর ধরে আমার হ্যাচারিতে রেণু উৎপাদন কমে গেছে। রেণু উৎপাদনের প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। রেণু উৎপাদন করতে যা খরচ করি; অর্ধেক টাকাও উঠাতে পারি না। সরকার যদি হ্যাচারি মালিকদের বাঁচাতে চায়; তাহলে ঋণ দিতে হবে।
এদিকে রেণু বিক্রি নিয়ে কেউ কেউ অনলাইনে প্রতারণা করছে বলে অভিযোগ বিভিন্ন চাষির। এজন্য রেণু বিক্রি কমেছে বলে জানালেন শামীম মৎস্য হ্যাচারির মালিক শামীম আহম্মেদ।
শামীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন অনলাইনে ব্যবসা হয়। আমাদের ব্যবসা কমে গেছে। অনলাইনে কিছু মানুষ প্রতারণা করছে। ফলে ব্যবসায়ীরা আর এখানে মাছের রেণু নিতে আসছে না। ব্যবসায়ীদের পেটে লাথি পড়লে কীভাবে ব্যবসা করবে? আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সরকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ বা আর্থিক সহায়তা দিলে ভালোভাবে রেণু উৎপাদন করতে পারতাম।
জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান গোলদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যশোরে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় কার্পজাতীয় মাছ। স্বাদু পানির মাছের মধ্যে শিং, কই ও মাগুরও ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয়। দেশি কইয়ের পাশাপাশি চাষ হয় থাই ও ভিয়েতনামের কই।
তিনি বলেন, যশোরের রেণুর গুণাগত মান ভালো হওয়ায় দেশব্যাপী সুনাম রয়েছে। এসব রেণু বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, নড়াইল, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। যশোরে রেণু উৎপাদনে খরচ বেশি না হলেও বাজারজাত নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়। কারণ পরিবহন ও অক্সিজেনের মূল্য বেশি।
তিনি বলেন, মাছ চাষে ভূমি উন্নয়ন কর উঠিয়ে বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। এতে মৎস্যখাতের উন্নতির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। যশোরে প্রতিদিন ২-৩ কোটি টাকার রেণু বিক্রি হলেও বতর্মানে ২০-২৫ লাখে নেমেছে। এজন্য চাষিরা বিপাকে পড়েছেন। চাষিদের প্রণোদনা দিতে হবে।
যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিচুর রহমান বলেন, চাঁচড়ার হ্যাচারি পাড়ায় সাদা রঙের সব ধরনের মাছের রেণু উৎপাদন হয়। চলতি বছর ৬.৮২ মেট্রিক টন রেণু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উন্নতজাতের ও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের রেণু উৎপাদনের লক্ষ্যে জেলা ও সদর উপজেলা মৎস্য বিভাগ সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চাঁচড়ায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় নির্মাণ করা হয়েছে মাছের রেণু বিক্রির আধুনিক বিক্রয় কেন্দ্র। এটি চালু হলে আর্থিকভাবে লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরা। চলতি বছরের মার্চ এপ্রিল থেকে এখানে মাছের রেণু বিক্রি করতে পারবেন হ্যাচারিপল্লি চাষিরা।
এএম