২৮ বছর ধরে চিংড়ি চাষ, প্রতিবারই লাভ
এক যুগের ব্যবধানে অর্ধেকে নেমেছে বাগেরহাটের চিংড়ি মাছ উৎপাদন। কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা ও নানা কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সাদা সোনাখ্যাত এই মাছ চাষ।
দেশের সবচেয়ে বেশি চিংড়ি মাছ উৎপাদন হয় বাগেরহাটে। কিন্তু লোকসানের মুখে অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন চিংড়ি চাষ। যারা এখনো আছেন, তারাও পুঁজি হারানোর আশঙ্কায়। এ অবস্থায় চিংড়ি চাষ ধরে রাখতে সরকারি সহায়তা চান প্রান্তিক চাষিরা।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। কারিগরি পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সহায়তার মাধ্যমে চাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, জেলায় ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাড়ে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। অথচ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এ উৎপাদনমাত্রা ছিল ৬৪ হাজার মেট্রিক টন।
সদর উপজেলার মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল হক মোড়ল বলেন, ২৫ বছরের বেশি সময় মাছ চাষ করি। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, আয় ততই কমছে। ২০০৫ সালের পর থেকে হোয়াইট স্পট ভাইরাস, ইয়োলো হেড, ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে গলদা চিংড়ি আক্রান্ত হচ্ছে। তিন-চার বছর ধরে নতুন আরও একটি রোগ দেখা দিয়েছে। এটি কি ধরনের রোগ তা আজো শনাক্ত করতে পারিনি আমরা।
তিনি বলেন, মাটির উর্বরতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত উৎপাদন কমছে। তারপর আবার কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে মাছের ন্যায্য দাম পাই না।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সরকারি কোনো সহায়তা এলে আমাদের কাছে পৌঁছায় না। চিংড়ি চাষের আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। চাষিদের ওই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে এবং মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করা হলে হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারব।
সদর উপজেলার কাড়াপাড়ার চিংড়ি চাষি নাহিদ আকুঞ্জী বলেন, চিংড়ি বিক্রির অর্থের ওপর নির্ভর করে আমাদের সারা বছর চলতে হয়। তবে এখন চিংড়ি চাষ করে খরচই ওঠে না। এভাবে চলতে থাকলে সামনে আমরাও চিংড়ি চাষ ছেড়ে দেব।
সদর উপজেলার যাত্রাপুরের তরুণ চাষি শেখ বাদশা বলেন, ২০১৭ সালে পড়ালেখার পাশাপাশি ৬০ শতাংশ জায়গা নিয়ে চিংড়ি ও সাদা মাছ চাষ শুরু করি। প্রথম বছর লাভ হয়। লাভের টাকায় বাড়ির আরেকটি পুকুরে মাছ চাষ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরের বছর থেকে মাছের দাম কমতে থাকে। অপরদিকে মাছের খাবারের দাম বাড়তে থাকে। এতে আমি লোকসানে পড়ি। গত তিন বছর ধরে লোকসান গুনতে গুনতে এখন আমি নিঃস্ব। এখন প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালাই।
একই এলাকার ইমরান হাওলাদার বলেন, গত বছর খরচের টাকাই তুলতে পারিনি। বাধ্য হয়ে চিংড়ি চাষ ছেড়ে দিয়েছি। এখন বিভিন্ন মাছ চাষ করি। এতে তেমন লাভ হচ্ছে না। আরও একটি বছর দেখি, লাভ না হলে মাছ চাষ ছেড়ে দেব।
রামপাল উপজেলার চিংড়ি চাষি রুহুল আমিন বলেন, এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু অতিরিক্ত খরা ও জোয়ারের পানি ঠিকমতো না আসায় আমরা প্রতি বছর লোকসানের মুখে পড়ছি। লোকসানের মূল কারণ চিংড়ির দাম কমে যাওয়া।
আব্দুল হক মোড়ল, নাহিদ আকুঞ্জীর লোকসান হলেও একই এলাকার চিংড়ি চাষি মো. আলমগীর হোসেন দীর্ঘ ২৮ বছর চিংড়ি চাষে একবারও লোকসানের মুখে পড়েননি। প্রতিবারই তার লাভ হয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতা আর প্রশিক্ষণের আলোকে তিনি বলেন, চিংড়ি চাষের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। নিয়মের বাইরে গেলেই চাষিরা লোকসানে পড়েন। বাগেরহাটের মাটিতে প্রচুর অ্যামোনিয়া থাকে, যা চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর। বছরের শুরুতে ঘের দুই মাস রোদে শুকিয়ে রাখি। এতে যেমন অ্যামোনিয়া মারা যায় তেমনি মাটি উর্বর হয়। ফলে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। পানির তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, পরিমাণ অনুযায়ী খাবার এবং যথা সময়ে (রেণু ছাড়ার তিন মাসের মধ্যে) চিংড়ি ধরতে হয়। কিন্তু অদক্ষতা আর প্রশিক্ষণের অভাবে স্থানীয় চাষিরা এই বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ্যে রাখেন না। তারা তাদের মনমতো রক্ষণাবেক্ষণ করেন। এজন্য লোকসান হয়। সঠিক প্রশিক্ষণ এবং যথাযথ নিয়ম মেনে চিংড়ি চাষ করলে কোনোদিন লোকসান হবে না।
একই এলাকার চিংড়ি চাষি মুশফিকুল ইসলাম রিতুও এ বছর লাভবান হয়েছেন। তিনি বলেন, পোনা ছাড়ার দুই মাস আগ থেকে ঘের প্রস্তুত করি। পরবর্তীতে চাষ দিয়ে জমি মাছ চাষের উপযুক্ত করে পোনা ছাড়ি। রাসায়নিক সারের বদলে ঘেরে জৈব সার ব্যবহার করি। আমাদের অনেক চাষি না বুঝে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেন; যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। পোনা ছাড়ার ক্ষেত্রে আমরা সতর্ক থাকি। কম দামি হ্যাচারির পোনা না ছেড়ে উন্নত পোনা ছাড়লে উৎপাদন ভালো হয়।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি সুমন ফকির বলেন, দিন দিন চিংড়ি চাষের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। পোনা সংকট, রোগের প্রাদুর্ভাব; পাশাপাশি চাষের জমি কমে গেছে। দাম কমে যাওয়ায় চাষিরা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
তিনি বলেন, সনাতন চাষ পদ্ধতি বাদ দিয়ে আধুনিক চাষ পদ্ধতি ব্যবহারের বিকল্প কিছু নেই। অন্যথায় এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে চিংড়ি চাষ থাকবে না।
ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিটলার গোলদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার পানি ঘেরে প্রবেশ করায় নানা রোগে আক্রান্ত হয় চিংড়ি। মাছের খাবারের দাম বেড়ে গেছে, চিংড়ির দাম কমে গেছে। ফলে কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনছেন চাষিরা।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে মৌসুমের শুরুতে হঠাৎ আবহাওয়াজনিত কারণে প্রায় ৩০ কোটি টাকার গলদা চিংড়ি মারা যায়। এজন্য ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া চাষিরা নিঃস্ব হয়ে যান। অনেকেই চিংড়ি চাষ ছেড়ে দেন। চিংড়ি উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারকে চিংড়ি নীতিমালা বাস্তবায়ন ও সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম রাসেল বলেন, করোনার প্রভাব পড়েছে চিংড়িশিল্পেও। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রান্তিক চাষিরা। চাষিদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে জেলার ২৮ হাজার মৎস্য চাষিকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ৪ শতাংশ সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মাছের ভাইরাস, পোনা সংকট ও বিভিন্ন রোগের সমস্যা রোধে আমাদের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, জেলায় মৎস্য অধিদফতরের লাইসেন্সকৃত গলদা পোনা উৎপাদনকারী সাতটি হ্যাচারি এবং লাইসেন্সবিহীন কয়েকটি হ্যাচারি ছিল। যা দিয়ে চাহিদার বড় অংশ পূরণ হতো। কিন্তু ২০১৮ সালে হ্যাচারিগুলো বন্ধ হয়ে গেলে সংকটে পড়েন চাষিরা। এখন বাগেরহাটের দু’একটি হ্যাচারি গলদার রেণু উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশা করি, উৎপাদনে যেতে পারবে তারা।
এএম