দিনাজপুর বিআরটিএ : দালাল ছাড়া মেলে না কাঙ্ক্ষিত সেবা
দিনাজপুরের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অফিসের মূল ফটকের সামনে গোটা দশেক মোটরসাইকেল দাঁড়ানো। কেউ গাড়ি দাঁড় করে সিটে বসে আছেন। আবার কেউ সিটে বসে ফরম পূরণ করছেন। অন্যদিকে অফিসের বারান্দায় কাউন্টারগুলোতে এলোমেলো দাঁড়ানো জনা ত্রিশেক মানুষ। কেউ আসছেন, কেউ যাচ্ছেন। এটি দিনাজপুর বিআরটিএ অফিসের রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টার চিত্র। আসা-যাওয়া প্রত্যেকের উদ্দেশ্য প্রায় এক। গাড়ির নিবন্ধন, চালকের নিবন্ধন। কারো কাজ নবায়ন করা, আবার নতুন নিবন্ধন করতে এসেছেন কেউ কেউ।
মোটরসাইকেলে বসা মাঝবয়সী একজন কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে জানালেন তার নাম মাসুদুর রহমান। মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে এসেছি জানতে পেরে আগ বাড়িয়ে বলা শুরু করলেন, ছবি এনেছেন? জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, চোখ পরীক্ষার কাগজ এসব ঠিক আছে? হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিতেই মাসুদের উত্তর তাহলে আর চিন্তা কি? হাত উঁচু করে ৫০ মিটার দূরে একটি ফটোকপির দোকান দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে দোকানটা দেখা যাচ্ছে, ওখানে ফরম পাওয়া যায়। ফরমটা পূরণ করে সঙ্গে আনা কাগজপত্রগুলো অফিসে জমা দেন। বাদ বাকি কাজ অফিসের।’
লার্নারের জন্য ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া হয়নি শুনে আর দেরি করলেন না। কাগজপত্র সব হাতে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘১০ হাজার টাকা লাগবে। ৪০ দিন পরে লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। এখন ভাবেন আমাকে দিয়ে করাবেন নাকি নিজে করবেন।’ আবার বলতে লাগলেন, ‘খামাখা হয়রানি না হয়ে, নিজের কাজের ব্যাঘাত না করে আমারে দায়িত্ব দেন, করে দেব ভাই।’
দিনাজপুর বিআরটিএ অফিসে ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে এসে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি এমন কাউকে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল না।
অফিসের নিয়ম অনুযায়ী, অনলাইনে তথ্য ফরম পূরণ করতে হবে। পরবর্তীতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৫২৭ টাকা (গত বছর ৩৪৫ টাকা ছিল) প্রদান করলে সাময়িকভাবে একটি প্রমাণপত্র (লার্নার) পাওয়া যাবে। সেখানে উল্লিখিত তারিখ অনুযায়ী বিআরটিএ অফিসে লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। পরীক্ষায় পাস করার পর ব্যাংকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। সেই জমার রসিদ, ছবি, ভোটার আইডি কার্ড, স্বাস্থ্য পরীক্ষার সনদ, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, বিদ্যুৎ বিল প্রদানের রসিদ সংযুক্ত করে অফিসে জমা দেওয়ার পর এক সপ্তাহ পরে পুনরায় বিআরটিএ অফিসে এসে আঙুলের ছাপ ও ছবি তোলার কাজ সম্পন্ন করতে হবে। সেদিনই সাময়িকভাবে গাড়ি চালানোর জন্য লাইসেন্স দেয় বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। আর মূল লাইসেন্স পেতে অপেক্ষা করতে হয় কয়েক বছর পর্যন্ত।
তবে লাইসেন্স করতে আসাদের দুর্ভোগ কমানোর কথা বলে মাসুদুর রহমানের মতো বেশ কয়েকজন বিআরটিএ অফিসের আশপাশেই সজাগ থাকেন। নির্ধারিত খরচের বাইরে অতিরিক্ত কিছু অর্থ দিলে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গ্রাহকের ভোগান্তি দূর করে দেন তারা। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত খোদ বিআরটিএ অফিসের মধ্যম স্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। যদিও তাদের ভাষ্য, অনলাইনে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর গ্রাহকের ভোগান্তি অনেকাংশে কমে গেছে।
জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার সোহেল রানা নামের একজন মোটরসাইকেলচালক ৬ মাস আগে ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু এখনো লাইসেন্স পাননি। আজ বিআরটিএ অফিসে এসে কবে পাবে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর পাননি।
বীরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়বাড়ি এলাকার মনির হোসেন বলেন, কী আর বলব। এই লাইসেন্সের জন্য আর কতদিন ঘুরতে হবে! অথচ আমার বাড়ির পাশের এক বড় ভাই দালাল ধরে আমার পরে আবেদন করে লাইসেন্স করে নিল। আর আমি দালাল ধরিনি বলে আজও লাইসেন্স পাইনি। টাকা খরচ করে বীরগঞ্জ থেকে দিনাজপুরে আসি আর ঘুরে যাই। এভাবে যদি সব জায়গায় দুর্নীতি হয় তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?
দিনাজপুর সদরের বাসিন্দা বুলবুল হোসেন বলেন, প্রথমে যেদিন আসি একজন কাজ করে দেবে বলে আমার কাছে দুপুরের ভাত খেয়েছে। তারপর কী কী করে ফরম পূরণ করল। দ্রুত কাজ করে দেবে বলে দুই হাজার টাকা নিল। পরে উনি আমার নম্বর নিয়ে কয়েকদিন পর পর কল দেয় আর টাকা চায়। আমি আর কোনো টাকা দিইনি। প্রায় ছয় মাস ধরে আমার কাজের কোনো আপডেট পাচ্ছি না।
বিরল উপজেলার শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথমবার দালাল ধরিনি। তাই ভালো পরীক্ষা দিয়েও ফেল করেছি। এবার দালালের মাধ্যমে আবেদন করেছি। দালাল বলেছে শুধু পরীক্ষার দিন উপস্থিত থাকবেন বাকি কাজ আমার। গতবার দালালরা ৮ হাজার চেয়েছিল কিন্তু দিইনি। এবার ১০ হাজার টাকা দিতে হলো। এখন টাকা ছাড়া কোথাও কিছু হয় না। টাকা দিলে সব পাস।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দিনাজপুর বিআরটি’র সহকারী পরিচালক মো. কাফিউল হাসান মৃধা বলেন, অনলাইনে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর গ্রাহকের ভোগান্তি অনেকাংশে কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, জেলায় মোট এক লাখ ২৪ হাজার ৬৪৯টি যানবাহনের লাইসেন্স আছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ১ লাখ ১৯ হাজার ৩৪৮টি। বাকীগুলো অন্যান্য যানবাহন। তবে দিনাজপুরে কতগুলো বৈধ যানবাহন আছে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না।
এমজেইউ