বাড়ছে কিশোর অপরাধ, নিষ্ক্রিয় পাড়া-মহল্লার ক্লাব
রংপুর নগরীর শাপলা চত্বর এলাকার রানা (ছদ্মনাম)। এক দশক আগেও ফুটবল নিয়ে মাঠে মাঠে দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ছিল তার সরব অংশগ্রহণ। ভালো খেলার কারণে কখনো কখনো রংপুরের বাইরে গিয়েও খেলেছেন। রানার ফুটবল নৈপূণ্য আর শৈল্পিক প্রতিভা মন ভরে উপভোগ করতেন ফুটবলপ্রেমী দর্শকরা। দিনকে দিন ভালো খেলার কারণে এক সময় ঢাকা থেকে ডাকও পেয়েছিলেন। কিন্তু দক্ষ সংগঠকের পৃষ্টপোষকতা ও সহযোগিতার অভাবে অকালে ঝরে পড়েন রানা।
জানা গেছে, যে ক্লাবের হয়ে মাঠে খেলতে দেখা যেত রানাকে, হঠাৎ করে সেই ক্লাবের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ায় সঙ্গী পরিবর্তনে ফুটবল ছেড়ে নেশার জগতে পা পড়ে রানার। বর্তমানে ফুটবল থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গেছেন তিনি। আগের মতো নেই ফুটবলের প্রতি আবেগ ও ভালোবাসা। খেলাধুলা ঘিরে এখন আর স্বপ্নও দেখেন না। অথচ এক সময় রানা ম্যাচসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার হাতে নিয়েই জাতীয় দলে খেলার ইচ্ছের গল্প শোনাতেন।
ফুটবলার রানার মতো রংপুরে অনেক প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময়ী খেলোয়াড় জ্বলে উঠার আগেই আঁতুড়ঘরে নিভে গেছেন। আর এখন আগের যেকোনো সময়ের রানার মতো ঝড়ে পড়া সম্ভাবনাময়ী খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনেক বেশি। পাড়া-মহল্লার ক্লাবগুলো আগের মতো কার্যক্রমে নেই সক্রিয়। কিছু কিছু ক্লাব টিকে থাকলেও রয়েছে দক্ষ সংগঠক আর পৃষ্ঠপোষকের অভাব। তবে বেশির ভাগ ক্লাবের নিষ্ক্রিয়তার কারণে মাঠবিমুখ শিশু-কিশোর ও তরুণ-যুবাদের যেমন সংখ্যা বেড়ে চলছে, তেমনি বাড়ছে কিশোর অপরাধও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুরে এক সময়ের খেলাধুলার শীর্ষ স্থানীয় ক্লাব হিসেবে সর্বাধিক পরিচিতি ছিল বাবুখাঁর নজরুল সংঘ পাঠাগার, নিউ সেনপাড়ার শহীদ রতন স্পোর্টিং ক্লাব, শাপলা চত্বরের এ্যামেচার স্পোটিং ক্লাব, শাপলা চত্বর যুব সংঘ, আদর্শপাড়া এলাকার আদর্শ যুব সংঘ, হাবিবনগরের জাতীয় তরুণ সংঘ, গ্রান্ড হোটেল মোড়ের মকবুল স্মৃতি সংঘ, কামারপাড়ার অগ্রণী সংঘ, গুপ্তপাড়ার এলেভেন স্টারস, মুসলিমপাড়ার ফাইভ স্টার ক্লাব, লালবাগের সেতু ক্লাব, কলোনির ইউনাইটেড ক্লাব, কামাল কাছনা এলাকার ক্রীড়া সংস্থা, জুম্মাপাড়ার সত্য সেনা সংঘ, ইঞ্জিনিয়ারপাড়ার সন্ধানী সংঘ, মুন্সিপাড়ার শহীদ জররেজ ব্যায়ামাগার, মুলাটোল এলাকার উল্কা শিশু সংঘসহ রয়েছে আরও অনেক নাম জানা-অজানা ক্লাব।
এসব ক্লাবের বিভিন্ন বয়সী খেলোয়াড় ও সাবেক সদস্যরা বলছেন, এক দশক আগেও এ ক্লাবগুলো ছিল খেলাধুলায় গৌরবময় প্রতিষ্ঠান। ক্লাবের আঙিনা, মাঠে-ময়দানে খেলোয়াড় ও খেলাধুলা অনুরাগীদের উপস্থিতি ছিল তখন প্রাণবন্ত। ছিল পাড়া-মহল্লায় বছরে বছরে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রিয় ক্লাবের পতাকা উড়ানোর ধুম পড়ত তখন। এখন আর এসব কিছুই চোখে পড়ে না। বরং যে কয়েকটি ক্লাব নামমাত্র টিকে আছে, সেগুলোরও খুব একটা কার্যক্রম নেই।
ক্রীড়ানুরাগী ও সংগঠকদের অনেকের দাবি, রংপুর মহানগরীতে আগের তুলনায় এখন খেলাধুলার তেমন মাঠ নেই। সঙ্গে ক্লাবগুলোতে আগের মতো নেই দক্ষ সংগঠক ও পৃষ্টপোষক। এখন একটা টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আকর্ষণীয় পুরস্কার দিয়েও খেলার দল এবং মাঠে দশর্ক পাওয়া যায় না। মোবাইল আসক্তি, মাঠ বিমুখতা ও দলগত আড্ডার অভ্যাসে পরিণত শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন খেলাধুলা এবং সংস্কৃতি চর্চায় পিছিয়ে পড়ছে। এতে করে কিশোর গ্যাং বাড়ছে, সঙ্গে কিশোর অপরাধ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রংপুর নগরীর হাজীপাড়া এলাকার এ্যামেচার স্পোর্টিং ক্লাবের সাবেক সংগঠক নূর হাসান সুমন বলেন, আগে অভিভাবকরা খেলাধুলার জন্য উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতেন। কিন্তু এখন চিত্র অনেকটাই উল্টো। আগের মতো পাড়া-মহল্লাগুলোতে খেলাধুলার আয়োজন নেই, তবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। অথচ এক দশক আগেও আমরা জমজমাট আয়োজন করতাম। এখন আমাদের এলাকায় কোনো ক্লাব নেই। সময়ের বিবর্তনে অনেক ভালো সংগঠক আড়ালে চলে গেছেন।
সরেজমিনে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ক্লাবের হালচাল জানতে গিয়ে শোনা গেছে, অনেক রেজিস্ট্রেশনভুক্ত ক্লাবের রক্ষকরা ক্লাবের জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর অস্তিত্বপূর্ণ ক্লাবগুলোর প্রতিনিধিরা সিন্ডিকেট করে ক্লাবের বরাদ্দকৃত অর্থ লোপাট করছেন। এসব ক্লাবের সঠিক তদারকি না থাকাসহ খেলোয়াড়দের মেধা বিকাশে ক্রীড়া কার্যক্রম না থাকায় সমাজে বাড়ছে অপরাধ। ফলে নগরীর পাড়া-মহল্লাগুলোতে এখন উঠতি বয়সের কিশোর-তরুণ ও যুবারা পথভ্রষ্ট হচ্ছেন। কেউ আবার সঙ্গদোষে জড়িয়ে পড়ছেন মাদকের গ্যাড়াকলে। এতে করে পাড়া-মহল্লায় তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং।
নগরীর বাবুখাঁ এলাকার বাসিন্দা জুডো কারাতে প্রশিক্ষক ও বিশিষ্ট সংগঠক ইলিয়াস আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, বৃহত্তর বাবুখাঁ গ্রামজুড়ে ৫টি ক্লাব ছিল। এগুলো হলো- উত্তর বাবুখাঁর যুব কল্যাণ সংঘ, দক্ষিণ বাবুখাঁর একতা সংঘ, মধ্য বাবুখাঁর ইয়ং ক্লাব ও বাবুখাঁ দুর্জয় সংঘসহ নজরুল সংঘ পাঠাগার। এখন এসব ক্লাবের মধ্যে মাত্র দু-একটির অস্তিত্ব থাকলেও কয়েক বছর ধরে কোনো কার্যক্রম নেই।
নজরুল সংঘ পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক রশিদুস সুলতান বাবলু বলেন, শুধু ক্লাব সংগঠকদের উদাসীনতা নয়, প্রয়োজন খেলার মাঠ। এক সময়ে আমাদের এলাকায় অনেক ফাঁকা জমি ছিল। এখন ফাঁকা জায়গা নেই। চারদিকে বহুতল ভবন আর বসতবাড়ি গড় উঠেছে। বড়-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে। শুধু ক্লাব পরিচালনা কমিটির ব্যর্থতার কারণে নয়, মাঠ সংকট, পৃষ্টপোষকতার অভাবে ইচ্ছে থাকলেও আমরা টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে পারছি না।
নগরীর কামারপাড়া অগ্রণী সংঘের সাবেক সভাপতি মাহাবুবার রহমান মাহাবুব বলেন, সাত বছর আগে অগ্রণী সংঘের আহ্বায়ক কমিটি গঠন হয়েছে। এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন হয়নি। এখন যারা আহ্বায়ক কমিটিতে রয়েছে, তারা আজ পর্যন্ত কোনো খেলাধুলার আয়োজন করতে পারেনি। গ্রামে খেলাধুলা না থাকায় তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা সম্প্রীতির বন্ধন ও মানসিক বিকাশ ঘটাতে পারছে না।
নগরীর কলেজ রোড এলাকার সাবেক ফুটবল খেলোয়াড় আব্দুস ছাত্তার, মুসলিমপাড়ার এফ রহমান, মুন্সিপাড়ার সাবেক খেলোয়াড় ও ফুটবল প্রশিক্ষক শামিম খাঁন মিসকিন, সেনপাড়ার ক্রিকেট প্রশিক্ষক শাকিল রায়হান, শাপলা চত্বরের রাজু আহমেদ রাজাসহ অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হয় রংপুরের ক্রীড়াঙ্গনে ঝিমিয়ে পড়া ক্লাবগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র, সাবেক ফুটবলার ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যনির্বাহী সদস্য মাহমুদুর রহমান টিটু বলেন, ইন্টারনেটের এই যুগে আমাদের ছেলে-মেয়েরা মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এখন মাঠের সংখ্যা কম সত্য, কিন্তু যা আছে সেটাতেও শিশু-কিশোর এবং তরুণ-যুবাদের উপস্থিতি নেই। উঠতি বয়সেই ছেলেরা এখন মাদকে আসক্ত হচ্ছে, দলবেঁধে বসে ধূমপান করছে। কোথাও কোথাও কিশোররা মিলে বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এতে সাধারণ অভিভাবকরা উৎকণ্ঠায় ভুগছেন। আমাদের এই অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি আমরা সিটি কর্পোরেশন থেকে মেয়র কাপ টি-২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলাম। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন থেকে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা এবং টুর্নামেন্টে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি