ভুয়া সনদে ৮ বছর ধরে প্রধান শিক্ষক তিনি
মাদারীপুরের শিবচরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি। দীর্ঘ দুই বছর পর তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সনদ জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
গত মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মো. মনোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য জানা গেছে।
বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুরের শিবচরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য বিভিন্ন সময় তার সুবিধা মতো ভিন্ন ভিন্নভাবে দিয়েছেন। প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর শেখ ফজিলাতুন্নেছা পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। যোগদানের সময় প্রধান শিক্ষক শুধু বিএ, বিএড সনদ প্রদর্শন করেন। বিদ্যালয়টি ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল জাতীয়করণ করা হয়। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের পর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) গৌর চন্দ্র মন্ডল প্রথম পরিদর্শনে আসেন। ওই পরির্দশন প্রতিবেদনে তার (প্রধান শিক্ষক) শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ, বিএড এবং এমএড পর্যন্ত উল্লেখ করেন।
পরে জাতীয়করণে বিষয় পদ সৃজনের সময় প্রধান শিক্ষক তার শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ, বিএড, এমএ পাস বলে তথ্য দেন। পরবর্তী সময়ে সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ (পাস), বিএড, এমএ, এমএড পর্যন্ত উল্লেখ করেন। এছাড়াও অভিন্ন নামের অন্য একজন শিক্ষার্থীর সনদপত্র জাল করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকা কলেজ থেকে নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে ২০১০ সালে ইংরেজি বিষয়ে এমএ পাসের সনদ জমা দেন। যার রোল নং- ১১৮৩৩, রেজি. নং-৯৩২৯৭৭৩, শিক্ষাবর্ষ ২০০৯-২০১০।
তদন্ত প্রতিবেদনে সূত্রে আরও জানা যায়, কাজির পাগলা এটি ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক কর্তৃক সরবরাহকৃত শিক্ষক হাজিরা খাতার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানুয়ারি ২০০৬ থেকে ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত নিয়মিত ওই স্কুলে উপস্থিত ছিলেন। কর্মরত প্রতিষ্ঠান থেকে ছুটি না নিয়ে শিক্ষক হাজিরা খাতায় নিয়মিত স্বাক্ষর করেছেন। সেই ক্ষেত্রে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে বিএড ডিগ্রি অর্জন বৈধ ও বিধিসম্মত নয় বলে তদন্ত কমিটি মতামত দিয়েছে।
দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি একমত পোষণ করে এবং দাখিলকৃত ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে তার বিভিন্ন সনদ জালিয়াতির বিষয়ে আনীত অভিযোগসমূহ প্রমাণিত হয়েছে। বিএড প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য বিদ্যালয় থেকে ছুটি গ্রহণের তথ্য কোনো বিদ্যালয়ের দলিল দস্তাবেজে পাওয়া যায়নি।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের দাখিলকৃত প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাভার টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষের দেওয়া ভর্তি রেজিস্টার অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের মায়ের নাম ‘রহিমা খাতুন’। কিন্তু এসএসসির সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার মায়ের নাম লেখা ‘ফরিদা বেগম’।
বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের পর প্রধান শিক্ষকের পদ টিকিয়ে রাখতেই মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ব্যক্তিগত ও শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য বিভিন্ন সময় তার সুবিধা মতো ভিন্ন ভিন্নভাবে দিয়েছেন বলে বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক সূত্রে জানা গেছে।
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক জানান, শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. জহিরুল ইসলাম ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে তার বিভিন্ন সনদ জালিয়াতির অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গত ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যরা হলেন- মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মো. মনোয়ার হোসেন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো.সাখায়াত হোসেন বিশ্বাস।
ওই কমিটি ২০২১ সালের ২২ আগস্ট বিদ্যালয়ে এসে সরেজমিনে তদন্ত করে। অবশেষে ওই তদন্ত কমিটি ২০২২ সালের ২৮ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ২০২২ সালের ৬ জুলাই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর ওই প্রতিবেদন প্রেরণ করে।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা সরকারি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। ওই তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। সুষ্ঠু তদন্তে যা হবে, তাই আমি মেনে নিব।
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিবুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এ বিষয়ে মিনিস্ট্রিতে চিঠি যাবে। আমি বিষয়টা খোঁজখবর নিব।
আরএআর