এলাকায় ‘দাদা’ হিসেবে প্রভাব চালাত জিতু
শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে মাদরাসা থেকে বিতাড়িত হয়ে হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন জিতু। ভর্তির পর থেকেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য একাধিকবার অধ্যক্ষের কক্ষে ডেকে শাসন করেন শিক্ষক উৎপল। সর্বশেষ একাদশ শ্রেণিপড়ুয়া এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের ব্যাপারে তাকে শাসন করেন শিক্ষক উৎপল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে পিটিয়ে মারেন জিতু।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ওই ছাত্রীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সে জিতুর বাবার বন্ধুর স্ত্রীর ভাগ্নি। ঘটনার কয়েক দিন আগে কলেজের একটি কক্ষে তাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে প্রেমের বিষয়টি বুঝতে পারেন শিক্ষক উৎপল। তিনি পরে জিতুকে আলাদা ডেকে শাসন করেন। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী হয়েও একাদশ শ্রেণির ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমে নিষেধ করেন তিনি। সেদিন থেকেই শিক্ষকের ওপর জিতু ক্ষুব্ধ হতে থাকেন।
আরও পড়ুন : শিক্ষক উৎপল হত্যা, জিতুর বাবার ৫ দিনের রিমান্ড
আরও জানা যায়, আশরাফুল ইসলাম জিতু দশম শ্রেণিতে পড়লেও তার প্রকৃত বয়স ১৯ বছর। মামলায় ১৬ বছর উল্লেখ করা হলেও লেখাপড়ায় বিরতি থাকায় ১৯ বছর বয়সেও তিনি মাত্র দশম শ্রেণিতে পড়ছেন। এসএসসির রেজিস্ট্রেশনের সময় কাগজপত্রে জিতুর জন্মতারিখ দেওয়া হয়েছে ২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি। সেই হিসাবে এখন তার বয়স ১৯ বছর ৫ মাস ১১ দিন। আর বয়সের আনুপাতিক হিসাব কষেই একাদশের শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রেমে জড়ান।
নিজের চৌহদ্দিতে তিনি ‘দাদা’
স্থানীয় প্রভাবশালী ও ওই কলেজের সভাপতি সুমনের ভাতিজা হলেন জিতু। তার প্রভাবেই এলাকায় আলাদা প্রভাব বিস্তার করেন জিতু। সাভার শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এলাকায় বেশির ভাগ ঢাকার বাইরের জেলার লোকজনের বসবাস। যারা স্থানীয়দের সম্মান করেন কিংবা ভয়ে এড়িয়ে চলেন। এই সুযোগে প্রভাব খাটিয়ে এলাকার ‘দাদা’ বনে যান জিতু। গড়ে ওঠে তারা দাদা বাহিনী। এ বাহিনীতে যারা সদস্য আছে, তারাও তার মতো উগ্র। এ কারণে এলাকার সমবয়সীরা ভয়ে তাকে ‘দাদা’ বলে ডাকত। এ ছাড়া চলাফেরার সময় চাচা সুমনের প্রভাব দেখান তিনি।
পরিবারের আশকারায় বেপরোয়া জিতু
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, জিতুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ লোকজন তার পরিবারকে অভিযোগ দিত। কিন্তু কখনো কোনো প্রতিকার পেতেন না। উল্টো যারা তার বাবা-মায়ের কাছে অভিযোগ নিয়ে যেতেন, তাদের হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে, জিতুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পরিবারকে অভিযোগ দিতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন অভিযোগকারী। এমন ঘটনা এলাকাবাসী সবাই জানে। তাই ভয়ে সবাই মুখ বন্ধ রাখত।
কলেজেও উগ্র আচরণ তার
শুধু এলাকা নয়, চাচা হাজী ইউনুস আলী কলেজের সভাপতি হওয়ায় সুবিধা নেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উগ্র আচরণ করেন। কলেজের শিক্ষার্থী না হয়েও পুরো স্কুল অ্যান্ড কলেজে চলে তার রাজত্ব। তার কাছে সিনিয়র-জুনিয়র কোনো বাচবিছার নেই। সবাইকে থ্রেটের মধ্যে রাখেন। এমনকি শিক্ষকদেরও মানেন না তিনি।
আরও পড়ুন : জিতুকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ, আগামীকাল বৃহৎ কর্মসূচি
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, এ নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পেতেন না কেউ। একের পর এক অপরাধ করেও পার পেয়ে যান জিতু। একাধিকবার পরিবারকে জানালেও কোনো লাভ হয়নি। সবকিছুতেই তার প্রভাবে প্রকম্পিত হয়।
লেখাপড়ায় অমনোযোগী ও দুর্বল শিক্ষার্থী জিতু তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় আচরণ উচ্ছৃঙ্খল হওয়ায় সাভারের একটি মাদরাসায় ভর্তি করে পরিবার। সেখানে লেখাপড়া করার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। একদিন অনৈতিক কাজের কারণে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করে। এরপর তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় এলাকায় বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে মিশে প্রভাব খাটিয়ে চলতেন। ধীরে ধীরে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে ওঠেন। বেশ কিছু দিন পর পরিবার তাকে হাজী ইউনুস আলী স্কুলে ভর্তি করে দেয়।
আরও পড়ুন : শিক্ষার্থীর স্টাম্পের আঘাতে আহত সেই শিক্ষক মারা গেছেন
যা ঘটেছিল সেদিন
হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি শ্রেণিকক্ষে জিতু ও তার প্রেমিকাকে একসঙ্গে দেখে ফেলেন শিক্ষক উৎপল। শিক্ষক উৎপল শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হওয়ায় তিনি জিতুকে শাসন করেন এবং তার পরিবারকে বিষয়টি অবহিত করেন।
অন্যদিকে জিতুর প্রেমিকার পরিবারও বিষয়টি জানতে পেরে তাকে শাসন করে। কিন্তু বকাঝকা করার ঘটনা ফোন করে জিতুকে বলে দেয় তার প্রেমিকা।
প্রেমিকার অপমান-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে জিতু পরিকল্পনা করেন শিক্ষককে শিক্ষা দেবেন। পরে গত ২৫ জুন দুপুরে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন শিক্ষককে। এর দুই দিন পর ২৭ জুন শিক্ষক উৎপল আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
শিক্ষার্থীদের শাসিয়ে যান জিতুর বাবা
খবর পেয়ে হামলার দিন জিতুর বাবা উজ্জ্বল হাজী কলেজে আসেন। এত মানুষের মধ্যে শিক্ষককে একাই তার ছেলে পিটিয়েছে, তা মানতে নারাজ তিনি। ছেলেকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার অভিযোগ এনে উল্টো উপস্থিত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ সবাইকে শাসিয়ে যান তিনি।
শিক্ষক উৎপল যখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, তখনও ঘটনার দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত জিতু তার ‘দাদা বাহিনী’ নিয়ে এলাকায় ঘোরাঘুরি করেছেন। বিভিন্ন দোকানে আড্ডা দিয়েছেন। এলাকাবাসী তাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডারত দেখেছেন। তবে শিক্ষকের অবস্থার অবনতির খবর পেয়ে পরদিন পরিবারসহ উধাও হন।
তবে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ঘটনার খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে শিক্ষক উৎপলের চিকিৎসার খরচ দিতে চান জিতুর মা।
এ বিষয়ে হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান বলেন, আমরা জিতুর ব্যাপারে বরাবরই তার পরিবারকে অবহিত করেছি। কিন্তু তারা শাসন না করে উল্টো আশকারা দিয়েছেন। যার পরিণতি শিক্ষক উৎপলের মৃত্যু।
আরও পড়ুন : শিক্ষার্থীর স্টাম্পের পিটুনিতে শিক্ষক আইসিইউতে ভর্তি
আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এমদাদুল হক বলেন, গতকাল বিকেলে ওই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে শিক্ষককে হত্যায় ব্যবহৃত স্টাম্পটি জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছে কি না, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি আসামিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। দ্রুত গ্রেপ্তার হবে বলে আশা করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার (২৫ জুন) দুপুরে হাজী ইউনুস আলী কলেজে প্রমিলা ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন প্রকাশ্যে শিক্ষক উৎপলকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী জিতু। পরে শিক্ষককে উদ্ধার করে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আইসিইউতে ভর্তি করে তাকে ১৬ ব্যাগ রক্ত দিলেও সোমবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে মারা যান তিনি।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত জিতু ও তার পুরো পরিবার এখন পলাতক রয়েছে। তবে তার বাবা পুলিশের হাতে আটক হয়ে ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
এনএ