‘পুলিশভ্যানে লাথি দিতে দিতে নিয়ে গেছে’
বড় ভাইকে হারিয়ে চেয়ারে বসে কাঁদছে ছোট ভাই আরিফ হোসেন। তার পাশে মা মোমেনা খাতুন মাটিতে গড়াগড়ি করছেন। আর আল্লাহর কাছে বিচার চাইছেন লালমনিরহাট সদর থানার এসআই হালিমের। শুধু তারা নন, এ ঘটনায় পুরো এলাকার মানুষ আজ শোকে মুহ্যমান।
মৃত রবিউলের মা মোমেনা বেগমের দাবি, তাকে পুলিশ ভ্যানে লাথি দিতে দিতে লালমনিরহাট নিয়ে গেছে। আর পরে মারা গেলে হাসপাতালে ভর্তির নাটক করেছে। তাই লালমনিরহাট সদর থানার এসআই হালিমের কঠিন শাস্তি দাবি করেন তিনি।
পোশাক শ্রমিক রবিউলের একমাত্র শিশু কন্যাকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে হু হু করে কাঁদছেন স্ত্রী মনিরা খাতুন। তিনি বলেন, পুলিশের কাছে যারা নিরাপত্তা চায়, তারাই আজ বিধবা হচ্ছে। আমার স্বামী জুয়া খেলেনি। তার সন্তানের জন্য মেলায় গিয়ে খেলনা আনতে গিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তাকে জুয়াড়ি ভেবে আটক করে পুলিশ ভ্যানে টানতে টানতে তুলেছে। সেখানে লাথি পর লাথি দিয়েছে। লাথি পর আমার স্বামী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। পুলিশ আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই হত্যার বিচার চাই।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, নববর্ষ উপলক্ষে সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর বাংলা বাজার এলাকায় বৈশাখী মেলার আয়োজন করে স্থানীয়রা। সেখানে এলাকাবাসী জুয়ার আসর বসালে পুলিশ খবর পেয়ে অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় রবিউল ইসলাম সন্তানের জন্য খেলনা নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। অভিযানকালে রবিউল ইসলাম খানসহ দুইজনকে আটক করে পুলিশ।
রবিউল জুয়া খেলেননি এমন দাবি করে পুলিশ ভ্যানে উঠতে আপত্তি জানালে পুলিশের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। কিন্তু পুলিশ মারধর করে এক পর্যায়ে তাকে ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। ওই সময় তাকে লাথি দেন বলে পরিবার অভিযোগ তুলেছেন। তাই পুলিশ ভ্যানে মারা গেছেন। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নাটক করেছেন বলে পরিবারের দাবি।
পুলিশের ভাষ্য মতে, রবিউল পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় দায়িত্বরত চিকিৎসকরা রবিউলকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। তাকে রংপুর পাঠানোর প্রস্তুতিকালে সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তিনি মারা যান।
এদিকে রবিউলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে মধ্যরাতেই মহেন্দ্রনগর বাজারে লালমনিরহাট-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে অভিযুক্ত সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হালিমের শাস্তি দাবি করেন স্থানীয়রা। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে পুলিশ ভ্যানে হামলা ও ভাঙচুর করে অবরোধকারীরা। সরারাত সেখানে এলাকাবাসী যান চলাচল বন্ধ রেখে প্রতিবাদ করেন। পরেরদিন একই দাবিতে শুক্রবার সকাল থেকে একই স্থানে মহাসড়ক অবরোধ করে রবিউলের হত্যাকারী পুলিশ সদস্যের কঠোর শাস্তির দাবি জানান এলাকাবাসী।
অবশেষে অভিযুক্ত সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হালিমকে দুপুরে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর অবরোধ তুলে নেয় এলাকাবাসী।
মৃত রবিউলের ছোট ভাই আরিফ বলেন, ভাই কখনো জুয়াতে যায়নি। এক সপ্তাহ আগে বাড়িতে এসেছে। বাড়িতে এসেই তার সন্তানের জন্য খেলনা আনতে গিয়ে তিনি পুলিশের নির্যাতনে মারা গেছেন। এই হত্যার কি বিচার হবে না? নাকি পুলিশ বলেই সব মাফ হয়ে যাবে। আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তিনি যেন সুনজর দিয়ে দেখেন এই অসহায় পরিবারটিকে।
লালমনিরহাট সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হবে। আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সদর থানার এসআই হালিমকে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করেছে। পরিবার থানায় মামলা দায়ের করলে নেওয়া হবে।
লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম বলেন, হালিম রবিউলকে নির্যাতন করেছেন কিনা তা তদন্তের বিষয়। এ বিষয় আগে কিছু বলা যাবে না। পরিবারকে আশ্বাস দিয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে এই ঘটনায় পরিবারকে কোনো ক্ষতি পুরণ দেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এড়িয়ে যান।
আরআই