অফিস করেন না ৮১ মাস, নিচ্ছেন নিয়মিত বেতন ভাতা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ডেপুটি রেজিস্ট্রার (৫ম গ্রেড) জিনাত জেরিন সুলতানা। কোনো অনুমতি ছাড়াই ২০১৭ সালের ২২ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ ৮১ মাস অফিস করেননি তিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে না গেলেও নিচ্ছেন নিয়মিত বেতন ভাতা। কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হতে বেতন ভাতা বাবদ ৬০ লাখের বেশি টাকা নিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
জিনাত জেরিন সুলতানা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালে চাকরি নেওয়ার আগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। সেই সূত্র ধরে এমপি, মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে তার ভালো সখ্যতা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতোদিন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। ২০১৮ সালে তার অফিস না করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন ভাতা নেওয়ার বিষয়টি সামনে এলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি প্রশাসনকে রিপোর্ট দিলে মন্ত্রী সচিবদের দিয়ে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের কাছে ফোন দিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার জন্য বলা হয় বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র।
জিনাত জেরিন সুলতানার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
উপাচার্যের পূর্বানুমতি/ছুটি গ্রহণ/দপ্তর প্রধানের অনুমতি ব্যতীত ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে সর্বশেষ কর্মস্থল পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে আজ পর্যন্ত কখনোই উপস্থিত ছিলেন না জেরিন সুলতানা। তবে এর মধ্যে তিনটি মেয়াদে সর্বমোট ৯৫ দিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নেন তিনি। সর্বশেষ ২০২২ সালের জুন মাসে তাকে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। এ বদলির আদেশকে পুনর্বিবেচনা করে রেজিস্ট্রার দপ্তরে বদলি করার জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার আবেদন প্রায়াত উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক বিবেচনায় না নিয়ে তাকে মুজিব হলেই যোগদান করার নির্দেশ দেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত তিনি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে যোগদান না করে কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন।
আরও পড়ুন
জবির এই নারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সরকার আলী আক্কাসকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং ওই বছরেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। কিন্তুও তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান সেই রিপোর্ট নিয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেননি। পরে সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এ বছরের মে মাসে ৯৫তম সিন্ডিকেটে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
শুধু তাই নয়, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে থাকা অবস্থায় পরীক্ষা পারিতোষিক বিল নিজের টেবিলের ড্রয়ারে আটকে রেখে তা কর্তব্য কর্মে চরম দায়িত্বহীনতা ও অসদাচরণের অভিযোগ তুলে রিপোর্ট দেয় ওই তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে জিনাত জেরিন সুলতানার কার্যকলাপ ও আচরণ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৫ এর ৪৪(৬); এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ২(খ ও চ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়ন’ এর আওতায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৩(খ ও গ) বিধি অনুযায়ী ‘কর্তব্যে অবহেলা’, ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়ন’ এর অভিযোগে অভিযুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত জেরিন সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত এক যুগ ধরে আমার সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে। ২০১৭ সালে কন্ট্রোলার অফিসে আমার রুম তালাবদ্ধ করে রাখে তৎকালীন কন্ট্রোলার আক্তারুজ্জামান স্যার। আমার রুম নেই, বসার স্থান নেই এ বিষয়ে আমি রেজিস্ট্রারকে বিভিন্ন সময় জানিয়েছি। আমার নিয়োগ রেজিস্ট্রার দপ্তরে শূন্য পদের বিপরীতে কিন্তু আমাকে এ দপ্তরে না রেখে ষড়যন্ত্র করে কন্ট্রোলার দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়। আমি অসুস্থ আমি কীভাবে দপ্তর ছাড়া অফিস করব?
অসুস্থতার প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটির আবেদন করেছিলেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না আমি মাত্র ৯৫ দিন ছুটি নিয়েছি ২০১৭ সালের পর। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমার বিষয়ে এসব অভিযোগ থাকা স্বত্বেও কীভাবে আমার ২০২০ সালে প্রমোশন হয়?
আরও পড়ুন
সর্বশেষ ২০২২ সালে আপনাকে হলে বদলি করা হলেও আপনি সেখানে কেন যোগদান করেননি? জবাবে জিনাত জেরিন সুলতানা বলেন, আমার নিয়োগ রেজিস্ট্রার দপ্তরে আমি কেন সেখানে (হলে) যোগদান করব? আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওখানে বদলি করায় সাথে সাথেই আমি তৎকালীন রেজিস্ট্রার মো. ওহিদুজ্জামানকে জানিয়েছি কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে আমাকে কোনো সহযোগিতা করেননি।
আপনার বিরুদ্ধে ২০১৭ সাল থেকে অফিস না করে বেতন ভাতা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, আপনি কেন অফিসে যোগদান করেননি— এমন প্রশ্ন তাকে একাধিকবার করা হলেও জবাব এড়িয়ে যান তিনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. শেখ গিয়াস উদ্দিন বলেন, জিনাত জেরিন কীভাবে এতদিন কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়া অনুপস্থিত থেকে বেতন ভাতা নিয়ে যাচ্ছিল সেটা আসলেই ভাবার বিষয়। তার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এবং ৯৫তম সিন্ডিকেটে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ মোতাবেক আমরা তার অভিযোগের বিষয়ে একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেছি। আগামী সাত দিনের মধ্যে এ ঘটনার জবাব চাওয়া হয়েছে। দেখি সে কি জবাব দেন সেই অনুযায়ী আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেবো।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থেকেও কীভাবে বেতন চলমান থাকে— জানতে চাইলে জবির অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মহসিন রেজা বলেন, বেতন বন্ধ থাকবে কিংবা চালু থাকবে সেটা সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রধান কিংবা প্রশাসন থেকে কোনো আদেশ না আসা পর্যন্ত আমাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। জিনাত জেরিনের বেতন বন্ধের ব্যাপারে যেহেতু আমাদের কাছে কোনো আদেশ কিংবা চিঠি আসেনি তাই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারিনি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, একজন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন অফিস না করে কীভাবে বেতন ভাতা পেয়েছেন সেটা আগের প্রশাসনকে জিজ্ঞেস করা দরকার। বর্তমান প্রশাসন ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কারণ দর্শানোর একটি নোটিশ দিয়েছে। সে নোটিশ পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল আমি তাকে বলেছি আপনি আপনার কর্মস্থলে আগে যোগদান করুন তারপর আমরা আপনার কথা বিস্তারিত শোনবো। তার বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আমরা বিধি অনুযায়ী পরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমএল/এমএ