শাবির গার্ড সুপারভাইজারের বছরে ব্যাংক লেনদেন কোটি টাকা!
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানান অনিয়ম ও অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষীদের মানসিক নির্যাতন, বিভিন্ন অযুহাতে বেতন কাটা, চাকরিচ্যুত করার ভয়, নতুন নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগে আর্থিক লেনদেন, অতিরিক্ত ডিউটি দিয়ে অর্থ আদায় থেকে শুরু করে তাদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করানো এবং তা না করলে তাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা যেন ছিল নিয়মিত ঘটনা। অভিযোগের তীর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক মিয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ‘যমুনা সেইফ গার্ড সার্ভিস লিমিটেড কোম্পানি’র নিরাপত্তারক্ষীদের সুপারভাইজার সৈয়দ হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে।
নিয়োগ বাণিজ্য, বেতন পাওয়ার পর নিরাপত্তারক্ষীদের থেকে টাকা কেটে নেওয়া, নিরাপত্তারক্ষীরা ডিউটি না করলেও তাদের অতিরিক্ত ডিউটি দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাসে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া, সুবিধাজনক স্থানে ও সময়ে ডিউটি দিয়ে টাকা আদায়, টাকা না দিলে ডিউটি কর্তন, ওভারটাইম না দেওয়াসহ নানান অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে সে টাকার ভাগ যেতো তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পকেটেও।
সুপারভাইজার হাবিবের এহেন কর্মকাণ্ডে নিরাপত্তারক্ষীরা একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বরাবর অভিযোগ দিলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণেই ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। সর্বশেষ কয়েকমাস পূর্বে প্রায় ৯৪ জন গার্ডের স্বাক্ষর সংবলিত অভিযোগপত্র দিলেও তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি প্রশাসনকে। এ ছাড়াও গার্ডরা বিভিন্ন সময়ে উপাচার্য বরাবর অভিযোগ দিলেও তা উপাচার্যের সাবেক পিএস এবং এপিএস তার সমাধান করে দেবেন বলে তা উপাচার্য পর্যন্ত পৌঁছাতো না বলেও অভিযোগ নিরাপত্তারক্ষীদের।
বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ দেওয়ার নামে হাবিবের টাকা দাবি, অতিরিক্ত ডিউটি দেওয়ার কথা বলে অর্থ আদায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দোহাই দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবির কিছু অডিও রেকর্ড এসেছে প্রতিবেদকের হাতে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গার্ড সুপারভাইজার সৈয়দ হাবিবুর রহমানের ভিন্ন তিনটি ব্যাংকের প্রায় পাঁচটি অ্যাকাউন্টে এক বছরে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকার কাছাকাছি। এই তিন ব্যাংক ছাড়াও অন্য ব্যাংকে তার আরো অ্যাকাউন্ট আছে বলে খবর পাওয়া যায়।
দীর্ঘ অনুসন্ধানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সোনালী ব্যাংক শাবিপ্রবি শাখায় হাবিবুর রহমানের একটি অ্যাকাউন্টে এপ্রিল ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ সাল পর্যন্ত লেনদেন হয় প্রায় ৬০ লক্ষাধিক টাকা। এ ছাড়াও যমুনা ব্যাংকের সিলেট শাখায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যায় এই সময়ের মধ্যে। এদিকে পূবালী ব্যাংকের হবিগঞ্জের বাহুবলের পুটিজুরী শাখায় হাবিবুর রহমানের একাধিক ডিপোজিট অ্যাকাউন্টের খবর পাওয়া গেছে। যাতে প্রতিমাসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও হাবিবুর রহমানের নামে আরও দুই প্রাইভেট ব্যাংকের অ্যাকাউন্টেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের খোঁজ পাওয়া যায়।
এ ছাড়াও তার মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তিনি গার্ডদের কাছ থেকে আর্থিক লেনদেন করতেন বলেও খবর পাওয়া গেছে। এর বাইরেও তার নগদ আর্থিক লেনদেনের প্রমাণও পাওয়া গেছে। সবমিলিয়ে এক বছরে তার প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বেতন প্রায় ১৫ হাজার টাকা।
‘যমুনা সেইফ গার্ড সার্ভিস লিমিটেড কোম্পানি’র অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক নিরাপত্তারক্ষী কাজ করেন। প্রতিমাসে তাদের অনেক গার্ডদের কাছ থেকে এক বা দুই দিনের ডিউটির টাকা কেটে নেওয়া হতো। সে টাকা ভুলে আসেনি বলে তাদের অযুহাত হিসেবে বলা হতো।
চলতি বছরের মার্চ মাসের গার্ডদের বেতনের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তার শ্যালক মো. অবায়দুর রহমান একাই একমাসে ওভারটাইমসহ ডিউটি করেছেন ৬০টি যেখানে অন্যান্য গার্ড মাসে হাবিবুর রহমানকে টাকা দিয়েও ওভারটাইমসহ ডিউটি পেতেন সবমিলিয়ে ৪০টি থেকে ৪৫টি। এদিকে হিসাবমতে অবায়দুর রহমানের বেতন পাওয়ার কথা প্রায় ২৮ হাজার কিন্তু তিনি বেতন পেয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও ওই একই মাসে একাধিক গার্ড তার এক বা দুই দিনের ডিউটির টাকা পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব টাকা হাবিবুর রহমান তার বাধ্য একাধিক গার্ডদের অ্যাকাউন্টে ভাগ করে দিয়ে পরবর্তীতে তাদের থেকে সে টাকা আদায় করে নিতেন বলে খোঁজ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
এদিকে গার্ডদের প্রতিমাসের ডিউটির হিসাব করার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার দপ্তরে বসে এবং তা যাচাই করার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তার। তবে তা না করে সেগুলোর হিসাব হাবিবুর রহমান করতেন মোহাম্মদ ফারুক মিয়ার বাসায় বলেও খোঁজ পাওয়া যায়। সেখানে বসে তারা গার্ডদের ডিউটি বাড়িয়ে-কমিয়ে টাকার ভাগ বাটোয়ারা করতেন বলেও জানা গেছে। যার ফলে প্রতিমাসে গার্ডদের বেতনের এমন অসামঞ্জস্যতা থাকলেও তা তার চোখে পড়েনি কখনো।
দীর্ঘদিন যাবত তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতে নীরব ভূমিকা পালন করছে বলেই জানা গেছে। এমনকি এসব নিয়ে প্রতিবাদ করার কারণে এক কর্মকর্তাকে বদলি করে দেওয়া হয় অন্য দপ্তরে।
নাম উল্লেখ না করা শর্তে ওই কোম্পানির এক সিনিয়র গার্ড বলেন, হাবিবকে টাকা না দিলে আমাদের ওভারটাইম ডিউটি মিলতো না। আমার সংসার অনেক বড়, ওভারটাইম না করলে ওই সংসারের খরচ চালানো অসম্ভব। এগুলো সব দেখিয়েও আমি টাকা না দিলে ওভারটাইম ডিউটি পেতাম না। যারা তাকে টাকা দিতেন তারা প্রায় প্রতিদিনই ওভারটাইম ডিউটি পেতেন।
ওই কোম্পানির অধীনে নতুন যোগদান করা একাধিক গার্ড নাম উল্লেখ না করা শর্তে বলেন, আমাদের সংসারের অবস্থা ভালো না। নিয়োগ হওয়ার পরও আমাদের কাছ থেকে আরও ৫ হাজার টাকা করে নিয়েছে। এরপর ওভারটাইম পেতে টাকা না দিলে চাকরি থেকে বের করে দেবে বলে হুমকি দিতো।
এদিকে সর্বশেষ এত অভিযোগের পর স্বপদে বহাল থাকায় সরকার পতনের পর সব গার্ড একত্রিত হয়ে তাকে ক্যাম্পাস ছাড়া করেন। তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক মিয়া বলেন, আমি এসব কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত নই। আমি এসব কিছু জানি না। হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কোনো বিষয়েই আমার কোনো লেনদেন ছিল না। আমাদের কাজও আলাদা ছিল। তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি অবগত নই।
অভিযোগের বিষয়ে সুপারভাইজার হাবিবুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মিথ্যা। এসবের কোনো প্রমাণ নেই। আমার শত্রুরা আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, আমরা এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এএমকে