ছাত্রলীগের কমিটিতে ২ শিক্ষার্থী, বুয়েটে রাজনীতি ফেরানোর অপকৌশল?
২০১৯ সালে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নৃশংসতম একটি অধ্যায়ের সাক্ষী হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
সম্প্রতি ঘোষিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়েছেন বুয়েটের বর্তমান দুই শিক্ষার্থী। তাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি পুনরায় প্রবেশ করাতে চাচ্ছে ছাত্রলীগ– এমন অভিযোগ উঠেছে। এর মাধ্যমে আবারও বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতিও চালু হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পেয়েছেন নিয়মিত দুজন শিক্ষার্থী। যা সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। সামগ্রিকভাবে এ ঘটনায় পুনরায় ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি আবির্ভাবের আশঙ্কা রয়েছে। পদধারী শিক্ষার্থীরা অন্যদেরও ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থি
গত ১৩ জুলাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়। যেখানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বর্তমান শিক্ষার্থী– ২১ ব্যাচের ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বি ও ১৭ ব্যাচের হাসিন আজফার পান্থকে পদায়ন করা হয়। পান্থ পেয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদকের পদ। রাব্বি কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
বুয়েটে সবধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও ছাত্রলীগের কমিটিতে শিক্ষার্থীদের এ পদায়নে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। অনেকে বিষয়টি বুয়েটে ছাত্রলীগের রাজনীতি প্রবেশ করানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন। এদিকে, কমিটিতে স্থান পাওয়া দুজনের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, বুয়েট শিক্ষার্থী হয়েও এতদিন তারা ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। এটি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। এ ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়া বুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সবধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কর্তৃপক্ষ
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। এ ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়া বুয়েট শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সবধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কর্তৃপক্ষ।
ওই বছরের ১৬ নভেম্বর বুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বুয়েটের কোনো শিক্ষার্থী অনুমোদিত ক্লাব বা সোসাইটি ব্যতীত কোনো রাজনৈতিক দলের বা এর অঙ্গ-সংগঠনের অথবা অন্য কোনো সংগঠনের সদস্য হইতে বা তার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করিতে পারিবে না। শিক্ষার্থীগণকে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে বর্ণিত নিয়মসমূহ যথাযথভাবে পালন করিতে হইবে এবং ইহা অমান্য করিলে অধ্যাদেশে বর্ণিত বিধি মোতাবেক তাহাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।
সম্প্রতি ঘোষিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়েছেন বুয়েটের বর্তমান দুই শিক্ষার্থী। তাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি পুনরায় প্রবেশ করাতে চাচ্ছে ছাত্রলীগ– এমন অভিযোগ উঠেছে। অনেকে বিষয়টি বুয়েটে ছাত্রলীগের রাজনীতি প্রবেশ করানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন। কমিটিতে স্থান পাওয়া দুজনের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, বুয়েট শিক্ষার্থী হয়েও এতদিন তারা ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। এটি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে
আরও পড়ুন : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি, ‘না’-তে মত বেশি
একই বছরের ২ ডিসেম্বর বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা; রাজনৈতিক পদ ধারণ করা বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যুক্ত করা; অন্যদের উপরোক্ত কার্যকলাপে অংশ নিতে বাধ্য করা, প্ররোচিত করা বা অনুপ্রাণিত করলে সতর্কতা, জরিমানা আরোপ, যেকোনো সময়ের জন্য বহিষ্কার কিংবা আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে দুই শিক্ষার্থীর স্থান পাওয়ার ঘটনা ‘ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু, শৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্টের হুমকি’ বলে মনে করছেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা ওই দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পেয়েছেন নিয়মিত দুজন শিক্ষার্থী। যা সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। সামগ্রিকভাবে এ ঘটনায় পুনরায় ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি আবির্ভাবের আশঙ্কা রয়েছে। পদধারী শিক্ষার্থীরা অন্যদেরও ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
তাদের শাস্তি দাবি করে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বুয়েটের সব শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে রাব্বি ও পান্থকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা ভঙ্গ এবং শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগে ডিসিপ্লিনারি কমিটি কর্তৃক তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। এমন কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো শিক্ষার্থী যেন ঘটাতে না পারে সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বুয়েট শিক্ষার্থী বলেন, ছাত্রলীগের কমিটিতে বুয়েট শিক্ষার্থীদের পদ দেওয়ার মানে হচ্ছে তারা আবারও এখানে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। কাজটি করতে গিয়ে তারা ধীরে ধীরে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। এটিও তার একটি অংশ।
তবে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পাওয়া বুয়েটের দুই শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দাবি, ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন না তারা। ব্যক্তিগতভাবে তাদের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে বলে মনে করেন ছাত্রলীগ নেতারা।
তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদকের পদ পাওয়া হাসিন আজফার পান্থ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বুয়েটে আমি কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করছি না এবং করবও না। এ ধরনের কোনো চিন্তাও আমার নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতি করে কেন্দ্রে পদ পেয়েছি। এটা আমার অধিকার। তাছাড়া কিছুদিন পর বুয়েটে আমার ছাত্রত্বও থাকবে না। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে আমি ভুল করেছি, তাহলে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে, আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতি করে, পদ পেয়ে কোনো অন্যায় করিনি।’
এ বিষয়ে জানতে কার্যনির্বাহী সদস্য পদ পাওয়া ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বিকে ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে কল কেটে দেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ‘বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের প্রতি আমাদের সম্মান রয়েছে। সেটি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের ছাত্রনেতার নামের পাশে ব্যবহার করা বুয়েটের নাম কেটে তার নিজের এলাকার নাম দেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, বুয়েটের অভ্যন্তরে রাজনীতি নিষিদ্ধ। কিন্তু বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী অন্য কোথাও গিয়ে রাজনীতি করতে পারবেন না, সেটা হওয়া উচিত নয়। অন্য কোথাও গিয়ে তিনি রাজনীতি করতেই পারেন, এটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এটা নিয়ে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বুয়েট কর্তৃপক্ষের যে সিদ্ধান্ত সে সিদ্ধান্তকে আমরা সমর্থন করি। বুয়েটের যে দুজন শিক্ষার্থীকে আমরা কমিটিতে পদায়ন করেছি, তারা দেশব্যাপী পালিত কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন। পাশাপাশি বুয়েটের অভ্যন্তরে যে সিদ্ধান্ত রয়েছে সেটির প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। বুয়েটের অভ্যন্তরে নয়, বরং তারা যেন দেশব্যাপী মেধাভিত্তিক, দক্ষতাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারেন সেজন্য তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
এদিকে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যাম্পাসে যেকোনো ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে, কেউ ব্যক্তিগতভাবে ক্যাম্পাসের বাইরে রাজনীতি করলে সেখানে বাধা দিতে পারেন না। যদিও তাদের এ বক্তব্য প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ বিষয়ে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেউ কার্যক্রম পরিচালনা করলে আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে, ক্যাম্পাসের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে কেউ রাজনীতি করলে তাকে তো আমরা বাধা দিতে পারি না। যে দুজন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ পেয়েছেন, তাদের বলা হয়েছে ক্যাম্পাসে এর প্রভাব যেন না পড়ে। আমরা সতর্ক অবস্থানে থাকব।’
এইচআর/এসএসএইচ/