‘ঢাবিতে পড়ার পুরো কৃতিত্ব আমার মায়ের’
ছোটবেলায় টাকার অভাবে শান্তনা রানী সরকারের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও তিনি আজ পড়ছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। এছাড়াও একই বছর ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আর্থিক অনটনে পড়াশোনা বন্ধ হতে যাওয়া শান্তনা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পেয়েছিলেন বৃত্তি। এ ছাড়াও সাতগাঁও এম.বি.পি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে অংশ নিয়ে জিপিএ ৪.৯৫ এবং শহীদ স্মৃতি মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসিতে পেয়েছিলেন জিপিএ-৫.০০।
আর নিজের এসব অর্জনের পুরো কৃতিত্ব মাকে দিচ্ছেন শান্তনা রানী সরকার। তার ভাষ্য, আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে তখন আর্থিক অনটনের কারণে বাবা আমার এবং আমার ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। কিন্তু মা চাননি আমার পড়াশোনা বন্ধ হোক। আমার খরচ জোগাতে মা মাঠে কাজ করেছেন, হাওরে কাজ করেছেন। আর এজন্য তিনি মানুষের কাছ থেকে অনেক কটু কথাও শুনেছেন। আজ যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, এর পুরো কৃতিত্ব আমার মায়ের।
রোববার (৮ মে) মা দিবস উপলক্ষে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে মায়ের সংগ্রামী অবদানের কথা তুলে ধরেন ঢাবির এই শিক্ষার্থী। শান্তনার বাড়ি নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার সাতগাঁও গ্রামে।
মায়ের সংগ্রামের কথা তুলে ধরে শান্তনা বলেন, আমি পড়াশোনায় ভালো ছিলাম বলে আমার কোচিংয়ের শিক্ষক আমাকে বিনা বেতনে পড়ানোর আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেজন্য আমার পড়া আর বন্ধ হয়নি। কিন্তু আমার খাতা-কলম, অন্যান্য খরচের জন্যও তখন টাকা ছিল না। সে টাকা জোগাড় করতে মা সিলেটের জাফলংয়ে বালুর কাজ করেছেন।
তিনি বলেন, প্রতিবছর শীত মৌসুমে আমাকে রেখে কাজ করতে যেতেন মা আর বাবা। এভাবেই চলতে লাগল কিন্তু হঠাৎ বাবা প্যারালাইসিস হয়ে যান। কোন কাজ করতে পারতেন না। তখন মা-ই সবকিছু সামলে নেন। হাওরের কাজের সঙ্গে বাড়ির কাজ সব কাজ মা করতেন। আর এ জন্য মাকে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে হাজার রকমের কথা শুনতে হতো। কেন আমাকে পড়াচ্ছেন, আমি তো মেয়ে, পড়াশোনা করে কি করব, বিয়ে দিলে তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাব, খেতে পায় না আবার মেয়েকে পড়াচ্ছে-এমন হাজারটা কথার উত্তরে মা বলত আমার কাছে ছেলে মেয়ে দুজনই সমান। ছেলেকে পড়াতে পারিনি তো কি হয়েছে মেয়েকে যত কষ্টই হোক পড়াব।
মায়ের অবদানের কথা উল্লেখ করে শান্তনা আরও বলেন, আমাদের পাড়ায় যে কয়েকটা পরিবার ছিল তারা সবাই, মেয়ে একটু বড় হলেই রান্নাবান্নার কাজ করতে দিতো নয়তো গার্মেন্টসে পাঠাত। আমার মা আমাকে কখনো কোন কাজে দেননি, নিজে সব কাজ করতেন, আমার যত্ন নিতেন, আমার কখন কী লাগবে সবকিছুর খেয়াল রাখতেন। আমার মা পড়াশোনা জানে না। কিন্তু আমি যখন পড়ার টেবিল থেকে উঠতাম তখন অবশ্যই জিজ্ঞেস করতেন আমার পড়া শেষ হয়েছে কি না। আমি যখন পড়তাম মা আমার টেবিলের পাশে বসে থাকতেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পূরণে মায়ের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সব বন্ধুরা যখন এডমিশন প্রস্তুতি নিতে এখানে সেখানে যাচ্ছে আমি তখনো বাড়িতে। কারণ কোচিং করার মতো টাকা আমাদের নেই। শেষ পর্যন্ত মাকে বললাম আমারও ইচ্ছে কোচিং করার। আমিও ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এডমিশন পরীক্ষা দিতে চাই। আমারও খুব ইচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তখন মা-ই আমাকে শক্তি ও সাহস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন তোর যত টাকা লাগে দিব। সঙ্গে এটাও বলেছিলো যদি তুই কোথাও চান্স না পাস ভাববো টাকাগুলো আমি হারিয়ে ফেলেছি। সেদিন গোপনে অনেক কেঁদেছিলাম। ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় টাকাগুলো মা হারাননি।
তিনি বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ঢাবির ‘খ’ ইউনিটে ৮৫০তম হই। আর জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও চান্স পাই। আমার মায়ের এই অবদানের জন্যই আমি আজ এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আমার অনুপ্রেরণা আমার মা। এখনও তিনি আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন।
এইচআর/আইএসএইচ