নিরাপত্তাকর্মীর পক্ষে অনড় কর্তৃপক্ষ, ইইউতে মামলার হুমকি যাত্রীর
বিমানবন্দরে নিরাপত্তাকর্মীর হাতে নরওয়ের নাগরিক সাঈদ উদ্দিনের হেনস্তার ঘটনায় তদন্ত চলছে। তবে নজিরবিহীন এ হেনস্তার পরও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) মৌখিকভাবে ঘটনার দোষ চাপাচ্ছেন ওই নাগরিকের ওপর।
এদিকে দেশে বিচার না পেলে সাঈদ উদ্দিনের বাবা গিয়াস উদ্দিন ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘ইতোমধ্যে নরওয়ে দূতাবাসের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। দূতাবাসের উকিলের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমরা এ ঘটনার শেষ দেখতে চাই। সুষ্ঠু বিচার না পেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মামলা করা হবে।’
তিনি বলেন, বাবার সামনে ছেলেকে রক্তাক্ত হতে দেখা, এটা আমার জন্য অনেক কষ্টের। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।
অন্যদিকে সিসিটিভি ফুটেজ ও একাধিক ভিডিও ফুটেজে যাত্রীর স্বজনদের মারধর, দুর্ব্যবহারের পুরো বিষয়টি দেখা গেলেও বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের পক্ষ নিয়ে যাত্রীকে এককভাবে দোষী সাব্যস্ত করে কথা বলছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেবিচক।
ঘটনার বিষয়ে রোববার বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একজন ইউনিফর্মড ডিউটি পারসনের গায়ে হাত দেওয়া একটি ফৌজদারি অপরাধ। তারপরও যাত্রীসেবাকে প্রথম অগ্রাধিকার ধরে আমরা ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে সুষ্ঠু সমাধান করে দিয়েছি।’
এ বিষয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য না দিলেও বিবৃতি দিয়েছে, যা সম্পূর্ণ ‘একপেশে’। বিবৃতির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘বিমানবন্দরে যাত্রী কর্তৃক কর্তব্যরত নিরাপত্তা সদস্যকে শারীরিক আঘাত করা প্রসঙ্গে।’
বিবৃতিতে দুইজন যাত্রীকে ‘সম্মানিত যাত্রী’ উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে বিনা উসকানিতে মারধরের অভিযোগ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ‘দুইজন যাত্রী বিমানবন্দরের একজন নিরাপত্তা সদস্যকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রাথমিক তদন্ত মোতাবেক জানা যায়, পাঁচজন যাত্রীর একটি দল বিমানবন্দরের কার্যক্রম শেষ করে কেনপি-২ এলাকা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাদের মধ্যে একজন ট্রলিসহ কেনপি-২ এর গেটের ঠিক সম্মুখভাগে অবস্থান করলে ওই গেটে সব আগমনী যাত্রীর জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ওই সময় যাত্রীদের চাপ বেশি থাকায় কর্তব্যরত একজন নিরাপত্তাকর্মী বিনীতভাবে যাত্রীকে কিছুটা সরে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করলে তিনি তাতে কর্ণপাত না করে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে ওই নিরাপত্তাকর্মী পুনরায় ওই যাত্রীকে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে গেলে তিনি প্রচন্ড রাগান্বিত হয়ে পড়েন এবং অকথ্য ও অশ্রাব্য ভাষায় ওই নিরাপত্তাকর্মীকে গালিগালাজ করতে থাকেন। এসময় ওই স্থানে নিয়োজিত আরও একজন নিরাপত্তাকর্মী উল্লিখিত যাত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা করলে একপর্যায়ে উল্লিখিত যাত্রীর পুত্র (একই ফ্লাইটের যাত্রী, যিনি পেছনে অবস্থান করছিলেন) ঘটনাস্থলে এসে বিমানবাহিনীর ওই নিরাপত্তাকর্মীকে শারীরিকভাবে আঘাত ও লাঞ্ছিত করেন। যাত্রীরা ওই নিরাপত্তাকর্মীকে কিলঘুষি মারা শুরু করলে তাদের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি হয় এবং ওই নিরাপত্তাকর্মী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ওই জায়গায় নিয়োজিত আনসার এবং এভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা এগিয়ে এলে ওই নিরাপত্তাকর্মীদের উল্লিখিত দুজন যাত্রীর হাত থেকে মুক্ত করা হয়।’
আরও পড়ুন
তবে অভিযুক্ত যাত্রীদের একজন গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমার দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় একজন নিরাপত্তাকর্মী (এভসেক সদস্য) আমাকে বলে ‘ওই মিয়া এখানে দাঁড়িয়েছেন কেন? সরে দাঁড়ান।’ তখন আমি তাকে বলি, আমরা শুনেছি বিমানবন্দর আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে, এ কথাটা আপনি ভালো করে বললেই তো হতো। লোকজনও প্রবাসীদের ‘স্যার’ ডাকে, আপনি এরকম আচরণ করছেন কেন? এ কথা বলার পর সে আমাকে ধাক্কা দেয়। এ অবস্থায় আমার ছেলে সাইদ চলে আসে। এসময় আমার গায়ে হাত দেওয়া দেখে সে রাগান্বিত হয়। তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও ধাক্কাধাক্কি হয়। পরে তারা সবাই মিলে আমার সামনেই আমার ছেলেকে ধরে কিলঘুষি মেরে রক্তাক্ত করে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমানবন্দরে কোনো যাত্রীকে শারীরিক নির্যাতন (ফিজিক্যালি অ্যাসল্ট) কল্পনাও করা যায় না। কোনো পরিস্থিতিতেই যাত্রীকে মারধর করা গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি কেউ যদি প্লেনের ভেতরে উচ্ছৃঙ্খলা বা অযাচিত আচরণ করেন সর্বোচ্চ তার হাত বেঁধে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দরে যাত্রী হ্যান্ডেলিংয়ের যে সমস্ত আন্তর্জাতিক নির্দেশনাবলি রয়েছে সেখানে কোথাও যাত্রীকে মারধর সমর্থন করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশনের নির্দেশনায় ‘যাত্রীকে মারধরের’ কথা নেই
এদিকে সেদিনের মারধরের ঘটনার পর যাত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯ ধারায় মামলা দিয়ে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন বিমানবন্দরের মোবাইল কোর্ট। ওই যাত্রীকে জরিমানা করা হয়েছে ১৮৬০ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯ ধারাতে। যেখানে সরকারি কর্মচারীর প্রতি ক্ষতিসাধনের হুমকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ অপরাধের সাজা দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয়ই হতে পারে।
তবে বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশনের (আইকাও) অ্যানেক্স-১৭তে কোথাও মারধরের কথা বলা হয়নি। এর সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, কোনো যাত্রী নিরাপত্তা হুমকি বা তার মধ্যে অসদাচরণ দেখলে প্রথমে তাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এরপর তাকে মৌখিকভাবে শান্ত করার চেষ্টা করতে হবে। তিনি শান্ত না হলে পরবর্তী ধাপে তাকে মৌখিকভাবে হুমকি দিতে হবে। এরপর তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনের ব্যবস্থা নেওয়া অথবা জরিমানা করতে হবে।
যাত্রীর মুখে মারধরের নির্মম বর্ণনা শুনেছে তদন্ত কমিটি
এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে শনিবার (১১ জানুয়ারি) বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে একটি উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুজন হলেন শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা শনিবারই ফেনীর সোনাগাজীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেন। এদিন বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার পর্যন্ত সোনাগাজীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন ওই যাত্রীরা। তারা যাত্রীদের মুখে পুরো ঘটনা শোনেন। তারাও যাত্রীদের নানা প্রশ্ন করেন। যাত্রীরা সেগুলোর উত্তর দেন।
যাত্রীর শারীরিক-মানসিক আঘাতের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে : সিবিআই ইউকে
নরওয়ে প্রবাসীকে মারধর ও হেনস্তার ঘটনায় যাত্রীকে শারীরিক-মানসিক আঘাতের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন লন্ডন কানেক্ট বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল (সিবিআই) ইউকে। সংগঠনটির পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের এ ঘটনা প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। সিবিআই ইউকে বাংলাদেশ সরকারকে এ ঘটনার একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করার আহ্বান জানাচ্ছে। বিবৃতিতে এ ঘটনায় সরকারকে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া এবং ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারকে শারীরিক-মানসিক আঘাতের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও আহ্বান জানায়।
সিবিআই ইউকে বলছে, কমিটিতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিএএ) প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এছাড়াও কমিটিতে প্রবাসী বাংলাদেশি (এনআরবি) সম্প্রদায়ের অন্তত দুই সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তারা প্রবাসীদের পক্ষে সিবিআই সভাপতি আবু আহমেদ (খিজির) এবং মহাসচিব নাসিম চৌধুরীকে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন। সিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনটি যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছে।
বিবৃতিতে সিবিআই ইউকে উল্লেখ করেছে, নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশিরা (এনআরবি) দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে ১৫ মিলিয়নেরও বেশি বাংলাদেশি বিদেশে বসবাস করছে। রেমিট্যান্স অনেক পরিবারের জন্য একটি লাইফলাইন এবং দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে। সিবিআই ইউকে মনে করে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো ঘটনা আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। প্রবাসীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা কেবল বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি শক্তিশালী করে না, বরং প্রবাসীদের অব্যাহত অর্থনৈতিক অবদানকেও উৎসাহিত করে।
এআর/এসএসএইচ