আনফিট ক্রুদের ‘ফিট’ বলে ফ্লাইটে পাঠাচ্ছে বিমান!
দেখতে আনফিট (অনুপযুক্ত), ওজন ও উচ্চতা তা-ই প্রমাণ করে। তবুও তাদের ক্রু (উড়োজাহাজ পরিচালনায় নিযুক্ত কর্মী) হিসেবে ফ্লাইটে পাঠাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যাত্রীদের যেমন নিরাপত্তাহীনতায় ফেলা হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নির্দেশনাও ভাঙা হচ্ছে— অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে বর্তমানে ৬০০ জন ক্রু রয়েছে। একজন ক্রু’র উচ্চতা ও ওজন সূচক (বিএমআই) দেখে ‘ফিট’ (উপযুক্ত) বলে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। ওজন সূচক (বিএমআই) বলতে ‘বডি ম্যাস ইনডেক্স’ বা শরীরের আদর্শ ওজন নির্ণয়ের একটি গাণিতিক পদ্ধতি বোঝায়। দেহের ওজন ও উচ্চতার ভিত্তিতে এ পদ্ধতিতে আদর্শ ওজন নির্ণয় করা হয়। উচ্চতা অনুযায়ী কারও ওজন স্বাভাবিক আছে কি না— তা বিএমআই মানের মাধ্যমে জানা যায়।
ফিট ঘোষণার ক্ষেত্রে শুধু বিএমআই নয়, চোখের দেখায়ও ‘সাবলীল’ হতে হয়। তবে, এসব নিয়ম না মেনে ‘ফিট’ ঘোষণা করা হচ্ছে ক্রুদের। অভিযোগ উঠেছে, একক কর্তৃত্বে অনৈতিক এ কাজ করছেন বিমানের চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) ডা. তাসলিমা আখতার!
আরও পড়ুন >> লিজ দুর্নীতি : বিমানের দুই জিএমসহ পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদ
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্রে জানা যায়, চেহারা দেখে এবং বিমানে প্রভাব বিস্তার করে এমন অনেক ক্রু’র ওজন বেশি থাকার পরও ফ্লাইট পরিচালনা করতে দেওয়া হয়। অপরদিকে, ঠুনকো কারণে ‘আনফিট’ ঘোষণা করা হয় ‘ফিট’ ক্রুদের। বিমানের ক্রুদের মেডিকেল পরীক্ষা ও ফিট সনদ দেওয়ার কাজটি করে বিমান মেডিকেল সেন্টার। এ সেন্টারে পাঁচজন চিকিৎসক রয়েছেন। তবে, এক্ষেত্রে চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) ডা. তাসলিমা আখতারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। অনেক ক্রু তার বিষয়ে ‘স্বজনপ্রীতি’ করে ফিটনেস সনদ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন।
চেহারা দেখে এবং বিমানে প্রভাব বিস্তার করে এমন অনেক ক্রু’র ওজন বেশি থাকার পরও ফ্লাইট পরিচালনা করতে দেওয়া হয়। অপরদিকে, ঠুনকো কারণে ‘আনফিট’ ঘোষণা করা হয় ‘ফিট’ ক্রুদের। বিমানের ক্রুদের মেডিকেল পরীক্ষা ও ফিট সনদ দেওয়ার কাজটি করে বিমান মেডিকেল সেন্টার। এ সেন্টারে পাঁচজন চিকিৎসক রয়েছেন। তবে, এক্ষেত্রে চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) ডা. তাসলিমা আখতারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। অনেক ক্রু তার বিষয়ে ‘স্বজনপ্রীতি’ করে ফিটনেস সনদ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন
বিমান মেডিকেল সেন্টারের অপর চার চিকিৎসক হচ্ছেন- খাইরুন্নাহার, মো. আব্দুর রহমান, শাহনাজ আক্তার লিজা ও মোহাম্মাদ মাসুদুর রহমান।
নাহিদ হাসান (ছদ্মনাম) নামের বিমানের এক কেবিন ক্রু ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমানের ক্রুদের চার মাস পরপর মেডিকেল সেন্টারে রিপোর্টিং করতে হয়। বিএমআই অনুযায়ী উচ্চতা ও ওজনের সমন্বয় থাকলে তাকে ‘ফিট’ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। নিয়োগের সময় আমাদের বছরে দুবার অর্থাৎ ছয় মাসে একবার ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য বিমানের মেডিকেল সেন্টারে রিপোর্ট করতে বলা হয়। তবে, বর্তমান সিএমও হয়তো ‘গিফট পাওয়ার আশায়’ চার মাসে একবার রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক করেছেন!
আরও পড়ুন >> ‘স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে বিমানে অদক্ষ পাইলট নিয়োগ’, তদন্ত চান পাইলটরা
পৃথিবীর সব দেশে জামা-কাপড়ের জন্য শরীরের ওজন থেকে ৫ থেকে ১০ পাউন্ড ছাড় দেওয়া হয়। বিমানে এ ছাড় শুধুমাত্র মুখ দেখে দেওয়া হয়। গত অক্টোবর মাসে অনেক ক্রু-কে বিমান থেকে বাদ দেওয়া হয়। কারণ, তাদের পরনের জামা-কাপড়ের ওজন নির্ধারিত ওজনের চেয়ে ২/১ পাউন্ড বেশি ছিল।
সাকলাইন আহমেদ (ছদ্মনাম) নামের আরেক ক্রু বলেন, এ সার্টিফিকেট দেন বিমানের সিএমও ডা. তাসলিমা। অনেক ক্রু’র অক্টোবরের ১ তারিখে মেডিকেল রিপোর্টিং ছিল। তবে, ডা. তাসলিমা ৭/৮ দিন ছিলেন না। তাই তারা অক্টোবরের ১০ তারিখের পর মেডিকেল করেন। ওজন কয়েক কেজি বেশি থাকায় তাদের ৩০ অক্টোবর যেতে বলা হয়।
“তিনি অনেক ক্রু ও কর্মচারীর মেডিকেল রিপোর্টিং বই নিজের কাছে আটকে রাখেন। অথচ সেগুলো থাকার কথা রিপোর্টিং রুমে। তিনি (সিএমও ডা. তাসলিমা) অফিসে না থাকলে ক্রু ও কর্মচারীরা মেডিকেল রিপোর্ট করতে পারেন না। ফলে তারা ফ্লাইটে যেতে পারেন না। অনুপস্থিত দেখিয়ে বেতন থেকে টাকা কাটা হয়। অথচ বিএমআই থেকে অনেক বেশি ওজনের ক্রু’রা ডা. তাসলিমাকে ‘গিফট’ দিয়ে ‘ফিট’ সার্টিফিকেট নিচ্ছেন। এমনকি ভিআইপি ফ্লাইটেও ডিউটি করছেন তারা!”
বিএমআই’র সঙ্গে ওজনের সমন্বয় নেই কিন্তু ফিট সনদ পেয়েছেন— এমন কয়েকজনের তালিকা তৈরি করেছে বিমানের একটি বিভাগ। অতিরিক্ত ওজন (ওভারওয়েট) নিয়ে বিমানে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যে চিফ পার্সাররা হচ্ছেন- মুক্তা, দুলালি, খুকু, মাসুমা, মেঘলা, নিরা, নিশি ও রোকসানা। ফ্লাইট পার্সারদের মধ্যে আছেন- আজমি, সাঈদা, কবিতা, মনির, মুন্নি, রুবা ও শিল্পী। জুনিয়র পার্সার হলেন- তাহরিমা, সানজানা, নতুন ও তন্নী। ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেসদের মধ্যে আছেন- দিয়া ভেনাস, মেনকা, শান্তা, পৃথা, অন্যমা, অর্পা ও ফারহানা।
উপরের তালিকার কয়েকজন ‘ফিট’ সনদ নিয়ে সম্প্রতি বিভাগীয় পদোন্নতি পেয়েছেন। বাকিরা শিগগিরই পাবেন বলেও শোনা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন >> ‘ইচ্ছা করেই’ প্রবাসীদের লাগেজ ফেলে আসা, কাটা-চুরি হরহামেশা
এ প্রসঙ্গে বিমান মেডিকেল সেন্টারের সিএমও ডা. তাসলিমা আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যারা ওভারওয়েট, তারা গ্রাউন্ডেড থাকেন (ফ্লাইট পরিচালনা থেকে সাময়িকভাবে বিরত রাখা হয়)। নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের টেস্ট করানো হয়। অনেক সময় ক্রু-শর্টেজ থাকলে ম্যানেজমেন্টের অনুমতি নিয়ে তাদের ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ‘ফিট’ ধরা হয়। আবার যখন ওভারওয়েট হয়, তখন গ্রাউন্ডেড করে দেওয়া হয়। বিষয়টা এভাবেই হয়।’
শুধু ক্রু নয়, বর্তমানে বিমানের দুই পাইলট অতিরিক্ত ওজন (ওবিজ) থাকা সত্ত্বেও ফিট হিসেবে ফ্লাইট পরিচালনা করছেন। এভিয়েশনের ভাষায়, কোনো পাইলটের ওজন যদি বিএমআই মান থেকে ৩০ শতাংশ বা তারও বেশি হয় তাকে ‘ওবিজ’ বলে। বিমানের ক্যাপ্টেন ইসমাইল ও ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক ওবিজ ক্যাটাগরিতে পড়েন। বেবিচকের নির্দেশনা থাকার পরও তাদের হৃদরোগ পরীক্ষা বা হেলথ চেক-আপ ছাড়াই ফ্লাইট পরিচালনা করতে দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান মেডিকেল সেন্টারের সিএমও ডা. তাসলিমা আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ক্যাপ্টেন হচ্ছেন পাইলট। পাইলটদের সার্টিফিকেশনটা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) থেকে হয়। আমি তাদের মেডিকেল অ্যাপ্রুভাল দিই না।’
তবে, বেবিচক চেয়ারম্যান বলেন ভিন্ন কথা। এয়ার ভাইস মার্শাল এম. মফিদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নিজ নিজ এয়ারলাইন্স পাইলটদের প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। প্রাথমিক রিপোর্ট ইতিবাচক হলে তারা লাইসেন্স নেওয়ার জন্য বেবিচকের কাছে পাঠায়। বেবিচকের কিছু মেডিকেল রিকয়ারমেন্টস আছে। তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। তারা যদি আনফিট হন তাহলে ফিট হতে সময় দেওয়া হয়। এটা একটা রুটিন প্রসেস।’
২০১৯ সালে অতিরিক্ত ওজনের জন্য বিমানের ৩০ কেবিন ক্রু-কে গ্রাউন্ডেড করা হয়। তৎকালীন বিমানের এমডি মোকাব্বির হোসেন তাদের গ্রাউন্ডেড করেন। তাদের মধ্যে সবাই নারী ছিলেন। তিনজন বাদে বাকিদের বয়স ছিল ৩৫ বছরের নিচে।
ফিটনেস সনদে ‘হেরফের’, হতাশায় বিমান ছাড়েন অনেক ক্রু
২০১৭-১৮ সালের দিকে ক্রুদের ফিট-আনফিট সংক্রান্ত মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে অনিয়ম দেখা দেয়। ওই অনিয়ম প্রসঙ্গে রিজভি আহমেদ কিংশুক (ছদ্মনাম) নামের এক ক্রু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ২০১৪ সালে কেবিন ক্রু হিসেবে নিয়োগ পাই। বিএমআই মানদণ্ড অনুযায়ী আমাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের দিকে বিএমআই প্রথা বাতিল করে তিনি (সিএমও ডা. তাসলিমা) ‘রিস্ট ফ্রেম মেজারমেন্ট’ অর্থাৎ হাতের কব্জির আকার মেপে আদর্শ ওজন মান নির্ধারণের প্রথা চালু করেন। এশিয়া মহাদেশসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর এয়ারলাইন্স বিএমআই-কে আদর্শ মানলেও বিমানে তখন মানা হয়নি। ওই সময় পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে ১৫-১৭ জন ক্রু ‘আনফিট’ কলঙ্ক নিয়ে বিমান ছাড়েন।
আরও পড়ুন >> ৩০৯২ কোটি টাকা দেনা রেখে ৩২৮ কোটির রেকর্ড লাভ দেখাল বিমান!
বিমানের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, রিস্ট ফ্রেম মেজারমেন্টের কারণে অনেককে হঠাৎ ওজন কমানোর বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়। দ্রুত ওজন কমাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। বিমানের অন্যতম সেরা চার ফ্লাইট স্টুয়ার্ড/স্টুয়ার্ডেস ওই সময় চাকরি ছেড়ে দেন। তারা হলেন- রিয়াসাত, অ্যারাবিন, আন-নূর ও সাজিদ। ২০১৭ সালে রিয়াসাত বিমান ছেড়ে যুক্তরাজ্য, অ্যারাবিন যুক্তরাষ্ট্র, আন-নূর অস্ট্রেলিয়া ও সাজিদ কানাডায় গিয়ে অন্য পেশায় যুক্ত হন।
একের পর এক সহকর্মীর চাকরি ছাড়ার পর আওয়াজ তোলেন ক্রুরা। ওই সময় ফ্লাইট স্টুয়ার্ড/স্টুয়ার্ডেস সবাই একজোট হয়ে বিষয়টি বিমানের কেবিন ক্রু ইউনিয়ন-কে জানায়। কেবিন ক্রু ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিএমআই প্রথা চালুর জন্য বিমানের তৎকালীন পরিচালক (প্রশাসন) রাজপতি সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিএমআই প্রথা ফের চালু করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, বর্তমানে বিএমআই প্রথার তোয়াক্কা করছেন না সংশ্লিষ্টরা। বিমান মেডিকেল সেন্টার নিয়েও আসছে নানা অভিযোগ।
‘বেনামি’ মেশিন দিয়ে মাপা হয় ওজন
বিমান মেডিকেল সেন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্রুদের ফিটনেস দেখার জন্য বাজার থেকে কেনা ব্র্যান্ডহীন মেশিন ব্যবহার হচ্ছে। গত এক বছরে ২/৩ বার বদল হয়েছে এ মেশিন। কখনও ম্যানুয়াল আবার কখনও ডিজিটাল মেশিন দিয়ে ওজন মাপা হচ্ছে। এগুলোর দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডহীন মেশিনগুলো আদৌ সঠিক ওজন দিচ্ছে কি না, এ বিষয়ে পরিষ্কার উত্তর দিতে পারেননি বিমানের কেউ। বিমান মেডিকেল সেন্টারের প্রতিটি চিকিৎসকের কক্ষে এ মেশিন ব্যবহার হচ্ছে।
এছাড়া বিমান থেকে বলা হয়েছিল, কর্মীদের সব ধরনের ডায়াগনস্টিক টেস্ট ও সাধারণ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে। কিন্তু তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।
পাইলটদের হৃদরোগ শনাক্তে নেই কার্যকর ব্যবস্থা
২০২১ সালের আগস্টে ফ্লাইট পরিচালনার সময় হৃদরোগে (হার্ট অ্যাটাক) আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইয়ুম। তার মৃত্যুর পর পাইলটদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তদন্তে নামে বেবিচক। দীর্ঘ তদন্ত শেষে বিমানের পাইলট ও ক্রুদের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর ইসিজি ও ব্লাড প্রেশার পরীক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনার পর কিছুদিন বিমান মেডিকেল সেন্টারে পাইলট-ক্রুদের ইসিজি ও ব্লাড প্রেশার মাপার ব্যবস্থা করা হয়। অভিযোগ আছে, যাদের ব্লাড প্রেশার বেশি তাদের ডা. তাসলিমা একগাদা টেস্ট দিয়ে পাঠাতেন উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে, এ বছরের শুরু থেকে পাইলটদের হৃদরোগ শনাক্তে আর পরীক্ষা দেয়নি বিমান মেডিকেল সেন্টার।
আরও পড়ুন >> বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্সের ‘মনোপলি’, ঠকছেন হজযাত্রীরা!
নাম প্রকাশ না করে বিমানের কয়েকজন ক্রু অভিযোগ করেন, যারা করোনার তিন ডোজ টিকা নিয়েছেন এবং দুবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন— এমন কেউ যদি ডা. তাসলিমার কাছে যান তাহলে তিনি একই কায়দায় কোভিড টেস্ট, সিবিসি, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া ও ডেঙ্গুসহ একগাদা টেস্ট দেন। এগুলো বাইরে থেকে করতে হচ্ছে।
অথচ, বিমানের নির্দেশনা ছিল মেডিকেল সেন্টারে সব ধরনের ডায়াগনস্টিক টেস্টের ব্যবস্থা থাকবে। ক্রুদের যাতে পরীক্ষা করতে বাইরের হাসপাতালে যেতে না হয়। বিমান মেডিকেল সেন্টারে দ্রুত ‘ওয়ান স্টপ’ ব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবি জানান সবাই।
এ বিষয়ে ডা. তাসলিমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে কম-বেশি সব ডায়াগনোসিসের সুবিধা আছে। তবে, ইসিজিসহ কয়েকটা টেস্ট বাইরে থেকে করতে হচ্ছে। আমরা এন্ডোর্স করি, তারা বাইরে থেকে (ডায়াগনস্টিক সেন্টার) করে নিয়ে আসেন। এছাড়া অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা আমাদের আছে।
বিমার সুবিধা নেই বিমানে
বিমান বাংলাদেশ সূত্রে জানা যায়, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে বিমানের একটি গ্রুপ স্বাস্থ্যবিমার চুক্তি রয়েছে। কোনো কর্মী অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিলে অথবা হাসপাতালে ভর্তি হলে বিমাদাবি অনুযায়ী খরচ বহনের কথা ডেল্টা লাইফের। তবে, বিমানের কেউ-ই এখন পর্যন্ত এ সেবা পাননি। অভিযোগ আছে, বিমানের সিএমও তাসলিমা আখতার কর্মচারীদের এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা দেন না। এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেন তিনি।
বিমানের হিসাবরক্ষণ বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মী নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমানের প্রতিটি স্টাফের বেতন থেকে মাসে ৩১২ টাকা করে প্রায় ২৫ লাখ টাকার বিমার প্রিমিয়াম কাটা হচ্ছে। তবে, এখন পর্যন্ত বিমার কোনো সেবা বা লাভ পাননি বিমানের স্টাফরা। আমরা জানি না, আদৌ বিমা কোম্পানিটি থেকে কোনো সুবিধা পাব কি না?
আরও পড়ুন >> বিমানের জন্য যারা ‘ক্যান্সার’ তাদের চাকরিচ্যুত করাই উত্তম
বিমানের ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমাদের জানানো হয়েছে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বেশ কয়েকটি ক্লিনিক ও হাসপাতালে বিমানের কর্মীরা ২৫ শতাংশ ছাড়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে, বিমার সেবা পাওয়ার বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি।
বিমাদাবির বিষয়ে সিএমও তাসলিমা আখতার কোনো অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন কি না— সে বিষয়ে অধিকতর তদন্ত চেয়েছেন বিমানের কর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করে বিমানের অডিট বিভাগের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিএমও তাসলিমা আখতার একজন প্লেন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক। একজন প্লেন এমবিবিএস চিকিৎসকের সিএমও হওয়া নিয়ে কর্মীরা অনেকবার তদন্তের দাবি তুলেছেন। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের মতামত চাইব। এছাড়া বিমান মেডিকেল সেন্টারে বছরে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ বরাদ্দের পরও কর্মীদের নানা টেস্টের জন্য বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হচ্ছে। বরাদ্দের এ টাকা দিয়ে সিএমও কী করছেন— এ বিষয়ে ইতোমধ্যে অডিট করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অডিটের সিদ্ধান্তটি বর্তমানে এমডির অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি স্বাক্ষর করলে অডিট শুরু হবে।
ফিট-আনফিট, সব দায়িত্ব মেডিকেল সেন্টারের : এমডি
আনফিট ক্রু-পাইলটদের ‘ফিট’ সার্টিফিকেট দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি ও সিইও মো. যাহিদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। এটা সম্পূর্ণ মেডিকেলের বিষয়। আপনি বিমান মেডিকেল সেন্টারের চিফের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তারা বিষয়গুলো ডিল করেন।’
বিমানের মেডিকেল সেন্টার স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য প্রতি বছর বরাদ্দ থাকলেও কেন এখনও বাইরে গিয়ে টেস্ট করতে হচ্ছে— জানতে চাইলে এমডি বলেন, ‘আপনি চিফ মেডিকেল অফিসারের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। মেডিকেল সেন্টারে যখন যা লাগে আমরা তা দিচ্ছি। এটা কন্টিনুয়াস প্রোসেস। এছাড়া মেডিকেল সেন্টারে ওষুধও দেওয়া থাকে। যদি কারও বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয় সেক্ষেত্রে বিমান সেই ওষুধের টাকা দিয়ে দেয়।’
ক্রুদের ফিট থাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত যাত্রীদের নিরাপত্তা : এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্রুদের ফিট থাকার সঙ্গে যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পৃক্ত। কেবিন ক্রু’রা শুধু খাবার পরিবেশন করেন না। উড়োজাহাজে তাদের অনেক দায়িত্ব থাকে। সাধারণ ইমার্জেন্সি বা মেডিকেল ইমার্জেন্সি— সব কাজ তাদের করতে হয়। কাজগুলো করতে ফিজিক্যাল ফিটনেস অত্যন্ত জরুরি। ক্রু যদি ফিজিক্যালি আনফিট হয় তাহলে আপনি ঠিক মতো সার্ভিসগুলো যাত্রীকে দিতে পারবেন না। খুব কঠোরভাবে এয়ারলাইন্সগুলোকে এটা মেইনটেইন করা উচিত। এতে যেমন যাত্রীদের ঝুঁকি কমবে, বিমানের সেবার মানও বাড়বে।
এআর/এমএআর/