সুন্দরবনে রোমাঞ্চকর ৩৬ ঘণ্টা
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, সুন্দরবনের কোনো একটি নদীতে আপনি বড়শি ফেলে মাছ ধরছেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই আপনার বোটের মাঝির মোবাইল ফোনে একটি কল এসেছে। অপরপ্রান্ত থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বরে বলা হচ্ছে, ‘কি গো জাহাঙ্গীর, এখানে কী করছো?’ জবাবে জাহাঙ্গীর বললেন, ‘মাছ ধরছি’। এরপরে সেই ব্যক্তির প্রশ্ন, ‘তুমি জানো না এটা আমাদের এরিয়া? চলে যাও এখান থেকে।’
শেষ দুই-তিন মিনিটে ফোনকলে কি ঘটলো, সেটা বুঝে ওঠার আগেই মাঝি জাহাঙ্গীর ভাই বলতে শুরু করল- ভাই, আমাদের বোট নিয়ে সামনে আগাতে হবে। এখানে আজকে রাতে থাকা যাবে না।
কেন থাকা যাবে না?
সমস্যা আছে। মাত্র একজন ডাকাত সর্দার ফোন করেছে, সে আমার পরিচিত। ২০১৬ সালে যে কয়টি ডাকাতদল সুন্দরবনে আত্মসমর্পণ করেছিল তাদেরই একজন তিনি। সে সময় তার আত্মসমর্পণের পেছনে আমারও ভূমিকা ছিল। তবে কয়েকদিন ধরেই শুনতে পেরেছি, সেই ডাকাত সরদার নাকি নতুন করে আবারও দল গঠন করে সুন্দরবনে নেমেছে। আজকে তার ফোনকলে পুরোপুরি বিষয়টি নিশ্চিত হলাম।
যিনি আমাদের কথাগুলো বলছিলেন, তিনি যেনতেন কেউ নন। সুন্দরবনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা আত্মিক। প্রায় ৩০ বছর ধরে এই বনের সঙ্গেই বেঁধে আছে তার জীবন।
২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে ৩২টি দস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনা কারোই অজানা নয়। সে বছরের নভেম্বর মাসে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় সকল ডাকাতদলের আত্মসমর্পণের মঞ্চ তৈরি করেছিলেন সাংবাদিক মহসিন উল হাকিম। যার অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন আমাদের বোট মাঝি জাহাঙ্গীর ভাই। যে কারণে সুন্দরবনের একজন জেলে থেকে সাধারণ মানুষও যেমন সাংবাদিক মহসিন উল হাকিমকে চেনেন, ঠিক একই কারণে জাহাঙ্গীরকেও চেনেন।
আমাদের বোট তখন সুন্দরবনের মালঞ্চ নদীতে। বুঝতে পারলাম, ঠিক সেই নদীর আশেপাশে কোথাও অবস্থান করছে দস্যুবাহিনী। তারা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই জাহাঙ্গীর ভাইকে কল করেছে।
খানিকটা কৌতূহল নিয়েই জাহাঙ্গীর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, যেই ডাকাত সরদার কল করেছেন তার নাম কী? তিনি বললেন, ‘সাহেব’। যদিও এটা ওর ডাকনাম নয়। তবে সুন্দরবনের জেলেরা এই নামেই চেনে তাকে। তাহলে ওর আসল নাম কী? মজনু। খুলনায় বাড়ি। মাসখানেক আগেও আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন বলেছিল ওর কিছু পারিবারিক সমস্যার কথা। হয়তো সেই কষ্ট থেকেই আবার পুরোনো সেই অন্ধকার জগতে ফিরেছে।
জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছ থেকে ডাকাত সরদারের গল্প মোটেও অবাক করছিল না। কারণ সেদিন সকালে বোটে ওঠার আগেই আমরা তার সম্পর্কে ভালো ধারণা পেয়েছিলাম।
একটু পেছনে আসা যাক.....
৫ নভেম্বর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন মিলে আমরা সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা দেই। ঠিক তার দুইদিন আগেই সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের তক্কাখালী এলাকায় বনদস্যুদের হাত থেকে জিম্মি দশ জেলেকে উদ্ধার করা হয়।
নাহ, এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়! ২০১৮ সালে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা সুন্দরবনে হঠাৎ জেলে অপহরণের ঘটনা ছিল সবার মাঝে নতুন করে উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টির কারণ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসন থেকে স্থানীয়রা নড়েচড়ে বসে এই ঘটনায়।
এমন এক প্রেক্ষাপটেই ৬ নভেম্বর সকালে আমরা পৌঁছে যাই সাতক্ষীরার শ্যামনগরে মুন্সিগঞ্জ গ্রামে। যেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন স্থানীয় একজন সাংবাদিক। তার হাত ধরেই আমরা পরবর্তী ৩৬ ঘণ্টার পরিকল্পনা সাজিয়ে নেই।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই আমরা একটি বোট ভাড়া নেই, যেটির মালিক ছিলেন জাহাঙ্গীর ভাই। মহসিন উল হাকিমের অসংখ্য ভিডিওতে যার উপস্থিতি দেখেছি। মুন্সিগঞ্জ বাজারে তার সঙ্গে বসে চা খেতে খেতেই বলে ফেললাম, ভাই আপনাকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। তিনি রাজি হলেন। দুইদিনের বাজার করেই আমরা বোটে উঠে গেলাম। গন্তব্য কলাগাছিয়া, এরপর মালঞ্চ নদী। পরিকল্পনা ছিল সন্ধ্যাটা মালঞ্চ নদীতেই বোটে বনের মাঝে কাটিয়ে দেব।
আমাদের বোট চলতে শুরু করল। আমরা ঢাকা থেকে যাওয়া ৪ জন, সঙ্গে সাংবাদিক মাসুম ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই, একজন বাবুর্চি ও লস্কর। মোট ৮ জন। কলাগাছিয়াসহ আরও দুই একটি পর্যটন স্পট ঘুরে, দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলের দিকে চলে গেলাম মালঞ্চ নদীতে। সেখানেই বোটটি নোঙড় করে বড়শি নিয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম সকালে।
ভাটার পানি নামছিল, বড়শিতেও একের পর এক মাছ ধরা দিচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই জাহাঙ্গীর ভাইয়ের মোবাইলে বেজে ওঠে সেই ফোনকল। জানিয়ে দেওয়া হয়, আমাদেরকে এই এলাকা ত্যাগ করতে হবে।
ডাকাত সরদারের ফোনকলের পর আমাদের বোট আবারও সুন্দরবনের খালগুলো দিয়ে চলতে শুরু করল। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। নদী, খালগুলোর বুকে বাতাস বইছে, মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছে হরিনের ডাক, বিভিন্ন পশু-পাখির শব্দ।
আমরা একে অপরের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলাম। একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করছিল! একে তো দস্যুদের ভয়, তার মাঝে রাতের সুন্দরবনের নীস্তবদ্ধতা, চারদিকের অন্ধকার পরিবেশ।
আমাদের যাত্রার শুরুটাই কিন্তু হয়েছিল ডাকাতদের গল্প দিয়ে। ঢাকা থেকে রওনা দেওয়ার পর আমাদের বাস যখন শ্যামনগরে পৌঁছায় তখন ঘড়িতে ঠিক রাত সাড়ে তিনটা। সেখান থেকে একটা অটো কিংবা ভ্যানে যেতে হতো মুন্সিগঞ্জ গ্রামে। যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন মাসুম ভাই।
রাস্তার দূরত্বটাও কম নয়! প্রায় ১৮ কিলোমিটার। একজন অটোরিকশা চালককে পেয়ে গেলাম। ভাড়া নিল ৩০০ টাকা। তারা অটোরিকশায় গ্রামের রাস্তা ধরে গভীর রাতেই আমরা চলছিলাম।
আমরা সুন্দরবনে ঘুরতে এসেছি শুনে, সে খুব স্পষ্টভাবেই বলে দিল- ‘আর যাই করেন, রাতেরবেলা বনের মধ্যে থাকবেন না। সন্ধ্যার আগেই চলে আসবেন। এখন অবশ্য রাতে থাকতেও দিচ্ছে না।’
কেন থাকতে দিচ্ছে না? তখনই তার কাছ থেকে জানতে পারলাম জেলেদের অপহরণের ঘটনা। যেটা মাত্র দুইদিন আগে ঘটেছে।
ওই অটোরিকশা চালক আরও বললেন, ৫ আগস্টে সরকার পতনের পরই সুন্দরবনে ডাকাত, দস্যুদের উৎপাত বাড়ছে। অনেকেই আত্মগোপনে থেকে সুন্দরবনে ডাকাতদলে গিয়ে যোগ দিছে। এখন আর আগের মতো নিরাপত্তা নাই জেলেদের!
খানিকটা হতাশই হয়েছিলাম বটে। আমরা তো পরিকল্পনা করে এসেছি, সুন্দরবনের কোনো গহীন খালে রাতে থাকবো বলে!
সে যাই হোক, ঘটনায় ফেরা যাক। মুন্সিগঞ্জে এসে পৌঁছালাম। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন মাসুম ভাই। তিনি আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
একটু একটু আলো ফুটতেই আমরা বাজারে চলে গেলাম। সেখানে সকালের নাস্তা সেরে ফেললাম। এরপর একটা চায়ের দোকানে বসলাম। মাসুম ভাইয়ের ফোনকল পেয়ে সেখানে একে একে হাজির হলো সোনামনি, জাহাঙ্গীর ভাই, আলম সরদার, শহিদুল।
এর মধ্যে সোনামনির দুই স্বামীই গেছে বাঘের পেটে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় শোনা গেছে তার জীবনের হৃদয়বিদারক, ভয়ংকর সেই গল্প। মহসিন উল হাকিমের অযস্র ভিডিওতে জাহাঙ্গীর ভাইকে দেখেছি, যেমন দেখেছি বেলায়েত সরদারকে। কত কত অভিজ্ঞতা তার জীবনে।
আলম ছিল সুন্দরবনের ডাকাতদের সরদার। যিনি ২০১৬ সালে আত্মসমর্পণ করে বর্তমানে অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বাকি রইল শহিদুল, যে কিনা পরপর দুইবার সুন্দরবনে বাঘের সাথে লড়াই করে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছে।
এদের প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটা গল্প কখনো আমাদের মুষড়ে দিয়েছে, কখনো রোমাঞ্চ ছুঁয়ে গেছে। স্বল্প মুহূর্তের এই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়েই আমরা বোটে উঠেছিলাম। এরপর সেখানেও ডাকাতদলের ঘটনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রোমাঞ্চ, ভয় বাড়িয়ে তুলেছে।
যে কারণেই কি না রবিউল আর ইমতিয়াজ বলে বসলো, সুন্দরবন, রাতের নিস্তব্ধতা, ডাকাতদের নিয়ে এমন রোমাঞ্চকর এক পরিবেশ— আমাদের মাঝে এই মুহূর্তে একজন ডাকাত সরদার থাকলে কিন্তু খারাপ হতো না!
সঙ্গে সঙ্গেই মাসুম ভাই বলে উঠলো, পরিচিত একজন ডাকাত সরদার আছেন। এই খাল ধরে কিছুক্ষণ আগালেই তার বাড়ি। আচ্ছা, একবার তারে কল দিয়ে দেখি বাড়িতে আছে কি না!
মাসুম ভাই কল দিলেন। ডাকাত সরদার আছেন বাড়িতেই। তারে বলে মাসুম ভাই রাজি করালেন বোটে আসার জন্য। রাত তখন প্রায় ১০ টা। আমাদের বোট খাল ধরে ওই ডাকাত সরদারের বাড়ির কাছাকাছি চলে গেল। হাটুসমান পানিতে নেমে হেঁটে হেঁটে তিনি আমাদের বোটে আসলেন।
এরপর শুরু হলো আমাদের জমিয়ে গল্প! কতশত প্রশ্ন, কত কত উত্তর তার কাছ থেকে! আমাদের প্রশ্নগুলো থাকুক, শুধু তার গল্পটাই শুনুন....
‘সঙ্গ দোষে আসছিলাম এই জগতে। ২০০৭ সালে যোগ দেই ডাকাতিতে। ২০১৫ সালে নিজেই ছিলাম একটা দলের সরদার। টাকা-পয়সা তো ভালোই কামাইছি। কলকাতায় জায়গাও কিনছি। কলকাতায় শুইনা অবাক হইয়েন না! আমরা যারা ডাকাতিতে ছিলাম, তারা প্রায়শই ঝুঁকি দেখলে অবৈধভাবে কলকাতায় ঢুকে যাইতাম। আমার সেখানে জায়গাও কেনা ছিল। কিন্তু থাকতে পারিনাই। সেই জায়গা বিক্রি কইরাই পরে দেশে ফেরা লাগছে।’
জায়গা বিক্রি করলেন কেন?
২০১৬ সালে যখন মহসিন উল হাকিমের ডাকে একযোগে ২০-৩০ টা ডাকাতদল আত্মসমর্পণ করে, তখন আমি আত্মসমর্পণ করি নাই। ভয় ছিল, যদি আত্মসমর্পনের পরে মাইরা ফেলে। সেজন্য কলকাতা চইলা যাই। কিন্তু সেখানে গিয়া দেখি, যারা আত্মসমর্পণ করছে তারা নিরাপদই আছে। অনেকে নতুন ব্যবসা দিছে, কাজ শুরু করছে। পরে আমি মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারে বলি, আত্মসমর্পণ করতে চাই। কিন্তু সে আমারে জানায়, তোমার আত্মসমর্পণ করতে হইলে অস্ত্র জমা দিতে হইবো। কিন্তু তখন তো আমার কাছে অস্ত্র নাই। আমি অস্ত্র ছাড়াই কলকাতা চইলা আসছি। কি করা যায়, কি করা যায়! সিদ্ধান্ত নিলাম, আচ্ছা কলকাতার এই জায়গা বিক্রি কইরা দিমু। সেই টাকা দিয়া অস্ত্র কিনমু। তাই করলাম, জায়গা বিক্রি কইরা দিলাম। ৫টা অস্ত্র কিনলাম। পরে সেই অস্ত্র জমা দিয়াই আত্মসমর্পণ করলাম।
প্রায় দুই ঘণ্টার আড্ডা! ডাকাত সরদার একটার পর একটা ঘটনা বলেই যেতে থাকলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য.....
‘আমার স্ত্রী ডিভোর্স দিছিল। কেনই বা থাকবে? কয়দিন পরপরই পুলিশ, র্যাব আমারে বাড়িতে খুঁজতে আইতো। সবাই জানতো ডাকাতের বউ। থাকে নাই, চলে গেছে সংসার ছেড়ে। আসলে এইটা তো কোনো জীবন না। এমনও হইতো, আমাদের বাড়ির কেউ মারা গেলেও দেখতে যাইতে পারতাম না। কেমনে যাব? আমরা যারা এই দস্যু জীবন বাইছা নিছি, এলাকায় আশেপাশের পাড়া মহল্লায় সবাই জানতো ওই বাড়ির ....অমুক ডাকাত। কখনো দেখলে তো গণপিটুনি দিয়েই মেরে ফেলবে।’
আর যাবেন কখনো ডাকাতির পেশায়? ‘নাহ, যারা একবার এই জগত ছেড়ে আসে তারা আর কখনো এই অন্ধকার জীবনে ফেরে না।’
এবার একটু মজা করলেন ডাকাত সরদার। বললেন, ‘আর কইয়েন না। গত দুই-তিনদিন ধইরা আছি আরেক জ্বালায়। সুন্দরবনে ডাকাত নামছে, এরপর থিকাই পরিচিত সবাই ফোন দিতাছে। নিশ্চিত হইতে চাইতেছে, আমিও নামছি নাকি। এখন দেখা যায় কেউ ফোন দিলেই তারে ভিডিওকলে দেখানো লাগতাছে, এই দেখ আমি বাড়িতেই আছি, বনে না। ডাকাতিতেও নামি নাই....হাহাহাহা।’
নাহ, আমাদের রোমাঞ্চকর যাত্রার গল্প এখানেই শেষ নয়। রাত তখন ১২ টা, আমরা সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ডাকাত সরদারকে বিদায় জানালাম। বোট আবারও খালের মাঝখানে চললো।
জাহাঙ্গীর ভাই বিষণ্ন, তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? তখনই তার মোবাইলে সেই মজনু ডাকাতের ফোন। মালঞ্চ নদীতে কোস্টগার্ডের একটা বোট ঢুকছে। টহল দিতে। সেই বোটের শব্দ শুনে সে জাহাঙ্গীর ভাইরে ফোন দিয়ে নিশ্চিত হলেন, বোটটা আমাদের কি না। জাহাঙ্গীর ভাই জানালেন, না। আমরা এখন....এই খালে আছি।
জাহাঙ্গীর ভাই বলতে লাগলেন, ‘৫ আগস্টের পর অনেক সন্ত্রাসী এই সুন্দরবনের জলদস্যু হিসেবে নামছে। মজনু তাদের অন্যতম। তবে মজনুর কাহিনী আমি জানি, ওর স্ত্রী-সন্তানই ওর লগে প্রতারণা করছে। সেই কষ্ট থিকাই আবারও এই অন্ধকার জীবন বাইছা নিছে। নয়তো কখনোই সুন্দরবনে ও নামতো না।’
এবার জাহাঙ্গীর ভাই মহসিন উল হাকিমরে ফোন দিলেন, জানালেন মজনু ডাকাতের কথা। মহসিন উল হাকিম খানিকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নিশ্চিত হলে কিভাবে?’ জাহাঙ্গীর ভাই বললেন, সন্ধ্যায় আমাদের সেই মাছ ধরা আর একটা ফোনকলের ঘটনা।
রাত দুইটা। একঝাঁক রহস্য, ভয়, উত্তেজনা নিয়েই আমরা বোটের ছোট্ট ছোট্ট কেবিনে গিয়ে যে যার মতো শুয়ে পড়লাম। ভোরের আলো ফুটলো অসাধারণ এক অনুভূতির মধ্য দিয়ে। আমার ছোট্ট কেবিনের জানালা দিয়ে দেখলাম, সুন্দরবনের পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর হালকা আলোতে বন, খাল স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিছু ছবি আর ভিডিও তুলে নিয়েই বোটের ওপরে চলে গেলাম। শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ শুধুই বসে থেকে সেই দৃশ্যগুলো উপভোগ করে গেলাম।
সকালের নাস্তায় খেয়ে নিলাম খিচুড়ি, হাঁসের মাংস। বোটটা লোকালয়ে রেখে আমরা আবারও বেরিয়ে পড়লাম, বাজারের জন্য। সুন্দরবনের বিখ্যাত কাঁকড়া, মাছ এসব খেতে হবে। মাসুম ভাই নিয়ে গেলেন, কাঁকড়া আড়তে। সেখান থেকে কয়েক কেজি কাঁকড়া কিনে নিয়ে, ফিরলাম বোটে। আবারও রান্নার আয়োজন।
এরই মধ্যে আমরা ছোট একটা নৌকা ভাড়া করলাম। উদ্দেশ্য, বনের মাঝে খালের ছোট্ট ছোট্ট যেই চ্যানেলগুলো আছে সেখানে প্রবেশ করা।
উঠে পড়লাম নৌকায়। এবার ঢুকলাম সুন্দরবনের আরও গহীণে। নাহ, বাঘের দেখা পাইনি। তবে পায়ের ছাপ দেখেছি। চ্যানেলগুলো এতই সরু, যখন ভাটা থাকে তখন বাঘ প্রায়শই নাকি হেঁটে এই খাল পাড়ি দিয়ে বনের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে যাতায়াত করে।
নৌকায় প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুরে আমরা আবারও বোটে ফিরে আসলাম। এর মধ্যে হরিণ, বানর, বন শুয়োর, হরেক রকমের পাখির দেখা পেলাম। যাক, আশাহত হইনি। কারণ সুন্দরবনের বাঘের দেখা নাকি সেখানকার লোকালয়ের মানুষও এক জনমে সেভাবে পায় না।
বোটে আসার পরে আমাদের বাবুর্চির এলাহি আয়োজন! কাঁকড়া, সুন্দরবনের খালের মাছ থেকে শুরু করে কত কি রান্না! সবাই শেষবারের মতো একসঙ্গে খেয়ে নিয়ে শেষ বিকেলে বোট থেকে বিদায় নিলাম। শেষ হলো আমাদের সুন্দরবনে রোমাঞ্চকর ৩৬ ঘণ্টা।
৫ তারিখ রাতে যখন আমরা সুন্দরবনের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করি, তখন হয়তো একটা বারের জন্যও চিন্তা করিনি পরবর্তী কয়েকঘণ্টায় কি অসাধারণ কিছু রোমাঞ্চকর মুহূর্তই অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, এবারের মতো বিদায় জানালাম সুন্দরবনকে। ফিরে আসলাম আবারও সেই ঢাকার যান্ত্রিক, কোলাহলময় জীবনে.......।
নাঈম হাসান, শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক।