বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনায় ডি-৮ চেয়ারম্যানশিপ
উন্নয়নশীল আটটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ নিয়ে ডি-৮ এর সূচনা। বাংলাদেশ, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান এবং তুরস্ক এই ৮টি দেশ সংগঠনটির সদস্য। ১৯৯৭ সালের ১৫ই জুন ইস্তানবুলে এক ঘোষণার মাধ্যমে তুরস্কের নেতৃত্বে সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়। সংগঠনটি মূলত এই আটটি দেশের অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং পর্যটন নিয়ে কাজ করে।
১৯৯৯ সালে ঢাকাতে সংগঠনটির দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তী দুই বছরের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর প্রায় দুই যুগ পর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো ২০২১ সালের ৮ই এপ্রিল। ডি-৮ এর দশম সভাপতি হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ এবারের সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে প্রত্যেকটি সদস্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রিত জানায়। তবে বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে এবারের শীর্ষ সম্মেলনটি ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সংগঠনটির সদ্য সাবেক সভাপতি, তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট দায়িত্বভার তুলে দেন পরবর্তী দুই বছরের জন্য।
বর্তমানে পৃথিবীর সর্বমোট জনসংখ্যা ৭০০ কোটির কিছু বেশি। এরমধ্যে ১০০ কোটি লোকের বাস ডি-৮ সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে। এদের অধিকাংশই তরুণ, কর্মতৎপর, উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী এবং দু:সাহসিক কাজে আগ্রহী। কেবল পর্যটনের উদ্দেশ্যেই তারা ভ্রমণ করে না। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসায়িক কাজেও তাদের আগ্রহ রয়েছে। ক্রমশ বাণিজ্যিক ক্ষেত্রগুলো বিস্তার লাভ করছে, যার কারণে বিদেশ যাত্রা এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ৮টি দেশের সার্বিক জিডিপি যখন ৪ ট্রিলিয়ন ডলার, তখন দেশগুলো সাধারণ মানুষ তুলনামূলক আরামদায়ক গন্তব্যমুখী হবেন।
ডি-৮ সদস্যভুক্ত দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া এবং তুরস্ক উন্নত চিকিৎসা সেবায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ভাবে একই উম্মাহ’র সদস্য হওয়ায় বিভিন্ন পর্যটন স্পট এ সকল দেশের প্রত্যেকের কাছেই পবিত্র এবং আকর্ষণীয়। যেমন পাকিস্তানের লাহোর ফোর্ট, শীশ মহল। ইরানের রয়েছে আলি কাপ্পূ প্যালেস, নকশ-ই জাহান স্কয়ার। মিশর দাবি করে তাদের গির্জা নেক্রোপলিস পৃথিবীর প্রাচীনতম উপাসনালয়। তুরস্কের রয়েছে হায়া সোফিয়া, নীল মসজিদ। নাইজেরিয়ার আবুজা মসজিদ আফ্রিকা মহাদেশের প্রাচীনতম মসজিদ। তামান তামাদুন মালয়েশিয়ায় অবস্থিত পূর্ব এশিয়ার একটি আকর্ষণীয় স্থান। ইন্দোনেশিয়ার আছে লুম্বক, আচেহ, বান্দুং ইত্যাদি
পর্যটন বাংলাদেশেরও একটি সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশের রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইসলামিক ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ঐতিহাসিক স্থাপনার ভাণ্ডার। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মসজিদ, স্মৃতিস্তম্ভ, ইসলামিক প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ এবং মাজার সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে। মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয় হজ্জ খ্যাত ‘বিশ্ব ইজতেমা’ অনুষ্ঠিত হয় এই বাংলাদেশেই। সারা বিশ্ব থেকে আগত লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মিলন মেলায় পরিণত হয় টঙ্গীর তুরাগ নদীর পাড়। আমাদের রাজধানী শহর ঢাকাকে বলা হয়ে থাকে ‘মসজিদের শহর’। কয়েকটি ঐতিহাসিক মসজিদের মধ্যে তারা মসজিদ, চকবাজার শাহী মসজিদ, বায়তুল মুকাররাম, হোসনে দালান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত দশম ওআইসি কনফারেন্স রাজধানী ঢাকাকে ‘ইসলামিক সিটি অব ট্যুরিজম ২০১৯’ হিসেবে ঘোষণা করে। ঢাকার বাইরে ইসলামিক নিদর্শন গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হজরত শাহজালাল (রা:) এর মাজার, হজরত শাহ পরানের মাজার, বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, গাজীপুরে অবস্থিত ওআইসির একমাত্র আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়(আইইউটি) ইত্যাদি। বাংলাদেশ সরকার পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। পূর্বে দেশের পর্যটন খাত একটি বোর্ডের মাধ্যমে সমন্বয় করা হলেও বর্তমান সরকার একটি পূর্ণ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০১৬ সালকে বাংলাদেশের ‘পর্যটন বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিলো।
ইসলামিক অর্থনীতি বর্তমান বিশ্বে নতুন আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। হালাল খাদ্য দ্রব্য, সুদ বিহীন লেনদেন, হালাল কসমেটিকস এবং পর্যটন ইসলামিক অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। একই বিশ্বাস এবং টেকসই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে ডি-৮ ভুক্ত দেশ গুলো একত্রিত হয়েছে। তবে কিছু বাঁধা বিপত্তির জন্য এখনো পরিপূর্ণ সফলতার স্বাদ সবাই পাচ্ছে না। প্রথমত আসে বাধাহীন যোগাযোগের অপারগতার বিষয়টি। ডি-৮ এর সকল সদস্য দেশ গুলো একই আন্তর্জাতিক সীমানায় অবস্থিত নয়। এক্ষেত্রে অন এরাইভাল ভিসা সুবিধাটি থাকলে ট্যুরিস্ট দের জন্য ভ্রমণ সহজ হয়। দেশগুলোর মধ্যে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা অতীব জরুরী। সমুদ্রপথ সকল সদস্য দেশের সাথেই যোগাযোগ রক্ষায় কাজে আসতে পারে। প্রমোদতরী ভিত্তিক পর্যটন খুলে দিতে পারে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। দ্বিতীয়ত ডি-৮ ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যৌথ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ঘাটতি। সদস্য দেশগুলোর পর্যটন বিষয়ক সংগঠন গুলোর মধ্যে একাডেমিক পর্যায়ের গবেষণা প্রয়োজন। এতে করে পর্যটন সংক্রান্ত ব্যক্তিবর্গের নিয়োমিত যোগাযোগ বাড়বে এবং নিজেদের দুর্বলতা ও প্রয়োজনীয় কার্যাবলি সামনে আসবে। তৃতীয়ত, ডি-৮ ভুক্ত দেশ গুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রচারণার অভাব। পর্যটনের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রচার প্রচারণা বাড়ানো প্রয়োজন। এতে করে পিছিয়ে পড়া দেশের পর্যটকদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো সম্ভব হবে।
ধর্মীয় পর্যটন বহু পুরনো একটি ধারণা হলেও ইসলামিক পর্যটন এক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। বৃহৎ পরিসরে পর্যটনের মাধ্যমেই ইসলামিক আচার অনুষ্ঠান গুলো পালন হয়ে আসছে। এর মাধ্যমে মুসলিম জনগণ মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন এর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারেন। সৌদি আরব, তুরস্ক, কাজাখস্তান ইতিমধ্যে ইসলামিক পর্যটনের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এসব সম্ভাবনা থাকার পরও বাংলাদেশসহ ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলো এক্ষেত্রে সুযোগ হাতছাড়া করেছে। তবে এবারের সম্মেলনে সভাপতির পর্যটনের প্রতি আগ্রহ থেকে বোঝা যাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে পর্যটন হতে চলেছে ডি-৮ ভুক্ত দেশ গুলোর অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অফ ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।