কাশ্মীর ভ্রমণ : ৮ রাত ৯ দিনের পরিকল্পনা (দ্বিতীয় পর্ব)
যে কোন ভ্রমণকে আনন্দদায়ক ও সফল করতে পারে সঠিক পরিকল্পনা। কোথায় যাবেন? কীভাবে যাবেন? কোথায় থাকবেন? দিন অনুযায়ী যদি এভাবে পরিকল্পনা করে ফেলা হয় তবে ভ্রমণ হবে স্বাচ্ছন্দ্যে!
কাশ্মীর ভ্রমণের চিন্তার শুরুতেই আমরা অনেক ভিডিও ব্লগ দেখেছি। ভ্রমণ বিষয়ক বিভিন্ন লেখাও পড়েছি। সে সব থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা কাশ্মীর ভ্রমণের ৮ রাত ৯ দিনের পরিকল্পনা করে ফেলি।
কাশ্মীর ভ্রমণের প্রথম দিন (ঢাকা – দিল্লি)
কাশ্মীর ভ্রমণে আমি বেছে নিয়েছিলাম বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা–দিল্লি ফ্লাইট। বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টার ফ্লাইটে উঠে দিল্লি পৌঁছেছি দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে। দুই দেশেই ইমিগ্রেশন শেষ হয়েছে খুবই দ্রুত। মাঝে বিমানের খাবারটাও দারুণ লেগেছে। লাঞ্চ হিসেবে দিয়েছিল চিকেন বিরিয়ানি এবং সাথে সবজি। ডেজার্ট হিসেবে ছিল কেক। বিমানের খাবারটা খুবই সুস্বাদু লেগেছে আমাদের কাছে।
দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে রেল স্টেশন পর্যন্ত উবার কল করি। বাংলাদেশের উবার ইউজারদের ওখানে গিয়ে নতুন করে আর উবার অ্যাকাউন্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। এখানকার অ্যাকাউন্টই কাজ করবে। আমাদের উবারে করে স্টেশনে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। স্টেশনের সাথে মেট্রো রেল আছে। এয়ারপোর্ট থেকে নয়া দিল্লি রেল স্টেশন পর্যন্ত মেট্রোতে করে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। একদিকে যেমন খরচ বাঁচবে অন্যদিকে তেমন শহরের যানজট থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আর যদি দিল্লি শহরে কেউ ট্যাক্সি বা উবার ব্যবহার করেই থাকেন তাহলে ভাড়া দেয়ার সময় কত বিল এসেছে নিজের অ্যাকাউন্টে ঢুকে অবশ্যই ক্রসচেক করে নিবেন। নাহলে যেকোনো মুহূর্তে ঠকে যেতে পারেন চোখের পলকেই।
কাশ্মীর ভ্রমণ : কম খরচে লাক্সারি ট্যুর করবেন যেভাবে (প্রথম পর্ব)
রাত ৮টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম নতুন দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে। যাওয়ার পথে দিল্লী গেট ও রেড ফোর্টও দেখে নিলাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে। সামান্য অপেক্ষা করে রাত সাড়ে নয়টার জম্মুগামী বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে উঠলাম। ট্রেনের থ্রি টায়ার এসি টিকিট আগেই কেটে রেখেছিলাম অনলাইনে। জনপ্রতি টিকিটের দাম পড়েছিলো ১৪৮৫ রুপি করে। আমরা যদি কাশ্মীর ভ্রমণের এই অংশটা ফ্লাইটে করতাম তাহলে আমাদেরকে সকালের ফ্লাইট ধরার জন্য দিল্লিতে হোটেল নিয়ে অপেক্ষা করতে হতো। তাই যে সময়টা আমরা হোটেলে অপেক্ষা করতাম সেই সময়টা মানে পুরো রাতটা ট্রেনে ঘুমিয়ে নিলাম। এই ফাঁকে পথটা এগিয়ে গেল জম্মু পর্যন্ত।
কাশ্মীর ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন (দিল্লি - শ্রীনগর)
ট্রেনের ঝিকঝ্যাক শব্দ আর কিছুটা শীতল আবেশে ঘুম ভাঙল সকাল ৮টায়। জানালায় উঁকি দিতেই চোখে পড়লো রুক্ষ পাথুরে চারণভূমিতে। শুনলাম রাতে অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে ট্রেন খুব ধীরে চালাতে হয়েছে যার ফলে প্রায় তিন ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছেছে। সকাল ১০টার দিকে ট্রেন থামলো জম্মু স্টেশনে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে প্রথমেই সিম নিয়ে নিলাম। সিম নেয়ার ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ হকারদের কাছ থেকে না নিয়ে দোকান থেকে নিবেন। এয়ারটেলের সিম ৩০০ থেকে ৩৫০ রূপিতেই পাওয়া যাবে তবে সিম দরদাম করার সময় শুরুতেই জানাতে হবে যে, পাসপোর্ট দিয়ে সিম কিনবেন। সিম অ্যাকটিভ করতে ১৫/২০ মিনিট সময় লাগতে পারে। এই সময়ে ওখানে দাঁড়িয়েই সামান্য চা নাস্তা সেরে নিতে পারেন। হালকা নাস্তার জন্য আলুপরটা পাবেন অধিকাংশ চায়ের দোকানেই।
এবার ঠিক করতে শ্রীনগর যাওয়ার শেয়ার কার। চাইলে বাসেও যেতে পারেন। সে জন্য স্টেশন থেকে আগে অটো নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল অটো নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে শেয়ার গাড়ি দরদাম করার। তবে অটোতে উঠে চালকের সাথে গল্প করতে করতে শেয়ার গাড়ির সন্ধান পেলাম। অটো চালকই শেয়ার গাড়ি ঠিক করে দিলেন। জম্মু থেকে শ্রীনগরের শেয়ার ভাড়া পার পার্সন ৬০০ থেকে ৮০০ রুপি করে। এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আপনি জম্মু এসে পৌঁছেছেন মানে এখান থেকেই আপনার দরদামের শুরু। যে যত ভালো দরদাম করতে পারবেন সে তত কম খরচে ভ্রমণ শেষ করতে পারবেন এবং মনে রাখবেন, এখানে দরদাম করার সময় লজ্জা পেলে চলবে না পাশাপাশি মায়া মমতা দেখালেও চলবে না। জম্মু থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত শেয়ার গাড়িতে জনপ্রতি ভাড়া চাইবে ১৫০০ থেকে দুই হাজার রুপি পর্যন্ত। তবে সেটা দরদাম করে আমরা জনপ্রতি ৭০০ রুপি পর্যন্ত নামাতে পেরেছিলাম। গাড়িতে উঠে ঢাকার মোহাম্মাদপুরের ব্যবসায়ী রাসেল ভাইয়ের সাথে দেখা হল। পরে জানলাম উনি জনপ্রতি ৬০০ রূপিতেই ভাড়া ঠিক করেছেন। এখন নিশ্চয় ধারণা পেয়েছেন কতটা সূক্ষ্ম দরদাম করতে হবে কাশ্মীর ভ্রমণে।
যাত্রা শুরুর মোটামুটি ঘণ্টা দেড়েক পরেই আপনার চোখ জুড়াতে শুরু করবে। ততক্ষণে বেরিয়ে আসবেন জম্মু শহর থেকে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার সৌন্দর্যে আমি কতক্ষণ যে স্তব্ধ হয়ে ছিলাম সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। বারবার শুধু একটা কথাই মনে হয়েছে যে, আমি যদি এই সড়কপথে না এসে বিমানে আসতাম তাহলে এই সৌন্দর্যটা দেখার সৌভাগ্য হতো না। পুরো পথটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকলাম। মাঝে খাবারের বিরতির জন্য গাড়ি থেকে নামতেই হাড়কাপানো ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগলো। এই ঠান্ডা, এই সৌন্দর্য, এই প্রাণ প্রকৃতি ছুঁয়ে দেখার জন্য এরই মাঝে পাড়ি দিয়ে ফেলেছি সতেরোশ পঞ্চাশ কিলোমিটার পথ। এখনো প্রায় দেড়শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।
শ্রীনগর ডাল লেকের ঘাটে যখন পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। হাউসবোট আর শিকারার ছোট্ট বাতিগুলোর প্রতিচ্ছবি তখন ডাল লেকের পানিতে চিকিমিকি করছে। ভাবতেই অবাক লাগছে যে আমরা পৌঁছে গেছি ভূ-স্বর্গে। চাঁপা উত্তেজনায় নিশ্বাস বড় হচ্ছে আর একেকটা নিশ্বাসে বুক ভরে যাচ্ছে বরফে মোড়ানো পর্বতমালা থেকে নেমে আসা হিমশীতল বাতাসে।
শ্রীনগরের প্রথম রাত আমরা ডাল লেকের হাউসবোটে থাকতে চাই। আগেই আগোডা থেকে বুক করে রাখা হাউসবোটের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে নিলাম দ্রুত। এক রাতের জন্য আমাদের হাউসবোটের ভাড়া পড়েছিলো ২৪৫০ রুপি। উনারা লেকের ১ নাম্বার ঘাট থেকে আমাদের রিসিভ করে শিকারায় চড়িয়ে হাউসবোট পর্যন্ত নিয়ে যাবেন। ততক্ষণে ডাল লেক একেবারে নীরব হয়ে উঠেছে। কোলাহলবিহীন লেকে যখন আমরা শিকারায় উঠেছি, ততক্ষণে মোহনীয় এক আবেশ তৈরি হয়েছে লেকের পানিতে।
কাশ্মীর ভ্রমণের তৃতীয় দিন (গুলমার্গ)
কনকনে ঠাণ্ডায় হাউসবোটের বেলকনিতে এসে যখন দাঁড়ালাম তখন চারিদিকে ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো পুরো ডাল লেক। লেকের অপর প্রান্ত থেকে সূর্যটা কেবল উঁকি দেয়া শুরু করেছে। কি এক অপুর্ব দৃশ্য। হাউসবোটের বেলকনিতে বসে সকালের চা টা শেষ করতেই, আগে থেকে ঠিক করে রাখা ড্রাইভার সিরাজ ভাই ফোন করে জানালেন তিনি এসে গেছেন। আমাদের আজকের গন্তব্য গুলমার্গ।
আপনারা অবশ্য শ্রীনগর পৌঁছানোর পর প্রথম দিনটা শ্রীনগর শহরের বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখতে পারেন। শহরের ভেতরেই অনেক স্পট রয়েছে যেমন- শালিমার বাগ মুঘল গার্ডেন, হযরতবাল মসজিদ, পরী মহল, ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল টিউলিপ গার্ডেন সহ আরো অনেক কিছু। শ্রীনগর ঘুরে দেখার জন্য এপ্রিল - মে অর্থাৎ বসন্তের সময়টা সেরা।
তবে আমরা যেহেতু শীতের সময় গিয়েছি সে সময় ‘মরা’ টিউলিপ গার্ডেন আর ধূসর ঘাসে ভরা মুঘল গার্ডেন দেখে সময় নষ্ট করতে চাইনি। তাছাড়া গুলমার্গের অন্যতম আকর্ষণ গন্ডোলা রাইডের টিকিট আমরা এদিনের জন্যই কাটতে পেরেছিলাম। সে জন্য গুলমার্গ দিয়েই শুরু করতে হলো আমাদের কাশ্মীরের সাইট সিন।
শ্রীনগর থেকে মাত্র ৫২ কিলো দূরে সবুজ ঘাসে বিস্তৃত গুলমার্গ, যা সারা বছরই বরফে ঢাকা থাকে। এখানে দেখতে পারবেন গন্ডোলা (ক্যাবল কার), গলফ কোর্স, বাবা ঋষির মাজার, আফারওয়াত পিক, সেন্ট ম্যারি চার্চ। গন্ডোলায় চড়ে ফেজ ১ ও ফেজ ২ পর্যন্ত যাওয়া যায়। ফেজ ২ তে মোটামুটি সারা বছরই বরফ থাকে তাই পর্যাপ্ত মাইনাস তাপমাত্রার জ্যাকেট নিয়ে যেতে হবে। যেকোনো এক ফেজে পৌঁছেই মেতে উঠতে পারেন স্বচ্ছ বরফ নিয়ে খেলায়। পুরো দিনটা এখানে কাটিয়ে আমরা রাতে আবার শ্রীনগর ফিরে যাই।
চলবে...