বাতিঘরের দ্বীপ কুতুবদিয়া
শহরের উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ে থেকে আমরা স্বপ্ন দেখি ঈদের ছুটিতে ছুটে যাবো নাড়ির টানে জন্মভূমির পথে। অপেক্ষায় থাকলাম ছুটি হওয়ার। ঈদ এলো। অবশেষে ছুটি হলো। বেরিয়ে পড়লাম আমার প্রিয় জন্মভিটার উদ্দেশ্যে আমি আর বন্ধু রাইসি। ব্যাগভর্তি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড থেকে রাত এগারোটায় সেন্টমার্টিন বাস সার্ভিস কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে রাতভর গাড়িতে ঘুমিয়ে সকাল ৬ টায় পৌছালাম গন্তব্যে চকোরিয়ায়।
চকোরিয়া থেকে সিএনজি যোগে একঘণ্টা জার্নি করে পৌঁছালাম পেকুয়ার মগনামা জেটি ঘাটে। চোখে পড়লো পশ্চিমে বিশাল নদী কর্ণফুলী নামে। অপর প্রান্তে সমুদ্রের বুকের ভেতর ভেসে আছে এক টুকরো জেগে ওঠা দ্বীপ বাতিঘর খ্যাত কুতুবদিয়া। খুশিতে টলমল যেন চক্ষু যুগল। এরপর জেটির প্রবেশ মুখে পাঁচ টাকা জেটি ভাড়া দিয়ে স্পীড বোটে উঠে পড়লাম কুতুবদিয়ার দরবার ঘাটের গন্তব্যে। ঢেউয়ের সঙ্গে ঝাপটাতে ঝাপটাতে স্পীড বোট অপরপ্রান্তের দরবার ঘাটে পৌঁছালো পাঁচ থেকে সাত মিনিটের ভেতরে। এরপর আবারো পাঁচ টাকা নাকি ঘাট ভাড়া। ভাড়া দিয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপের বিখ্যাত বুজুর্গ মালেক শাহ্ হুজুরের দরগাহতে ছুটছি মনের আনন্দে।
হুজুরের মাজার জিয়ারত শেষে গন্তব্য ঠিক করলাম আমাদের ঘরে আম্মার কোলে। যেতে যেতে চোখে পড়লো আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন বাড়ির প্রবেশমুখে আমাদের জন্য। আম্মার কতো অপেক্ষা ছিলো আমাদের বাড়ি ফেরার। রাতে গাড়িতেও কয়েকবার ফোন দিয়েছিলেন। আমি জানি, আম্মার চোখে রাত ঘুম হয়নি আমাদের চিন্তায়। এক পর্যায়ে বাড়িতে পৌছালাম। আম্মাকে সালাম জানিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। আম্মার চোখের জল মুছে বললাম আর যাবো না মা তোমাকে ছেড়ে শহরে। বাড়িতে একদিন থেকে পরের দিন বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম সেই কুতুবদিয়া দ্বীপের প্রাণ খ্যাত বাতিঘরের উদ্দেশ্য।
আধ ঘণ্টা জার্নি শেষে পৌছালাম বাতিঘরে। দেখলাম বিশাল আকাশের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে বাতিঘর। পশ্চিমে বিশাল সমুদ্র বঙ্গোপসাগর। চিকচিক বালির তীরের কাছাকাছি থেকে পানিতে উড়ছে সাদা পায়রা, অতিথি পাখি। এরা সাধারণ আসে শীতকালে সুদূর উত্তর মেরু থেকে উড়ে উড়ে। সূর্যের রক্তিম আলোর কিরণ ঝুকে পড়েছে বাতিঘরের উঁচু শিরে। দেখতে কী যে ভালো লাগছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো কুতুবদিয়ার বুকে। জ্বলে উঠলো বাতিঘরের বাতি। সাধারণত এ বাতির দ্বারা সমুদ্রের বিভিন্ন জাহাজকে সচেতন করা হয়। বাতির আলোয় ঝলমলে হয়ে উঠলো দ্বীপের চর।
তারা গুনতে গুনতে আমরা দ্বীপের চরে সমুদ্র তীরে ঝাউগাছের নিচে টাঙিয়ে ফেললাম একটি তাঁবু। ইট দিয়ে তৈরি করলাম একটি চুলা। লাকড়ি সংগ্রহ করে কফি বানিয়ে নিলো বন্ধু রাইসি। সমুদ্র তীরে বালির উপর বসে হাওয়া খেলাম প্রাণভরে। দেখলাম, সমুদ্রের মাঝে মাঝে দুই-তিন কিলোমিটার পর পর জাহাজ আর মাছের বোট চলাচল করছে। এ দ্বীপের মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে সমুদ্রের মাছ দিয়ে। অবশেষে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম তাঁবুতে।
ভোরে ঘুম ভাঙলো পাখির ডাকে। পূর্ব দিকে নতুন সূর্য উদিত হচ্ছে জগতে- দ্বীপের বুকে। যেন নতুন স্বপ্ন, সুন্দর দিন নিয়ে। চিকচিক করছে বালু, গর্জন দিচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ। আমি হাঁটতে গেলাম। সকালে হাঁটার অভ্যাস আছে। এর মধ্যেই ইটের চুলা আর লাকড়ি জ্বালিয়ে রাইসি বানিয়ে নিলো সকালের নাস্তা। নাস্তা খেয়ে আর তাঁবু গুঁটিয়ে দুজনই উঠে হাঁটা ধরলাম নতুন গন্তব্যে। আজকের গন্তব্য বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘুরাঘুরি। ধারণা করা হয়, সমগ্র বাংলাদেশে কুতুবদিয়া দ্বীপেই সর্বপ্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন হয় ১৯৯৬ সালে। আধ ঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জার্নিতে দুটি গাড়ি পাল্টে অবশেষে পৌছালাম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষের ঘরে ঘরে আলো দিতে এই বায়ু বিদ্যুতের কর্তৃত্ব অপরিসীম। দেখলাম, উঁচু উঁচু টাওয়ার বানিয়ে আকাশের বুকে বড় বড় পাখা রয়েছে। যে পাখা গুলো থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এ পাখা থেকেই তারের মাধ্যমে আলোকিত হয়ে ওঠে দ্বীপ, মানুষের ঘর। পূর্বে-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ চারদিকে সমুদ্র। এ দ্বীপের মানুষের মন প্রকৃতির মতোই সুন্দর, নির্মল, উজ্জ্বল। যা সহজেই মানুষকে মুগ্ধ করে। যেমন মুগ্ধ করেছে দ্বীপের প্রকৃতি, সকাল, সমুদ্দুর।
যেভাবে যাবেন
কুতুবদিয়া যেতে হবে কক্সবাজারের বাসে। ঢাকা থেকে সরসরি কক্সবাজার যায় সোহাগ পরিবহন, টি আর ট্রাভেলস, গ্রীন লাইন পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সেন্টমার্টিন পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহনের এসি বাস। ভাড়া ১ হাজার ৭শ’ থেকে ২ হাজার ৫শ’ টাকা। এছাড়া এস আলম, সৌদিয়া, শ্যামলী, ইউনিক, ঈগল ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাসে ভাড়া সাড়ে ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। এসব বাসে চড়ে নামতে হবে চট্টগ্রাম কক্সবাজারের পথে যাত্রা বিরতি চকোরিয়া নেমে সেখান থেকে সিএনজি চালিত ট্যাক্সিতে যেতে হবে মাগনামা ঘাট। জনপ্রতি ভাড়া ৮০ টাকা। মাগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হতে হবে ইঞ্জিন নৌকা অথবা স্পিড বোটে। ইঞ্জিন নৌকায় সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট, ভাড়া ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আর স্পিডবোটে লাগে ১০ মিনিট, ভাড়া একশ থেকে দেড়শ টাকা। চ্যানেল পার হলেই কুতুবদিয়া।
কোথায় থাকবেন
কুতুবদিয়া দ্বীপে পর্যটকদের থাকার জন্য মানসম্মত একমাত্র আবাসন ব্যবস্থা হলো হোটেল সমুদ্র বিলাস। সমুদ্র লাগোয়া এই হোটেলে বসে উপভোগ করা যায় সমুদ্রের সৌন্দর্য। হোটেলের দুইজনের নন এসি কক্ষ ভাড়া ৮শ’ টাকা তিনজনের ১ হাজার এবং চারজনের কক্ষ ভাড়া ১ হাজার ২শ’ টাকা। অথবা বিশাল আকাশের নিচে সমুদ্র তীরে বালুর উপরে তাঁবু টাকিয়ে হাওয়া খেতে খেতে পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় রাত যাপন করতে পারেন নির্বিঘ্নে।