শিলং ভ্রমণ গাইড : কীভাবে যাবেন? যা দেখবেন ও খরচাপাতি
প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড শিলং। সবুজে ঘেরা পাহাড়, আকা-বাঁকা উঁচু-নিচু পথ, সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে যেতে পারেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে। ঢাকা থেকে সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে খুব সহজেই যেতে পারেন সেখানে।
বাংলাদেশে যেমন ঝর্ণা খুঁজে বের করে দেখতে যেতে হয় মেঘালয়ে এর পুরোটাই বিপরীত। চলার পথে আপনার মনে হতেই পারে ঝর্ণাই আপনাকে দেখতে এসেছে। ছোট বড় মিলিয়ে এখানে যে কত ঝর্ণা রয়েছে তার হিসাব হয়তো কারো কাছেই নেই।
ঝকঝকে রোদ, হঠাৎ অন্ধকার, ঝুম বৃষ্টি। এরপর এক পশলা মেঘ এসে আপনাকে ভিজিয়ে যেতেই পারে। মেঘালয়ের প্রকৃতিটাই যেন এমন। জুন থেকে আগস্ট অর্থাৎ বর্ষায় শিলং ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
সম্প্রতি ঘুরে এলাম মেঘালয়ের শিলং এর অনেকগুলো জায়গা থেকে। সে অভিজ্ঞতা থেকেই আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করবো শিলং ভ্রমণের ৩ রাত ৪ দিনের পরিকল্পনা।
প্রথম দিন (চেরাপুঞ্জি)
এক পাশে বাংলাদেশের সিলেটের তামাবিল সীমান্ত এবং অন্য পাশে ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি সীমান্ত। তামাবিল - ডাউকি দিয়ে সহজে এবং কম সময়ে যাওয়া যায় শিলং। তামাবিল সীমান্ত পার হলেই ডাউকি বাজার। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সরাসরি চলে যেতে পারেন চেরাপুঞ্জি।
যাওয়ার সময় ঘুরে যেতে পারেন এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলাইনং থেকে। এটি মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসিয়া পাহাড় জেলায় অবস্থিত একটি গ্রাম। এখানে যাওয়ার পথেই দেখা মিলবে অনেকগুলো ঝর্ণা। চোখ পড়লে সেখানে আপনি নিজেই থেমে যাবেন। তবে বৃষ্টি না হলে ঝর্ণায় পানির পরিমাণ খুবই কম থাকে।
ঝর্ণা আর মাওলাইনং দেখা সঙ্গে চেরাপুঞ্জি যেতে পথের দু'পাশে দেখা মিলবে উঁচু নিচু সব পাহাড়। মনে হবে সব পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আপনি সবচেয়ে উঁচু পাহাড় দিয়েই যাচ্ছেন। চেরাপুঞ্জিতে থাকার জন্য অনেক হোটেল ও হোম স্টে সার্ভিস রয়েছে। যাওয়ার আগে এগোডা, মেক মাই ট্রিপ বা বুকিং ডট কম থেকে বুকিং দিয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ সেখানে হোটেল ও হোম স্টে সার্ভিসগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কোথাও একসঙ্গে এসব পাবেন না। তাই গিয়ে খুঁজতে চাইলে ভ্রমণের আনন্দ অনেকটাই নষ্ট হতে পারে। কারণ ডাউকি থেকে সব দর্শনীয় স্থান থেকে চেরাপুঞ্জি যেতে যেতে দুপুর ৩-৪টা বেজে যাবে।
হোটেল বা হোম স্টে সার্ভিস নিতে দুই জনের জন্য প্রতি রাত খরচ হতে পারে ২০০০ - ২৫০০ রুপি। ডাউকি বাজার থেকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে চেরাপুঞ্জি যেতে ট্যাক্সি ভাড়া নেবে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ রুপি।
দ্বিতীয় দিন (সেভেন সিস্টার ফলস)
সকালবেলা উঠেই হোটেল চেক আউট করে সরাসরি চলে যাবেন সেভেন সিস্টার ফলস। এটি চেরাপুঞ্জির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। বৃষ্টি হলে এর সৌন্দর্য আপনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই জলপ্রপাত এর উচ্চতা ১,৪৮৪ মিটার।
চেরাপুঞ্জির স্থানীয় নাম সোহরা বা সোরা। সেভেন সিস্টার ফলস দেখে যেতে পারেন মোসামাই গুহা। যার ভেতরের চারপাশে শুধুই পাথর। এই প্রাকৃতিক গুহায় প্রবেশের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে। চেরাপুঞ্জিতে সেভেন সিস্টার ফলস ও মোসামাই গুহা দেখার পর কয়েকটি ঝর্ণা দেখতে পারেন। এখানেও অনেকগুলো বড় ঝর্ণা রয়েছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন তা ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ এসব জায়গা দেখা শেষ করে যেতে পারেন শিলং।
চেরাপুঞ্জি থেকে সব দর্শনীয় স্থান থেকে শিলং যেতে যেতে দুপুর ২-৩টা বেজে যাবে। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে শিলং যেতে ট্যাক্সি ভাড়া নেবে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ রুপি। শিলং গিয়ে পছন্দ করে হোটেল ঠিক করে নিতে পারেন। শিলং এর পুলিশ বাজারের পাশের হোটেল গুলোতেই পর্যটকরা বেশি থাকেন। এখানকার সেন্টার পয়েন্টের পাশে অনেক হোটেল রয়েছে।
তৃতীয় দিন (শিলং)
সকালবেলা উঠে লাইট লুম চলে যাবেন। শিলং পুলিশ বাজার থেকে এখানে যেতে সময় লাগবে ৪০-৪৫ মিনিট। এখানকার সৌন্দর্য
লিখে শেষ করা যাবে না। পাহাড়ের উপর সবুজ উঁচু নিচু মাঠ। মাঠের তিন পাশে মেঘের ভেলা। সবুজ মাঠে বসে চায়ে চুমুক দিতেই এক পশলা মেঘ এসে আপনাকে ভিজিয়ে দিতে পারে।
লাইট লুম থেকে ফিরে এদিন শিলং শহরের পাশে উমিয়াম লেক, এলিফ্যান্ট জলপ্রপাত, শিলং ভিউপয়েন্ট, গলফ লিংক, ওয়ার্ডস লেক ঘুরে আসতে পারে। এছাড়াও গাড়ির ড্রাইভার এর সঙ্গে চুক্তি করে স্পটগুলো নির্ধারণ করতে পারবেন। শুধু লাইট লুম দেখতে চাইলে ট্যাক্সি খরচ পড়বে ১৫০০ রুপি। সঙ্গে অন্যান্য জায়গা দেখতে চাইলে ২৫০০ থেকে ৩০০০ রুপি খরচ হবে।
সব জায়গা দেখা শেষ করে শপিং করতে পারেন। শিলংয়ে পুলিশ বাজারেই বিশাল নামের একটা সুপার শপ আছে সেখান থেকে শপিং করতে পারেন। এছাড়াও আশে পাশে অনেক হকার্স মার্কেট রয়েছে।
কেনাকাটা শেষে একটু সিনেমা দেখে নিতে পারেন। শিলংয়ে একটি ভালো সিনেপ্লেক্স রয়েছে। অঞ্জলি নামের এই সিনেপ্লেক্সটি পুলিশ বাজার থেকে হেটে যেতে ১৫ মিনিট সময় লাগবে। আর ট্যাক্সিতে যেতে ১০০ থেকে ১৫০ রুপি ভাড়া নেবে।
চতুর্থ দিন (ডাউকি)
ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ৭টার মধ্যে ডাউকির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেন। ডাউকি সীমান্ত আসার আগে স্নোনেংপেডেং যেতে পারেন। স্নোনেংপেডেং এর স্বচ্ছ পানির নদী আপনাকে মুগ্ধ করবেই। চাইলে নৌকা নিয়ে ঘুরতে পারেন।
শিলং থেকে স্নোনেংপেডেং হয়ে ডাউকি সীমান্তে আসতে ট্যাক্সিতে খরচ হবে ২৫০০-৩০০০ রুপি। সবশেষে বিকেল ৫টার মধ্যে ইমিগ্রেশন শেষ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবেন।
দরকারি তথ্য
১. ভারতের মেঘালয়ের শিলং ভ্রমণের জন্য আপনার পাসপোর্টে ৬ মাসের মেয়াদসহ বাই রোড ডাউকি পোর্ট দিয়ে ভিসা থাকতে হবে।
২. ভ্রমণ কর ৫০০ টাকা ঢাকা, সিলেট বা তামাবিল সীমান্তের সোনালী ব্যাংকে দিতে পারেন। তবে ঢাকা থেকে যারা যাবেন তারা ঢাকায় দিয়ে গেলে কম সময়ে ইমিগ্রেশন শেষ করতে পারবেন।
৩. ভারত ভ্রমণের জন্য ডলার বা টাকা নিয়ে যেতে পারেন। ইমিগ্রেশন শেষ করে ডাউকি বাজার থেকে রুপি করে নিতে পারেন। শিলং এর চেয়ে ডাউকি বাজারে ভালো রেট পাবেন।
৪. সব জায়গায় ট্যাক্সি নেওয়ার আগে দামাদামি করবেন। কমপক্ষে ৩ জনের সঙ্গে কথা বলবেন। সব জায়গার মানুষজন বাংলা মোটামুটি বুঝেন।
৫. মেঘালয়ে যাওয়ার আগে অবশ্যই হোটেল বুকিং দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
৬. মেঘালয় ভ্রমণের জন্য ৪ জনের দল হলে সবচেয়ে ভালো। কারণ এক ট্যাক্সিতে ৪ জনের জায়গা হওয়াতে যাতায়াত খরচ কমবে।
কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সিলেটে বাস, ট্রেন বা আকাশপথে যেতে পারেন। সিলেট থেকে বাস, সিএনজি বা গাড়িতে যেতে হবে তামাবিল সীমান্তে।
খাবার
মেঘালয়ের সব জায়গায় ভেজ ও নন-ভেজ থালি পাওয়া যায়। এছাড়াও মেনু থেকে পছন্দ অনুযায়ী খাবার নিতে পারেন। তবে খাবারের স্বাদ বাংলাদেশের খাবারের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। এজন্য জায়গা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রেস্টুরেন্টের খাবার টেস্ট করতে পারেন।
খরচাপাতি
ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট। এরপর সিলেট থেকে সিএনজিতে তামাবিল। ডাউকি থেকে ট্যাক্সিতে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে চেরাপুঞ্জি। চেরাপুঞ্জিতে হোটেলে থাকা। আবারো অনেক জায়গা ঘুরে শিলং। হোটেলে থেকে লাইট লুম হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ট্যাক্সিতে। সিনেমা দেখে সকালে স্নোনেংপেডেং ঘুরে আবারো তামাবিল থেকে সিএনজি, সিলেট থেকে ট্রেনে ঢাকা। তিন রাত হোটেলে থাকা, খাবার, ট্যাক্সি ভাড়া, ভ্রমণ কর, সিএনজি ভাড়া, ট্রেন ভাড়াসহ সব মিলে ৩ রাত ৪ দিনে আপনার খরচ হবে বাংলাদেশি টাকা ১৫ হাজার টাকা। তবে আপনার ভ্রমণ দলের সদস্য হতে হবে কমপক্ষে ৩ জন এবং সর্বোচ্চ ৪ জন।
এএ