ব্রাজিলকে হারিয়েই ২৮ বছরের খরা কাটিয়ে কোপা জিতল মেসির আর্জেন্টিনা
শেষ বাঁশি বাজতেই আর্জেন্টিনা ফেটে পড়ল উল্লাসে। আনহেল ডি মারিয়ার একমাত্র গোলে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারানো হয়ে গেছে, কোপা আমেরিকা জেতা হয়ে গেছে যে।
২৮ বছর, সেই ২৮ বছর আগে সর্বশেষ শিরোপাটা উঠেছিল আর্জেন্টিনার ঘরে। এরপর থেকে বছর আসে বছর যায়, আর্জেন্টিনার ট্রফিকেস পড়ে থাকে শূন্য। সে শূন্যতা কাটানোর মাহেন্দ্রক্ষণ অবশেষে হাজির। চলতি শতাব্দিতে প্রথম শিরোপা, যেটা আলবিসেলেস্তেদের সোনালি প্রজন্ম করে দেখাতে পারেনি সেটাই করলো লিওনেল স্ক্যালোনির প্রায় আনকোরা দলটা। আর্জেন্টিনার তো আজ আনন্দে-উল্লাসে ফেটে পড়ারই কথা!
সেই রিও ডি জেনিরো। আবার সেই মারাকানা। দুইদিন পরই আরও একটা জন্মদিন যে 'প্রিয় অসুখের' তার জন্মভূমি মারাকানাতেই খরাটা কাটাল আর্জেন্টিনা, তাও আবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে। ঈশ্বর কি আর্জেন্টিনার, লিওনেল মেসির, কিংবা আজকের জয়ের নায়ক আনহেল ডি মারিয়ার চিত্রনাট্যটা এর চেয়ে ভালো কোনোভাবে লিখতে পারতেন? হয়তো, হয়তো না!
অথচ ফাইনালে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা মহারণের আগে কু গাইছিল সেই আসরের প্যারানয়া। ফাইনালের আগ পর্যন্ত সেবারের সঙ্গে এবারের মিলটা দেখুন। সেবার সেমিফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে নায়ক বনে গিয়েছিলেন সার্জিও রোমেরো, এবার বনলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। সেবারের ফাইনাল মারাকানায়, এবারেরটাও। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতি এবার ফিরে আসে না কী করে?
সেবারের সঙ্গে এবারের অমিলও আছে বৈকি। সেবার আর্জেন্টিনার আফসোস বাড়িয়ে ফাইনালে খেলতে পারেননি আনহেল ডি মারিয়া। এবারও শুরুর একাদশে থাকার কথা ছিল না, অন্তত টুর্নামেন্টজুড়ে দলের প্রথম একাদশ দেখলে, বিরতির পর মাঠে নেমেই তার প্রভাব দেখলে তেমনই মনে হওয়ার কথা। সেই ডি মারিয়াকেই কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি নামিয়ে দিলেন শুরুর একাদশে।
চমক ছিল তার অবস্থানেও। ভাবা হচ্ছিল, দলে জায়গা পেলেও হয়তো ফরোয়ার্ড লাইনে নিকো গঞ্জালেসের পরিবর্তে লেফট উইংয়ে হবে তার জায়গা, কিন্তু ম্যাচে দেখা যায় তিনি খেলছেন রাইট উইংয়ে। স্ক্যালোনির এই কৌশলের ফায়দাও পেয়েছে আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসির রাইট উইং থেকে ভেতরে চলে আসেন পিচের ভেতরের দিকে, সঙ্গে টেনে আনেন তাকে মার্ক করা ডিফেন্ডারকেও। ফলে ডি মারিয়া বেশ কবার ফাঁকায় বল পেয়েছেন, আক্রমণে ত্রাস ছড়িয়েছেন ব্রাজিল রক্ষণে।
এ দশকেই আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলেছে আরও তিনটে। তার সব আসরেই আলবিসেলেস্তেদের এ যাত্রার প্রধান কুশীলব ছিলেন মেসি। কিন্তু ফাইনালের চাপ সামলাতে যেন আর একজনের সাহায্য চাই তার। আগের তিন ফাইনালে ছিলেন সাহায্য ছাড়া। ফল, অবধারিত হার।
এবার পেলেন। আনহেল ডি মারিয়ার। তবে সাহায্য বলা চলে কিনা তা নিয়ে একটা আলোচনা হতেই পারে। একমাত্র গোলে যে নেই মেসির বিন্দুমাত্র অবদানও! ২১ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে রদ্রিগো দি পলের করা লম্বা বল ডান প্রান্তে থাকা রেনান লোডিকে বিট করে চলে যায় ডি মারিয়ার কাছে। এরপর সামনে থাকা গোলরক্ষক এডারসনকে দারুণ এক চিপে বোকা বানিয়ে গোলটি করেন মারিয়া। আর্জেন্টিনা পেয়ে যায় মহামূল্য, পরম আরাধ্য সে গোল। যার অপেক্ষায় দলটা থেকেছে প্রায় ১৬ বছর। ২০০৫ সালের কনফেডারেশন্স কাপের ফাইনালে গোলের পর থেকে যে আর গোলের দেখা পায়নি আকাশী সাদারা!
সে খরা কাটল। কিন্তু শিরোপার? তা নিয়ে সংশয় ছিল। শুরু থেকেই তো। একের পর এক ব্রাজিলীয় আক্রমণ এসে আছড়ে পড়ছিল আর্জেন্টাইন রক্ষণে। গোলের আগ পর্যন্ত অন্তত। সফলতা অবশ্য পায়নি কিন্তু তখন সেসব আক্রমণ ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।
২১ মিনিটে ডি মারিয়ার সে গোল আর্জেন্টিনাকে ধাতস্থ করেছে ম্যাচে, দিয়েছে স্নায়ু ধরে রাখার সঞ্জীবনী সুধা। বেশ কিছু আক্রমণেও উঠেছে বিরতির আগে। তাতেও মেলেনি সফলতা। তবে ক্ষতিও হয়নি খুব একটা, ডি মারিয়ার গোলে পাওয়া লিডটা যে ছিল অক্ষত!
পুরো টুর্নামেন্টে যেমন হয়েছে, এক গোলের লিডের পর রক্ষণাত্মক হয়ে পড়ার কৌশলে চলে গেছে আর্জেন্টিনা। মহারণের পরের অর্ধে তাই হয়েছে। ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো, নিকলাস অটামেন্ডিরা ব্যস্ত ছিলেন নেইমার, রিশার্লিসন, ফিরমিনোদের আক্রমণ সামলাতেই। একটা গোল তো হজম করেই ফেলেছিল। লাইন্সম্যানের বাঁশি বেজেছিল বলে বাঁচোয়া।
কিন্তু এরপরও ব্রাজিলের আক্রমণ থামেনি, আর্জেন্টাইন দেয়াল অবশ্য সেসব সামলাচ্ছিল ভালোভাবেই। ৭৫ মিনিটে ম্যাচের সবচেয়ে বড় সুযোগটা পেয়েছিল ব্রাজিল। সেটা গোল হয়ে গেলে সমতাও চলে আসত ম্যাচে। কিন্তু রিশার্লিসনের সেই শট দারুণভাবে ঠেকিয়ে আর্জেন্টিনার জাল অক্ষত রাখেন সেমিফাইনালের নায়ক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ।
প্রতি আক্রমণে আর্জেন্টিনাও কম ত্রাস ছড়াচ্ছিল না ব্রাজিল রক্ষণে। ৮৮ মিনিটে মেসির গোলটা হয়ে গেলে আরও মিনিট সাতেকের অপেক্ষাটাই থাকত না আর্জেন্টিনার। কিন্তু রদ্রিগো ডি পলের বাড়ানো বলটা আয়ত্বে নিয়েও গোল করতে পারেননি মেসি। এরপর কেটেছে একে একে আরও সাত মিনিট। আর্জেন্টিনা চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় সামলেছে সব আক্রমণ। এরপর বাজল শেষ বাঁশি, এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অবিশ্বাস্য সে মুহূর্ত। যার অভাব আর্জেন্টিনাকে ২৮ আর মেসিকে পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই উপহার দিয়েছে হতাশা, সে অভাব ঘুচল। আর্জেন্টিনা বনে গেল কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন।