Mohammed Siraj: অটোরিকশা চালক বাবা আর সন্তানের ত্যাগের গল্প
কলম্বোর আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে গুটিকয়েক ভারতীয় সমর্থক তখন সিরাজ, সিরাজ বলে গলা ফাটাচ্ছেন। ক্যামেরার ল্যান্সে বারবার ধরা দিচ্ছে একটাই মুখ। কমেন্ট্রিবক্সে বসে যেন বিশেষণ খুঁজে ফিরছেন ধারাভাষ্যকাররা। একেকটা উইকেট শিকার আর সিরাজকে ঘিরে সতীর্থদের বাঁধভাঙা উল্লাস। এতসব কিছুর মাঝেও কী সিরাজের মনে পড়েনি অটোরিকশা চালক বাবার কথা! ঢের পড়েছে। সেই সঙ্গে চাপা একটা ব্যথাও হয়তো কিছুটা কাতর করেছে ভারতীয় এ পেসারকে।
সিরাজের প্রয়াত বাবা মোহাম্মদ গাউস পেশায় ছিলেন অটো রিকশাচালক। ছেলের অনুশীলনে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন দিতেন সত্তর রূপি করে, স্বপ্ন ছিল ছেলে মোহাম্মদ সিরাজকে দেখবেন ভারতের জার্সিতে। মোহাম্মদ গাউসের সে স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে বটে, নিজে ততক্ষণে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। স্বপ্নপূরণের পর বাবার কবরের পাশে গিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন সিরাজ। সেই সিরাজ এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে আলোচিত ক্রিকেটার। তার হাত ধরে চার বছর পর আবারো এশীয় ক্রিকেটের রাজত্ব ফিরে পেয়েছে ভারত।
গতকাল (রোববার) এশিয়া কাপের ফাইনালে এক সিরাজেই যেন লণ্ডভন্ড হয়ে গেছে শ্রীলঙ্কা। ভারতীয় এই পেসারের তোপে একেবারেই উড়ে গিয়েছে লঙ্কানদের ব্যাটিং লাইন-আপ। মাত্র ২১ রান খরচায় নিয়েছেন ৬ উইকেট। এক ওভারেই কুপোকাত করেছেন চার ব্যাটারকে। পরে ৫০ রানেই অলআউট হওয়া শ্রীলঙ্কাকে ১০ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে ভারত। সেই সঙ্গে লঙ্কানদের কাছ থেকে এশিয়া কাপের শিরোপাও পুনরুদ্ধার করেছে রোহিত শর্মারা। ম্যাচসেরা নির্বাচিত হয়েও সবাইকে মুগ্ধ করেছেন সিরাজ। পুরস্কারের সব টাকা মাঠকর্মীদের বিলিয়ে দিয়েছেন।
‘বাবাকে আর রিকশা চালাতে হবে না’
২০১৭ সালের কথা। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) নিলামে হইচই ফেলে দিলেন কোথাকার কোন মোহাম্মদ সিরাজ। ভিত্তিমূল্য মাত্র ২০ লাখ রুপি থেকে দুই কোটি ষাট লাখ রুপি দিয়ে অখ্যাত এই পেসারকে দলে ভেড়ায় সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। ধীরে ধীরে সামনে আসতে থাকে তার একের পর এক অজানা গল্প। ছেলেটার বাবা অটোরিকশা চালান। অনেক সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন। সিরাজ সেসময় দরদভরা গলায় বলেছিল, ‘বাবাকে এই বয়সে আর রিকশা চালাতে হবে না।’
সিরাজ যে পরিবারে বেড়ে উঠেছেন, এমন পরিবারে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নকে বিলাসিতা মনে হতে পারে। তবে সিরাজের বাবা মোহাম্মদ গাউস ছিলেন ব্যতিক্রম। হাসিমুখে পরিশ্রম করে কেবল পরিবারের অন্নই জোটাননি। ছেলে হতে চায় পেসার। তার জুতোয় লাগবে দামী স্পাইক। যে করেই হোক, তার অর্থ ঠিকই যোগার করে এনেছেন গাউস।
ক্রিকেটের জন্য বাবাকে শেষ দেখা দেখেননি সিরাজ
সেবার আইপিএল চলার মাঝপথেই শুনেছিলেন বাবার অসুস্থতার কথা। আরব আমিরাতে বসে জানতে পারলেন বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেই বিরাট টেনশনের মধ্যেও তিনি পারফর্ম করে গেছেন, বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য। সীমিত ওভারে ভারতীয় জার্সিতে অভিষেক আগেই হয়েছে। সাদা পোশাকের দুয়ারটাও খোলা। হবে বাবার চূড়ান্ত স্বপ্নপূরণ, সিরাজ তাই ফিরবেন না, শেষবারের মত দেখবেন না বাবাকে। বাবা সেসময় হাসপাতালে শুয়ে পত্রিকা পড়তেন। ছেলেকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘সবগুলো খবরের কাগজে তোমার ছবি ছাপা হয়েছে।’
দুবাই হয়ে ভারত তখন পা রেখেছে অস্ট্রেলিয়ায়। দলের সঙ্গে আছেন মোহাম্মদ সিরাজও। দলে ডাক পেয়েছেন, আছে অভিষেকের হাতছানি। তবে তা ঢেকে আছে কিছুটা শঙ্কার মেঘে। বুমরাহ-শামি-উমেশদের মতো বিশ্বমানের পেসারদের ভিড়ে অভিষেক হবে তো? এমনই সময় শুনলেন দুঃসংবাদ, সিরাজের সাদা পোশাক গায়ে চড়ানোর স্বপ্নদ্রষ্টা বাবা মোহাম্মদ গাউস আর বেঁচে নেই।
কোয়ারেন্টিন নীতিমালার চোখরাঙানি ছিল। বাবাকে শেষ বারের মতো দেখতে ভারতে ফিরে এলে শঙ্কা ছিল সিরিজ থেকেই ছিটকে যাওয়ার। সেটা হলে যে বাবার স্বপ্নটাও সত্যি হতো না! সিরাজ তাই সিদ্ধান্ত নিলেন থেকে যাওয়ার। ভারতীয় দলে বাবা-মাকে হারানোর পরপরই ম্যাচে নামার নজির আছে বেশুমার।
সবচেয়ে বিখ্যাত দুই ইতিহাস আছে শচীন টেন্ডুলকার আর বিরাট কোহলির। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের মাঝামাঝিতে বাবাকে হারানো টেন্ডুলকার দেশে ফিরে বাবার শেষকৃত্য করেই ফিরেছিলেন বিলেতে, রানের বন্যাও বইয়ে দিয়েছিলেন টুর্নামেন্টের বাকি অংশে। কোহলি খেলছিলেন কর্নাটকার বিপক্ষে এক ম্যাচ, এরই মাঝে বাবার মৃত্যুর খবরটা পান। তবু ইনিংস চালিয়ে যান, যা শেষমেশ দিল্লিকে নিশ্চিত হারের কবল থেকে বাঁচায়।
তবে সিরাজের ব্যাপারটা ছিল আলাদা। টেন্ডুলকার-কোহলি কিংবা ভারতীয় ক্রিকেটের বাকি সব বাবা হারানো খেলোয়াড়রা শেষবারের মতো বাবাকে দেখতে পেয়েছেন। সিরাজ বড় করে দেখেছেন সদ্যপ্রয়াত বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়নকে।
ভাগ্যিস বড় করে দেখেছিলেন! মোহাম্মদ শামির চোটে দ্বিতীয় টেস্ট থেকে সুযোগ পেয়ে তুলে নিয়েছেন দলের সিরিজসেরা ১৩ উইকেট। দলের অবিস্মরণীয় ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে কাজ করেছেন বড় কুশীলব হিসেবে। ভারতে ফিরে এলে কি তেমনটা হতো?
পরে হায়দ্রাবাদে ফিরে ঘরে ঢোকার আগেই সিরাজ ছুটে গিয়েছিলেন বাবার কবরের পাশে। বাবার পাশে গিয়ে বসলেন বটে, কথা হলো না। হয়তো মনে মনে বলছিলেন, বাবা আমি তোমার স্বপ্নপূরণ করেছি। গতকাল কলম্বোয় আরেকবার নিজের স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়া ম্যাচশেষেও এমন কথা ভাবেননি, কে জানে!
এফআই