সব জবাব পারফরম্যান্সেই দেন সাকিব
নন্দিত থেকে নিন্দিত, আবার সেই নিন্দিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন জননন্দিত। সব সমালোচনার জবাব তিনি ব্যাট-বলেই দিতে ভালোবাসেন। দুটি বাক্যই বলে দেয়- এই আলোচনা বাংলাদেশের তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে নিয়ে। এই তো ভারতের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচেই তো সেটি ফুটে উঠেছে। যার একদিন আগেও বিজ্ঞাপন ও নির্বাচনী কাজে ঢাকায় আসায় তুমুল সমালোচনা হয়েছে সাকিবকে নিয়ে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরাজয়ে এশিয়া কাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয় টাইগারদের। ঠিক তার পরদিনই ১০ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই ঢাকায় পা রাখেন সাকিব। মুশফিকুর রহিম পারিবারিক কারণে দেশে ফিরবেন সেটি জানা থাকলেও, সাকিবের ফেরাটা কেউ সহজভাবে নেননি। এরপর দেশে অবস্থান করেছেন দুই দিনেরও বেশি সময়। জানা গেছে, ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংসদ ভবনে দেখা করেছেন সাকিব। গুঞ্জন রয়েছে, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চান।
এছাড়া আল-আমিন ক্যামিকেলস নামে এক শো-রুম উদ্বোধন করার কথাও জানা গেছে। যদিও সেটার সত্যতা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কায় পোঁছান সাকিব, পরে রাতে দলের অনুশীলনেও যোগ দেন। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে নামার আগে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন টাইগার অধিনায়ক। হয়তো আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছেন প্রশ্ন-বানের কথা!
যেন সেই প্রস্তুতি নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের সামনে এসেছিলেন। এরপর প্রশ্নের উত্তরে দিয়েছেন ‘এলোপাতাড়ি’ সব উত্তর। শুরুতে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন সাকিব, ‘আপনি নামলে কি করতেন নামার আগে? আমরাও সেটাই করব (জয়ের জন্য)।’
দলের দুর্বলতা নিয়ে কোনো কাজ হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে সাকিব বলেছিলেন, ‘এগুলো আসলে মিডিয়াতে বলার বিষয় না– কোন জায়গা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট, কোন জায়গা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট না। এগুলো টিম ম্যানেজমেন্টের আলোচনা করার বিষয় এবং ওখান থেকে সমাধান বের করার বিষয়।’
এক সময় সাকিবের দিকে ধেঁয়ে আসে ঢাকার বাতাস থেকে ছড়ানো সেই নির্বাচনের প্রশ্ন। সেই প্রশ্নেও সাকিব দিয়েছিলেন কড়া উত্তর, ‘আমি এখানে শুধু ভারত ম্যাচ নিয়ে কথা বলছি, অন্য কিছু না (নির্বাচন ইস্যুতে)।’
একদিকে ঢাকায় শো-রুম উদ্বোধন এবং অন্যদিকে ভারত ম্যাচের আগে এমন ‘মারমুখী’ সংবাদ সম্মেলন; সবমিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে হাসির পাত্র বনে যান সাকিব। অবশ্য রাতারাতি এই পরিস্থিতি বদলানো অসম্ভব পর্যায়ের। যার জন্য দরকার ভারতকে হারানো, সঙ্গে সাকিবের কড়া পারফর্ম!
বাংলাদেশ ক্রিকেটে যতবারই সাকিবকে নিয়ে এমন সমালোচনার তীর ছোড়া হয়েছে ঠিক ততবারই তিনি ফিরেছেন বীরের বেশে। ভারত ম্যাচের আগের রাতে অনেকে কটাক্ষ করেও সাকিবের নাম দিয়েছেন ‘শো-রুম আল হাসান।’ অবশ্য তাতে সাকিবের থোড়াই কেয়ার! যুগেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বসেরার তকমা লাগানো এই ক্রিকেটার তো জানেন ফেরার তরিকা- সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার প্যারাসিট্যামল!
আরও পড়ুন >> ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকলে সাকিবই এগিয়ে আসেন’
ভারতের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৫৯ রানেই ৪ উইকেট হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে বাংলাদেশ দল। সেখান থেকে এগিয়ে নিতে নাবিকের ভূমিকা নেন সাকিব। খেললেন ৮৫ বলে ৮০ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস। অধিনায়কের সেই ভিত গড়ার পরে তো তাওহীদ হৃদয়, নাসুম আহমেদ ও শেখ মেহেদীরা সমুদ্র জয়ের শক্ত পুঁজি এনে দেন দলকে।
ব্যাটের পর বল হাতেও ভারতীয় দলের ব্যাটারদের শাসন করতে দেখা গেছে সাকিবকে। ক্রিকেট বাজারে আসা নতুন ‘৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটার’খ্যাত সূর্যকুমার যাদবকে তিনি প্যাভিলিয়নে পাঠান। টাইগার অধিনায়কের করা বলকে সুইপ করতে গিয়ে যেন এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে আটকান যাদব। নিজের কোটা পূরণ করে ১০ ওভার শেষে ৪৩ রান খরচায় সাকিব নেন ১ উইকেট।
মাঠে অধিনায়ক হিসেবেও সাকিবকে লেটার মার্ক দিতে বাধ্য হবেন যে কেউই। তরুণ ক্রিকেটারদের মাঠে যেমন সাহস দিয়েছেন, জয়ের তাড়না ধরে রেখেছিলেন প্রতি মুহূর্তে। সাধারণ চোখে দৃশ্যমান ছোট অথচ বড় ঘটনা বলা চলে যাকে। ভারতীয় ব্যাটার অক্ষর প্যাটেল যখন শেষদিকে শেখ মেহেদীকে চারের বাউন্ডারি মারলেন, টাইগার স্পিনার তখন নিজের কলারটা নামিয়ে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সাকিব তার কাছে উপস্থিত হয়ে নিজ হাতে উঁচিয়ে দেন মেহেদীর কলার।
ভারতকে হারানোর পর তরুণ ক্রিকেটারদের উৎসাহ ও প্রশংসায় পিঠ চাপড়ে দেন সাকিব। টিম হোটেলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তানজিম সাকিব এবং তানজীদ তামিমকে দিয়ে ম্যাচ জয়ের কেক কাটান। তামিম শুরুতে আসতে না চাইলেও অধিনায়কের অনুরোধে কেক কাটায় শামিল হন পরে। পাশে দাঁড়িয়ে হাত তালিতে শুভেচ্ছা জানান টাইগার অধিনায়ক।
আরও পড়ুন >> বাঁ-হাতি স্পিনে সাকিবের অনন্য অর্জন
এমন জয়ের পর মুহূর্তেই পাল্টে যায় আগের রাতে করা সামাজিক মাধ্যমের সব ট্রল। নিন্দুকেরা যোগ দেন সাকিব বন্দনায়, ভালোবাসার জোয়ারে ভাসিয়ে লিখেছেন সব আবেগঘন বাক্য। সাকিব তো এমনই, বিশ্ব ক্রিকেটে প্রায়শ-ই সমালোচনার মুখে পড়া এই ক্রিকেটার জবাবটা দেন পারফর্ম করে।
সাকিব জানেন সমালোচনার উত্তর মুখ দিয়ে নয়, দিতে হয় পারফর্ম করে। তাইতো বলা যায় ভালো তো সবাই বাসতে পারে, কজনই বা পারেন ভালোবাসতে বাধ্য করতে। আর যারা পারেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন সাকিব আল হাসান। বিশ্বক্রিকেটে সাকিব এই একজনই। ভালোবাসার ভাষায় বলা যায় প্রেমিকের দেওয়া একেকটা কাঁটাও যেন গোলাপ। সাকিবও যেন ঠিক সেই কাঁটাযুক্ত গোলাপ!
ভারত বিশ্বকাপ কড়া নাড়ছে দরজায়। ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টাইগাররা বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করবে। তার আগে অগ্রিম লক্ষ্যের কথাও জানিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। বলেছেন, বিশ্বকাপে সব ক্রিকেটার সুস্থ থাকলে বাংলাদেশ দল হবে ভয়ঙ্কর। অবশ্য এমন ভয়ঙ্কর দলকেই তো গেল ২৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে চাইছে দেশের আপামর ক্রিকেটভক্তরা। বিশ্বসেরার হাত ধরেই আসুক কোনো আইসিসির ট্রফি এমনটাই চাওয়া স্বয়ং সাকিবের নিন্দুকেরও!
এসএইচ/এএইচএস