দর্শকদের কথা ভেবেও বাংলাদেশের ভালো খেলা উচিত, বললেন আজহারউদ্দিন
দ্বিধায় পড়ে যেতে হয়! দুবাইয়ে শহর ছাড়িয়ে দূরে কোথাও গেলে সেখানেও শহর! গ্রাম বলে এখানে আদতে কিছু নেই। সব জায়গাতেই নান্দনিক সব অট্টালিকা। অর্থ হলেই বিলাসবহুল জীবন গোটা সংযুক্ত আরব আমিরাতেই। শনিবার রাতে আমন্ত্রণ ছিল আল হাবতোর পোলো রিসোর্ট অ্যান্ড ক্লাবে। যদিও ঘোড়দৌড় বিষয়ক কিছু নয়, টি-টেন ক্রিকেটের দল বাংলা টাইগার্সের জার্সি উন্মোচনে গিয়েছিলাম বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা কয়েকজন সাংবাদিক।
যেমনটা শুরু থেকেই দেখছি, দুবাইয়ে যেখানে যাচ্ছি সেখানেই আভিজাত্য যেন ঠিকরে পড়ছে! পোলো খেলার সঙ্গে রয়্যাল একটা ফ্লেভার তো রয়েছেই। মরুভূমিতে লম্বা পথ পেরিয়ে এসে এখানে এমন বিলাসবহুল ক্লাব থাকবে, প্রত্যাশিত নয়।
পোলো ক্লাবে ঢুকতেই দেখা মিলল জার্সি উন্মোচন আয়োজনের পুরোটা আলো কেড়ে নিয়েছেন এই ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তি। দূর থেকে দেখছিলাম, একের পর এক ভক্ত আসছেন আর তিনি সেলফির আবদার মেটাচ্ছেন। একদল উচ্ছ্বল তরুণী আসতেই আজহার বলে উঠলেন, ‘আমি বুড়ো মানুষ, আমার সঙ্গে কী ছবি তুলবে!’ ব্যস, আশপাশে হাসির রোল পড়ে গেল। বয়স হয়েছে, শরীরটাও ভেঙেছে কিছুটা, কিন্তু আজহার কথা-বার্তায় চাল-চলনে আছেন আগের মতোই!
কিন্তু পা দিয়েই যা দেখলাম, তাতে কিছুটা থমকে যেতে হয়েছে। বাংলা টাইগার্সে নাম লেখানো মহা তারকা ফাফ ডু প্লেসিস, শন টেইট, জেমস ফকনাররা আশপাশেই ঘুরছিলেন, কিন্তু তাদের চেয়ে ঢের গ্ল্যামার কেড়ে নিলেন আরেকজন। বয়স ৫৮ ছাড়িয়েও ঔজ্জ্বল্যে সবাইকে ছাড়িয়ে তিনি! খেলা ছেড়েছেন তাও ২১ বছর আগে! কিন্তু ক্রিকেটারের নামটি যখন মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, তখন তো এমনটা অস্বাভাবিক নয়!
পোলো ক্লাবে ঢুকতেই দেখা মিলল জার্সি উন্মোচন আয়োজনের পুরোটা আলো কেড়ে নিয়েছেন এই ভারতীয় ক্রিকেট কিংবদন্তি। দূর থেকে দেখছিলাম, একের পর এক ভক্ত আসছেন আর তিনি সেলফির আবদার মেটাচ্ছেন। একদল উচ্ছ্বল তরুণী আসতেই আজহার বলে উঠলেন, ‘আমি বুড়ো মানুষ, আমার সঙ্গে কী ছবি তুলবে!’ ব্যস, আশপাশে হাসির রোল পড়ে গেল। বয়স হয়েছে, শরীরটাও ভেঙেছে কিছুটা, কিন্তু আজহার কথা-বার্তায় চাল-চলনে আছেন আগের মতোই!
ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা জায়গা তার জন্য তো থাকবেই। সেরা অধিনায়কের তালিকাতেও থাকবেন ওপরের সারিতেই। আর ব্যাটসম্যান আজহারের বন্দনা তো চলল শনিবার রাতেও। উপস্থাপক বারবারই বলছিলেন কব্জির ম্যাজিকে হাঁকানো নান্দনিক সব শটের কথা। কেউ একজন তার সেই হাতটা ছুঁয়েও দেখলেন। যে হাতে কতটা অনায়াসে চার হাঁকাতেন তিনি! সব মিলিয়ে আসলে বাংলা টাইগার্সের এই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন পলো ক্লাবে সেই রাতের সেরা আকর্ষণ!
টেস্টে ৬ হাজার ছাড়ানো রান আর ওয়ানডেতে ৯ হাজার পেরোনো এই কিংবদন্তিকে এত কাছ থেকে দেখে ছবি তোলার লোভটা সামলানো কঠিন। স্থানীয় আর ঢাকা থেকে যাওয়া সাংবাদিকদের সেই আবদার মেটালেন আজ্জু। কথায় আছে, এক ইচ্ছে পূরণের পর তৈরি হয় আরেকটি। এবার কথা বলার আবদারটা ফেলতে পারলেন না তিনি। তবে সময় বেঁধে দিলেন মাত্র ৫ মিনিট!
কিন্তু কে জানত গল্প আড্ডায় সেই সময়টা আরেকটু দীর্ঘ হয়েই উঠবে। কথা বলতে শুরু করলেন হায়দরাবাদের সেই বিস্ময় ক্রিকেটার। যার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল শতরানে, শেষটাও। বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রসঙ্গ উঠতেই বলতে থাকলেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই ভালো উইকেটে খেলা হতে হবে। বাংলাদেশই এখন একমাত্র দেশ যারা দেশের মাঠে টার্নিং উইকেট বানিয়ে খেলে। আর তাদের স্পিনাররা বেশ ভালো সাফল্য পায়। কিন্তু যখনই তারা দেশের বাইরে খেলতে যায়, তখন বল সেভাবে টার্ন করে না। তারপরই তারা সমস্যায় পড়ে যায়। এটাই বড় ব্যাপার, সবার আগে তোমাদের প্লেইং কন্ডিশনটা পাল্টাতে হবে। দেখো, তোমাদের কিন্তু ভাল ফাস্ট বোলারও রয়েছে। উইকেট হওয়া উচিত সুইং বোলার-ফাস্ট বোলারদের জন্যও।’
এরই নাম আসলে অভিজ্ঞতা, চটজলদি ধরে ফেললেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের আসল সমস্যা। ঘুরে ফিরে বিশ্বকাপে যারপরনাই ব্যর্থতার পেছনে বাজে উইকেটে প্রস্তুতির প্রসঙ্গটাও আসে। যেখানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই কি না সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। রানার্স আপ নিউজিল্যান্ডকে কিছুদিন আগেই হারিয়েছে ৩-২ ব্যবধানে। এমন জয়ে লাভটা হলো কী? বিশ্বকাপের মূল পর্বে টানা ৫ ম্যাচে হার। অথচ স্পোটিং উইকেটে খেললে প্রস্তুতিটা অন্তত ভালো হতো! আজহার বলছিলেন, ‘ভাল উইকেটে খেললে তোমরা হয়তো এভাবে দেশের মাঠে একের পর এক জিততে না, কিন্তু কিছু তো শিখতে কীভাবে ভালো উইকেটে খেলা যায়। এটাই তো জরুরি।’
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনকে যখন পাওয়াই গেলো তখন একটা প্রশ্নের লোভ সামলাতে পারলাম না, তার চোখে ভারতের সেরা অধিনায়ক কে? যিনি ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৭ টেস্ট আর ১৭৪ ম্যাচে তার উত্তরটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ১৪ টেস্ট আর ৯০ ওয়ানডে জেতানো অধিনায়ক বলছিলেন, ‘আমি সব সময়ই এটা বলি, কপিল দেব আর সুনীল গাভাস্কার আমার চোখে সেরা অধিনায়ক।’
উত্তরটা ঠিক যুতসই মতো হলো না আমার কাছে। যে মহেন্দ্র সিং ধোনি তার ক্যাপ্টেন্সির জয়ের রেকর্ড তছনছ করে উঠেছেন অনন্য উচ্চতায় তার সম্পর্কে মূল্যায়নটা কী? বিরাট কোহলি নাকি ধোনি কে সেরা আজহারের চোখে?
ভারতের সাবেক এই অধিনায়ক এবার স্বভাবসুলভভাবেই ব্যাট করলেন। বলতে থাকলেন, ‘ধোনি তো বেশি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জিতেছে।’ ব্যস, এটুকু বলেই থামিয়ে দিলেন। মানে এখানে বিতর্ক উস্কে দেওয়ার ইচ্ছে নেই, বিতর্ক যার পায়ে পায়ে সেই আজহারের!
কথা প্রসঙ্গে এসেছে ক্রিকেটারদের সোশাল মিডিয়া ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম ব্যবহার প্রসঙ্গও। যেখানে সীমাহীন সমালোচনার আঁচ এবার লেগেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের গায়েও। এমন হওয়া উচিত নয় বলেই মনে করেন আজহার। বলছিলেন, ‘এটা হওয়া উচিত নয়। দেখো তুমি যদি ভালো খেলো তবে তো তারাই প্রশংসায় মাতে। তুমি তোমার দেশের জন্য খেলো। দর্শকের জন্য খেলে যাও। অন্য কিছু ভাবার দরকার নেই!’
তবে বাংলাদেশের সাংবাদিক পেয়ে কিছুটা স্মৃতির দরজায়ও হাঁটলেন ক্রিকেটার থেকে মাঝে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া আজহার। বলছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশে প্রথম খেলেছিলাম ১৯৮৮ সালে। সেটি ছিল এশিয়া কাপ। যেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের পাশাপাশি খেলেছে শ্রীলঙ্কা। তোমাদের দেশের মানুষ বেশ ক্রিকেট পাগল সেটা তখনই দেখেছি। যে কোনো ম্যাচ বাংলাদেশের মাঠে মানেই গ্যালারি পূর্ণ। এমনকি বাংলাদেশ দেশের বাইরে খেললেও দেখেছি অনেক দর্শক মাঠে আসে। ইংল্যান্ডেই তো এমনটা দেখলাম। এখানেও দেখলাম। তাদের কথা ভেবেও এখন বাংলাদেশ দলকে ভালো খেলা উচিত।’
কথা প্রসঙ্গে এসেছে ক্রিকেটারদের সোশাল মিডিয়া ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম ব্যবহার প্রসঙ্গও। যেখানে সীমাহীন সমালোচনার আঁচ এবার লেগেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের গায়েও। এমন হওয়া উচিত নয় বলেই মনে করেন আজহার। বলছিলেন, ‘এটা হওয়া উচিত নয়। দেখো, তুমি যদি ভালো খেলো তবে তো তারাই প্রশংসায় মাতে। তুমি তোমার দেশের জন্য খেলো। দর্শকের জন্য খেলে যাও। অন্য কিছু ভাবার দরকার নেই!’
কথা বলতে বলতে রাতের বয়স বাড়ে, অস্বস্তিও বাড়তে থাকে আজহারের। নিয়ম মানেন বলেই হয়তো বয়সকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে এতটা সবুজ তিনি। ঘুম পেয়েছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু ভক্তদের আবদার যে শেষই হয় না। ছবি তুললেন, ভিডিও হলো। কত মানুষের আবদার যে রক্ষা করলেন। এমনকি টিকটক স্টারদের সঙ্গে গলা মেলালেন। পাশ থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০০ সালে ব্যাঙ্গালোরে শতরান করা সেই ছিপছিপে গড়নের যুবকটিকে। আমাদের কৈশোরের স্মৃতিতে দূরদর্শনের সাদা-কালো টিভির সেই আজহার, যিনি ইডেনে ৯৬-এ প্রোটিয়াদের বিপক্ষেই শতরান তুলে ছেড়েছিলেন মাঠ।
সব স্মৃতির দল যেন ঝাঁকের ইলিশের মতো ঘুরছে, আলো-আঁধারিতে! মধ্যরাতে এসে অদ্ভুত এক আলো ছড়ালো এখানে। আকাশে চাঁদ পূর্ণ হবে দিনকয়েকের মধ্যেই হয়তো! মনে হচ্ছিল যেন সেই সব দিনটায় ফিরে গেছি, সেই সাদা-কালো বোকাবাক্সের দিনে। যখন প্রিয় আজ্জুর একটা ফ্লিক শট কী যে উন্মাদনা ছড়াতো, কলার উঁচু করা ফিল্ডিং, কোথায় যে হারাল সব।
এই যখন ভাবছি, তিনি মানে আজহারউদ্দিন সব আড্ডা পেছনে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতে শুরু করলেন। আর ছোট্ট করে শেষ পরামর্শটা দিয়ে গেলেন, যা কি না ক্রিকেটার থেকে সাংবাদিক সবাই যত্ন করে বাঁধিয়ে রাখতে পারেন, ‘কখনো হাল ছেড়ো না। লড়ে যাও শেষ অব্দি, কঠিন পরিশ্রম করো। তাহলে তোমার জয় হবেই হবে।’ মিনিট আটের আড্ডা, কী এক মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেলো, যে স্মৃতিতে বুঁদ হয়ে থাকা যাবে অনেক অনেক দিন!
এটি/এনইউ/জেএস