টি-টোয়েন্টির নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া
সংক্ষিপ্ত স্কোর-
নিউজিল্যান্ড: ২০ ওভারে ১৭২/৪ (গাপটিল ২৮, মিচেল ১১, উইলিয়ামসন ৮৫, ফিলিপস ১৮, নিশাম ১৩*, সাইফার্ট ৮*; হেজেলউড ৩/১৬, জ্যাম্পা ১/২৬)।
অস্ট্রেলিয়া: ১৮.৫ ওভারে ১৭৩/২ (ওয়ার্নার ৫৮, ফিঞ্চ ৫, মার্শ ৭৭*, ম্যাক্সওয়েল ২৮*; বোল্ট ২/১৮)।
ফল: অস্ট্রেলিয়া ৮ উইকেটে জয়ী
ফাইনালসেরা: মিচেল মার্শ
টুর্নামেন্ট সেরা: ডেভিড ওয়ার্নার
ফাইনাল শুরুর ৩০ মিনিট আগেই দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে ফিসফাস- ‘জিতে গেল অস্ট্রেলিয়া!’ না, ফিক্সিংয়ের গন্ধ নেই। তারপরও টস জেতার কারণেই অ্যারন ফিঞ্চের হাতে ট্রফি দেখতে পাচ্ছিলেন অনেকে। নিকট অতীতে চোখ রেখে ম্যাচ শুরুর আগেই অনেকে হারিয়ে দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডকে। ঠিক তাই হলো ফাইনালের মঞ্চে। নিউজিল্যান্ডকে ৮ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি জিতল অজিরা! ফাইনাল ঠিক ফাইনালের মতো হলো কোথায়?
টস হেরে রাতের আলোয় দুবাই স্টেডিয়ামে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে কিউইরা কম যায়নি। কেন উইলিয়ামসনের রেকর্ড ছোঁয়া ইনিংসে নিউজিল্যান্ড তোলে ২০ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ১৭২ রান। প্রথম ১০ ওভারে তারা তুলেছিল মাত্র ৫৭ রান। পরের ১০ ওভারে ১১৫! জবাব দিতে নেমে ১৮.৫ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। পথ দেখান ডেভিড ওয়ার্নার আর মিশেল মার্শ। তাদের ব্যাটিংয়ে সপ্তমবারে এসে সাফল্যের সপ্তম স্বর্গে তাসমান পাড়ের দেশ!
অবশ্য ট্রান্স-তাসমান ফাইনাল ঠিক হওয়ার পরই নিশ্চিত ছিল এবার নতুন চ্যাম্পিয়ন দেখতে যাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্ব। দুই প্রতিবেশীর লড়াইটা ঠিক ঠাক জমলো কোথায়? কিউইদের চ্যালেঞ্জকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো ২০ ওভারের বিশ্বকাপের ট্রফিটা নিজেদের করে নিল অজিরা!
কিউইদের ১৭২ রানের জবাব দিতে নেমে অবশ্য শুরুটা ভাল ছিল না অস্ট্রেলিয়ার। দলীয় ১৫ রানে সাজঘরের পথ ধরেন অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ (৫)। কিন্তু এরপরই দুবাইয়ের উইকেটটা চিনে নিয়ে দেখে-শুনে খেলতে থাকেন ডেভিড ওয়ার্নার ও মিচেল মার্শ। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে অজিদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১ উইকেটে ৪৩ রান। ৩৪ বলে ফিফটি তুলে নেন সেমি-ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪৯ করে ফেরা ওয়ার্নার।
অন্যপ্রান্তে তাকে বেশ সঙ্গ দেন মার্শ। তবে হাফসেঞ্চুরি করেই ভুল করে বসেন ওয়ার্নার। ট্রেন্ট বোল্টের পেসের সামনে লাইন মিস করায় উড়ে যায় স্ট্যাম্প! ব্যস, ৩৮ বলে ৫৩ করে ফিরে যান ওয়ার্নার। অস্ট্রেলিয়া তখন ১২.২ ওভারে ২ উইকেটে ১০৭। মার্শ তখন অন্য প্রান্তে অপ্রতিরোধ্য। ৩১ বলে তুলে নেন ফিফটি। অফ ফর্ম কাটিয়ে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলও লড়লেন। দলকে বিশ্বকাপ এনে দিয়ে মার্শ অপরাজিত ৫৫ বলে ৭৭। ম্যাক্সওয়েল ১৮ বলে অপরাজিত ২৮।
দুবাইয়ে শিশির ঝরা রাতে পরে বল করাটা যে কত যন্ত্রণার বুঝলেন টিম সাউদি-অ্যাডাম মিলানেরা। বল গ্রিপ করাটাও কষ্ট হচ্ছিল। অবশ্য এটাও ঠিক, ব্যাটিং উইকেটে আরেকটু বড় হতে পারত নিউজিল্যান্ডের ইনিংস!
তবে কেন উইলিয়ামসন দেখালেন জীবন পেয়ে সেটি কীভাবে কাজে লাগাতে হয়! কেন উইলিয়ামসন বুঝিয়ে দিলেন তার ক্যাচ ফেলে দেওয়ার মাশুল এভাবেই দিতে হয়। ৪৮ বলে ৮৫ রান করে থামলেন কিউই অধিনায়ক। অথচ ব্যক্তিগত ২১ রানেই ফিরতে পারতেন তিনি। মিচেল স্টার্কের ডেলিভারিটি ঠিকঠাক খেলতে পারেননি উইলিয়ামসন। বল উড়ে এসে পড়ে জশ হেইজেলউডের হাতে! কিন্তু বল তো হাতে জমাতেই পারেননি, উল্টো বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে যায়।
তারপর উইলিয়ামসন সেই ২১ থেকে নিজেকে নিয়ে যান ৮৫ রানে।
গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে টানা দুটি বিশাল ছক্কায় ফিফটি তুলে নেন মাত্র ৩২ বলে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সাতটি ফাইনালে তখন অব্দি দ্রুততম ফিফটি ছিল এটিই। জো রুট ও কুমার সাঙ্গাকারার ৩৩ বলের ফিফটির রেকর্ড পেছনে ফেলেন উইলিয়ামসন। ‘ছিল’ বলার কারণ, পরে যে মার্শ ৩১ বলে ফিফটি ছুঁয়ে ছাড়িয়ে গেছেন সেটা!
তবে ‘তখন অব্দি’ বিশ্বকাপ ফাইনালের দ্রুততম ফিফটি ছুঁয়েই থামেননি উইলিয়ামসন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড ছুঁয়ে তবেই থামেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক। পরিস্থিতি বুঝে শেষটায় এসে ঝড় তুলেন তিনি। তবে শতরান করা হলো না। হেইজেলউডের বলে লং অফে ক্যাচ তুলে দেন স্টিভেন স্মিথের হাতে। ১০ চার ও ৩ ছক্কায় ইনিংস থামে ৮৫ রানে। এটিই বিশ্বকাপের ফাইনালে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ। গত বিশ্বকাপ ফাইনালে উইন্ডিজ ব্যাটার মারলন স্যামুয়েলসও তুলেছিলেন ৮৫ রান।
উইলিয়ামসন ছাড়া অন্য কিউই ব্যাটসম্যানদের তেমন আক্রমণাত্মক হতে দেয়নি অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা। দুবাইয়ের ব্যাটিং উইকেটের ফায়দাটাও তেমন নেওয়া হয়নি। ওপেনার মার্টিন গাপটিল ৩৫ বলে ২৮ রান করতেই থামান অ্যাডাম জ্যাম্পা। গ্লেন ফিলিপস ১৭ বলে ১৮। জিমি নিশামও শেষ দিকে ৭ বলে ১৩ রান তুললে কিছুটা স্বস্তি পায় কিউইরা।
বল হাতে হেইজেলউড আগুন ঝরালেন। তার বোলিং ফিগারটা বাঁধিয়ে রাখার মতো ৪-০-১৬-৩! উল্টো পিঠে স্টার্ক ৪ ওভারে দিলেন ৬০ রান। নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে খরুচে বোলিং এটিই। এমনকি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের সবচেয়ে ব্যবয়বহুলও। ২০১২ বিশ্বকাপের ফাইনালে ৪ ওভারে ৫৪ রান দেন লাসিথ মালিঙ্গা।
তবে স্বস্তি এটাই, হতাশায় পুড়তে হলো না স্টার্ককে। ব্যাটসম্যানরা মান বাঁচালেন তার। অবশ্য এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ১৩ ম্যাচের ১২টি জিতেছে পরে ব্যাট করা দল। সন্ধ্যায় শুরু ম্যাচে ১০টিতেই রান তাড়া করা দল জিতল। দুই প্রতিবেশীর লড়াইটা উত্তেজনার বারুদ হতে পারল না! দুই বছর পর আরও একটা বিশ্বকাপ ফাইনালে এসে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলো কিউইদের। কনফেত্তি আর আতশবাজিতে যখন দুবাই স্টেডিয়াম উৎসবে মুখর, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে যখন উড়ছেন অ্যারন ফিঞ্চরা, তখন উইলিয়ামসনরা এক কোণায় দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই ভাবছিলেন ক্রিকেট এতো নিষ্ঠুর কেন?
ক্রিকেট এমনই কাউকে কাঁদায়, কাউকে ভাসায় সাফল্যের আনন্দে! তাসমান সাগরের ঢেউ এক পাড়ে নিয়ে এসেছে সুখের বারতা। আরেক পাড়ে অন্তহীন যন্ত্রণা!
এটি/এনইউ