মরুর বুকে যাযাবর চোখ
সুনীল গঙ্গোপ্যাধ্যায়ের সেই কালজয়ী কবিতার তুমুল জনপ্রিয় লাইনটা বেশ মনে পড়ছিল সেদিন। স্কটল্যান্ডের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে গেলো বাংলাদেশ, বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলা চরম অনিশ্চিত। রাতে ঘুম আসছিল না চোখে, কেউ যখন কথা রাখে না তখন কী দু চোখের পাতা এক হয়! মাথায় শুধু ‘কেউ কথা রাখেনি’ -লাইনটাই আসছিল বারবার। বিশ্বকাপ দেখতে যাবো বলে টিকিট ভিসা, সব ঠিক। মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকদের খেলা দেখতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে যখন দেশ ছাড়বো তখনো কিনা দেশের ক্রিকেটের আকাশে কালো মেঘ!
যখন দেশের শীর্ষ ক্রিকেট কর্তা থেকে শুরু করে একেবারে প্রান্তিক কোন ক্রিকেট ভক্তও টাইগারদের মাটিতে নামিয়ে আনলেন, তখনই আবার কোণঠাসা বাঘ ঘুরে দাঁড়াল। টানা দুই জয়, প্রথমে ওমানের বিপক্ষে। এরপর পাপুয়া নিউগিনিকে নিয়ে খেললেন সাকিব আল হাসানরা। গ্রুপ রানার্স আপ হয়ে বাংলাদেশ পেয়ে গেলো আইসিসি নক আউট বিশ্বকাপের টিকিট!
আরাধ্য অ্যাক্রিডিটেশন
ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধি হয়ে বিশ্বকাপ কাভার করতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি আসার পথটা অবশ্য কোনভাবেই ফুলে সাজানো ছিল না! বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর নতুন স্বাভাবিক সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলও যে দ্বিধার পাহাড়ে ছিল। প্রেসবক্সে থেকে সাংবাদিকদের খেলা কাভারের সঙ্গে ছিল দর্শকদের মাঠে ঢুকতে দেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা। শেষ অব্দি অবশ্য দুটোর সমাধানই মিললো। মাঝ খান থেকে হারিয়ে গেছে কিছুটা সময়!
অ্যাক্রিডেটেশন কার্ড পেতে গিয়ে বেশ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে অনেককেই। তেমন তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে আমারও। আইসিসির অ্যাপ্রুভ পেতে মেইলের পর মেইল করতে হয়েছে মিডিয়া ম্যানেজার রাজশেখর রাও থেকে শুরু করে একাধিক কর্মকর্তাকে। তারপর অনেকটা সময় অপেক্ষা শেষে মিলেছে বিশ্বকাপ কাভারের আনুষ্ঠানিক অনুমতি। তবে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে পা দিয়ে শুক্রবার সেই কার্ডটি পেতে অবশ্য কোন ঝামেলাই হয়নি।
করোনা কালের দুবাই ভ্রমণ
অদৃশ্য শত্রু করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে হাঁপিয়ে উঠেছে বিশ্ব। তবে এই জন্য তো আর সব কিছু থামিয়ে দেওয়া যায় না! যে বিশ্বকাপটা হতে যাচ্ছিল ভারতে, সেটি মধ্যপ্রাচ্যের ওমান-আমিরাতে করতে গিয়ে কী ভোগান্তিতেই না পড়েছেন ক্রিকেটপ্রেমী আর গণমাধ্যমের কর্মীরা। এই যেমন আমাকেই গত ৪৮ ঘণ্টাতেই কিনা পিসিআরে করোনা পরীক্ষা করতে হলো তিন তিনবার! একবার এক প্রাইভেট হাসপাতালে। তারপর ফ্লাইট যেদিন ছিল ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে আসতে হলো ইউএস বাংলার উড়ানে চড়ার ৮ ঘণ্টা আগে! তারপর হাজারো মানুষের সঙ্গে লড়াই। বিশৃংখল এক চেহারাই দেখা গেলো বিমানবন্দরে। নির্বিঘ্নে কিছুই হলো না। তারপরও স্বস্তি বিমানে উঠার আগেই মিলল নেগেটিভ সার্টিফিকেট।
আকাশ পথে ইউএস বাংলার বোয়িং ৭৩৭ বিমান ভ্রমণটা ছিল বেশ উপভোগ্য। একইভাবে ঢাকার বিমানবন্দরে যে এলেমেলো দৃশ্য আর নিয়ম চোখে পড়লো দুবাইয়ে তার বিন্দুমাত্র ছিল না। ২১টি বুথ, যেখানে করোনা স্যাম্পল দিতে কাউকে মিনিট খানেকের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি।
রাতের আলোয় রূপকথার দুবাই
বাংলাদেশে তখন মাঝরাত পেরিয়েছে। দুবাইয়ে তো ঝলমলো রাতের আনন্দ কখনো শেষ হয় না। ১১টা বাজতে যাবে, তখনই পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দরের একটির কাছাকাছি আমরা। ইউএস বাংলার বিমান ক্রু যখন বললেন, সেট বেল্ট বাঁধতে তখন কিনা নিজে চোখ রাখতেই মনে হলো যেন নীচে আলোর রাজ্য, যেন রূপকথার জগতে চলে এসেছি আমরা। রাতের আলোয় যেন মায়ার জগতের হাতছানি দিয়ে যায়!
দুবাই নামটা মুখে আসলেই তো চোখে ভাসে- চোখ ধাঁধানো রঙিন আলোকরশ্মি, আকাশছুঁয়ে যাওয়া নান্দনিক সব অট্টালিকা, বিলাসবহুল হোটেল! বুর্জ আল খলিফা, মরুভূমি সাফারি সব মিলিয়ে বিলাসী এক জগত।
আকাশ থেকে যতোটা সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ল, নিচেও তাই। দৃষ্টিনন্দন দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। নিচে নামতেই ফ্রি ওয়াই-ফাই। আর চারপাশের দৃশ্য দেখে অনেকটা রাজপ্রাসাদের অন্দর মহলের মতো মনে হলো। ট্রানজিটের যাত্রীরা যাতে সময়টা আনন্দে কাটাতে পারেন, সেজন্য কতো কী যে, অল্প সময়ে সেসবও মুগ্ধতা ছড়াল!
আকাশ আর মাটি, যেখান থেকেই আপনি দুবাইকে দেখুন না কেন, হ্যামিলনের বাঁশিওলার মতো আপনাকে টেনে নেবেই! মরুর বুকের এই দেশটিতে এবার মাহমুদউল্লাহরা মুগ্ধ করতে পারলেই হয়!