রাত পোহালেই বঙ্গভঙ্গ
বঙ্গভঙ্গ।
আপামর বাঙালির জীবনের নিষ্ঠুরতম, ক্রুরতম শব্দ। পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষার চার অক্ষরের এই শব্দটা বিশ্বব্যাপী বাঙালির শুধুমাত্র শ্রবণেন্দ্রিয়কে আঘাত করে না বরং আপামর বাঙালির বুক চিরে হৃদয়কে এঁফোড় - ওঁফোড় করে অলিন্দ-নিলয়ের মাঝখান দিয়ে রক্তাক্ত স্মৃতির ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ টেনে দেয় যা আজও না শুকানো দগদগে ঘায়ের মত বুকে জ্বালা ধরায়।
তবুও কি কেউ আমাদের আদৌ ভাগ করতে পেরেছেন? আদৌ কি আমরা ভাগ হয়েছি?
-না।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন পারেননি।
১৯৪৭ এ স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ আমাদেরই চামড়ার রংয়ের কিছু ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের সঙ্গে মিলে রাজনৈতিক কাঁটাতারের বেড়ার মাধ্যমে আমাদের ভাগ করে ফেলতে চাইলেও সাহিত্য, সংগীত খাদ্য, বস্ত্র এবং সর্বোপরি ভাষার বাঁধনে আজও আমাদের রক্তের সম্পর্ক অটুট, আজও আমরা ভাই-ভাই... যতদিন এই গ্রহ থাকবে ততদিন একই বাংলা মায়ের দুই যমজ সন্তানের মত একসাথে, একই পাতে রয়ে যাবো।
কিন্তু, যা আমাদের দুশো বছর ধরে শোষণকারী লালমুখো সাহেবরা করতে পারেননি, আমাদের সহনাগরিক ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকরা করতে পারেননি... সেই অসাধ্যসাধন কিনা করে গেল কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের লাতিন আমেরিকা মহাদেশের দুটো দেশ? যে দুটো দেশে আমাদের দুই বাংলার কটা নাগরিকই বা পা রেখেছেন?
দেশ দুটোর যে মহাতারকাগুলো আমাদের ক্রীড়াপ্রেমী হৃদয়ে আবেগের হিল্লোল সৃষ্টি করেন, অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বাড়িয়ে দেন, রক্তচাপের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করেন... যাদের আনন্দে আমাদের হৃদয় উচ্ছস্বিত হয়ে ওঠে, চোখের কোণ বেয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ে; যাদের ব্যর্থতায় এক লহমায় বুকটা খালি হয়ে যায়, আপনজন বিয়োগের শোকে হৃদয় কেঁদে ওঠে তারাই বা কতবার বা আদৌ কি একবারও বাংলায় পা রেখেছেন? তাঁদের কি কোনোদিন আমরা ছুঁয়ে দেখতে পেরেছি বা আদৌ কি কোনোদিন ছুঁয়ে দেখতে পারবো যে আদৌ কি ওনারা আমাদের মত রক্ত মাংসের মানুষ নাকি সুপারহিরো? কিন্তু তাঁরা সহস্র যোজন দূর থেকেও আমাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে যান।
বিশ্বকাপ হোক বা কোপা আমেরিকা বাংলার পাড়াগুলো রিও ডি জেনেইরোর এক টুকরো ‘ফাভেলা’ কিংবা বুয়েনস আইরেসের ‘ভিলা মিসেরিয়া’র অংশ হয়ে ওঠে, কলকাতা কিংবা ঢাকার গলি থেকে তস্য গলিগুলোর কোনোটা ‘অরডেম ডি প্রোগ্রেসো’ লেখা হলুদ - সবুজ পতাকায় মুড়ে সাও পাওলোর ‘রুয়া গালভায়ো বুয়েনো’র রূপ ধারণ করে তো কোনোটা 'অ্যালবিসেলেস্তে'র নীল - সাদা পতাকার রঙে সেজে রোসারিওর ‘সান মার্টিন স্ট্রিট’ হয়ে ওঠে। এমনকি ১৫ ই আগস্ট কিংবা ২৬ শে মার্চ কোনোদিনই জাতীয় পতাকা উত্তোলন না করা যথাক্রমে এপার বাংলা ও অপার বাংলার ফুটবল পাগলদের বাড়ির ছাদে হয় হলুদ - সবুজ কিংবা নীল - সাদা পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে। পাড়ায়-পাড়ায়, গলিতে-গলিতে, কফি হাউসের আড্ডায়-চায়ের ঠেকে, কলকাতার নিউ টাউনের কাঁচে মোড়া অফিসের ফুড লাউঞ্জে-ঢাকার গুলশনের কর্পোরেট হাউসের ক্যান্টিনে, ফেসবুকের ওয়ালে-হোয়াটস অ্যাপের চ্যাটে, বন্ধুতে - বন্ধুতে, ভাই-ভাইয়ে, বাবা-ছেলেতে, প্রেমিক-প্রেমিকাতে, স্বামী-স্ত্রীতে, ড্রইংরুমে-বেডরুমে, টিভি সেটের সামনে- পাড়ার মোড়ে টাঙানো বড় পর্দার ভিড়ে ... সর্বত্র, সর্বত্রই একই ছবি- ‘বঙ্গভঙ্গ।’
‘বঙ্গভঙ্গ’ -বিরোধী একটা জাতি কোন মরীচিকার টানে, কিসের নেশায় আসক্ত হয়ে নিজেদের পূর্বপুরুষদের ‘আয় বেঁধে বেঁধে থাকি’ মন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগিতে মেতে উঠলো ? এই জাতিগত স্ববিরোধী কার্যকলাপের পিছনে লুকিয়ে থাকা রহস্যটা কি ?
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্যভূমি সমৃদ্ধ বঙ্গভূমির ভূমিপুত্রদের বিশ্বের বৃহত্তম রেন ফরেস্টের অধিকারী মহাদেশের দেশগুলির সাথে এই নাড়ির টানের রহস্য উদঘাটন করতে গেলে দেখা যাবে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের দুই তৃতীয় বিশ্বের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের হুবহু মিল না থাকলেও ফুটবলপ্রেমী জাতি দুটির আপামর সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম, জীবন সংগ্রামের সাফল্য-ব্যর্থতার মাঝে ফুটবল খেলাটার কোলে আশ্রয় নিয়ে একরাশ আবেগকে খেলাটায় বিনিয়োগ করে বেঁচে থাকার প্রজন্মের পর প্রজন্মের অভ্যাসগত সাদৃশ্য কিংবা ‘ফুটবল সম্রাট’ পেলের মাত্র সতেরো বছরে প্রথম বিশ্বের মাটিতে দাঁড়িয়ে বল পায়ে তৃতীয় বিশ্বের উপর প্রথম বিশ্বের করা শোষণের, অত্যাচারের জবাব দেওয়া বা ‘ফুটবলের রাজপুত্র’ ম্যারাডোনার একার কাঁধে একটা বুভুক্ষু, পিছিয়ে থাকা জাতিকে বিশ্বজয়ীর আসনে বসানোর মধ্যে বাঙালির নিজেদের মনে দীর্ঘদিনের লালিত- পালিত আশা - আকাঙ্খার, যন্ত্রনা মুক্তির ঔষধির ফর্মুলা খুঁজে পাওয়ার পরোক্ষ প্রাপ্তি হয়তো দেশ, জাতি, ভাষা এমন কতশত সীমানা পেরিয়ে আজও বাঙালিকে ‘বঙ্গভঙ্গ ঘটিয়ে’ সেলেকাও কিংবা ' অ্যালবিসেলেস্তে সাজে সাজায় এবং আগামীদিনেও সাজাবে।
‘বঙ্গভঙ্গ’ বিরোধী বাঙালি জাতি আজও দু টুকরো হয়ে যায়, আগামীদিনেও দু ভাগে ভাগ হবে-
পেলে - মারাদোনায়
রোনাল্ডো - বাতিস্তুতায়
নেইমার - মেসিতে
ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায়।
আজ রাত পোহালেই ‘বঙ্গভঙ্গ’!