ফুটবল মাঠের হামজাকে কতটা চেনেন আপনি?

সবার চোখ যেন আটকে রইল সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। একজন ফুটবলারের আগমন কেন্দ্র করে থমকে গেল যেন বাংলাদেশের ঘড়ির কাঁটা। কেউ কেউ বলছেন, ওই একটা বিমানকে পুরো বাংলাদেশ থেকে হাজারখানেকের বেশি মানুষ ট্র্যাক করেছিলেন। হামজা চৌধুরীর জন্য উন্মাদনাটা ঠিক ওখানেই।
শেকড়টা হবিগঞ্জে। কিন্তু শিখরটা ছড়িয়ে পড়েছে ইংল্যান্ডের লেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব থেকে। কয়েকবছর ধরেই এমন একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশের ফুটবল। ডেক্লান রাইস, কেলভিন ফিলিপ্সরা ইংল্যান্ডের স্কোয়াডে জায়গা করে নেন, আর বাংলাদেশ অপেক্ষা করে হামজা বুঝি আমাদের হলো এবারে। শেষ পর্যন্ত গেল বছর যখন বাংলাদেশের হয়ে খেলতে ফিফার সবুজ সংকেত পেয়ে গেলেন, তখন থেকেই বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারার নামটা হামজা দেওয়ান চৌধুরী।
হামজা এসেছেন। ২৫ মার্চ বাংলাদেশের জার্সিতে প্রথমবার নামবেন মেঘালয়ের শিলংয়ে। প্রতিপক্ষ ভারত। । তার আগে একটাবার নাহয় নতুন করে চিনে আসা যাক দেশের ফুটবলের এই নতুন সেনসেশনকে।
লেস্টার থেকে শেফিল্ড
পুরো নাম হামজা দেওয়ান চৌধুরী। জন্ম ১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর। ইংল্যান্ডের লেস্টারে। বেড়ে ওঠা লেস্টারের অ্যাকাডেমি থেকেই। সেখান থেকেই পরিণত হয়ে ওঠা। বাংলাদেশের হয়ে খেলার আগে ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলেছেন। এমনকি অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো দলেও খেলেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
তবে লেস্টারের অ্যাকাডেমি গ্র্যাজুয়েট হলেও হামজার পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয়েছিল বার্টন অ্যালবিয়নের হয়ে। ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ মৌসুমে এই ক্লাবের হয়েই মাঠে নেমেছিলেন। দুই মৌসুমে খেলেছেন ২৮ ম্যাচ। অ্যাসিস্ট ১টা।
২০১৭ সালে লেস্টারের হয়ে হামজা অধ্যায় শুরু। প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ, কারাবাও কাপ… ঘরোয়া সব আসরেই পা পড়েছে হামজার। আক্ষেপ একটাই। ইউরোপিয়ান কোনো প্রতিযোগিতায় দেখা যায়নি এখন পর্যন্ত। লেস্টারের জার্সিতে চারটা অ্যাসিস্ট আর ২ টা গোল আছে নামের পাশে। এই ক্লাবের বাইরে খেলেছেন কেবল ওয়াটফোর্ডে। সেটা ২০২২-২৩ মৌসুমে। আর বর্তমানে খেলছেন শেফিল্ডে।
গোল আর অ্যাসিস্ট দেখে কিছুটা বিষন্ন হয়ে ওঠা মনকে জানান দিন, প্রচলিত স্কোরিং পজিশনের খেলোয়াড় নন হামজা। খেলেছেন মূলত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। এর বাইরে কালেভদ্রে দেখা গিয়েছে সেন্ট্রাল মিডে। আর এই মুহূর্তে ব্যস্ত থাকছেন রাইট ব্যাকের ভূমিকায়।
মাঠের হামজা কেমন?
ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হলেও হামজাকে বলা যেতে পারে অর্কাস্ট্রেটর ঘরানার ফুটবলার। মাঝমাঠ থেকে বল ডিস্ট্রিবিউশন, মাঠের নিয়ন্ত্রণ রাখা, ফাইনাল থার্ডে কার্যকরী বল পাস করা কিংবা ডিফেন্সচেরা থ্রু পাসিং হামজার খেলার ধরণে সবচেয়ে বড় শক্তি। বোঝার সুবিধার্থে বলা যেতে পারে হামজার প্লেয়িং স্টাইল ইতালিয়ান কিংবদন্তি আন্দ্রেয়া পিরলোর মতো।
হ্যাভিয়ের মাশ্চেরানো, প্যাট্রিক ভিয়েরা কিংবা ক্যাসেমিরোর মতো কড়া ট্যাকেল করা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নন হামজা। যাকে মাঠের খেলার ধরণে বলা হয় হয় ডেস্ট্রয়ার রোল। তবে আগ্রাসী না হলেও প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দেয়ার জন্য হামজা দারুণ কার্যকরী। শেফিল্ডের জার্সিতে শুরুর একাদশে ছিলেন ৭ বার। তাতেই ট্যাকল ১১টি আর ডুয়েল জিতেছেন ৩৩টি।
সাফল্যের হার বিবেচনায় ৬১ শতাংশ ট্যাকেল এবং ৬৩ শতাংশ গ্রাউন্ড ডুয়েল আর ৪৭ শতাংশ এরিয়াল ডুয়েল জিতেছেন হামজা। বাংলাদেশের মতো খানিক রক্ষ্মণাত্মক ঘরানার ফুটবলে হামজা বেশ বড় একজন সম্পদ হতে পারেন– সেটা সহজেই অনুমেয়।
অফেন্সিভ হামজা কতটা কার্যকরী
হামজার বড় শক্তির জায়গা বল ডিস্ট্রিবিউশন। সঠিকভাবে প্ল্যান করা সম্ভব হলে মাঠের খেলায় গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। চলতি মৌসুমে শেফিল্ডের জার্সিতে ৮০ শতাংশ এবং লেস্টার সিটিতে ৮৯ শতাংশ সঠিক পাস দিয়েছেন হামজা। ফাইনাল থার্ডেও বল পাঠিয়েছেন হরহামেশাই।
মিডফিল্ডে হামজার এই পজিশনকে মূলত বলা হয় 'রেজিস্তা' নামে। ফুটবলে এই পজিশনের উদ্ভব ইতালি থেকে। এর মূল কাজ ম্যাচের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করা। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে সুনীল ছেত্রী উদ্দেশ্যে পাঠানো বল আটকানো এবং কাউন্টার অ্যাটাকে বল যোগান দেয়ার কাজটা বেশ ভালোভাবেই করতে পারবেন বাংলাদেশ দলের নতুন এই সংযোজন।
রাইটব্যাক হামজা কেমন হবেন বাংলাদেশের জন্য?
তবে রাইট ব্যাকের হামজা কিছুটা হলেও পিছিয়ে থাকবেন। লং বলে হামজার পাসিং অ্যাকুরেসি ৪০ এর কিছুটা কম। লেস্টার সিটিতে খুব একটা মানিয়ে নিতে পারেননি এই পজিশনে। ক্রসের দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন। বাংলাদেশ খানিক রক্ষণাত্মক ঘরানার দল হওয়ার কারণে রাইটব্যাকের এই জায়গা থেকেও অফেন্সিভ বা আক্রমণ রচনায় হামজাকে বিশেষভাবে নির্ভর করতে হবে লং বলের ওপরে। সেদিক বিবেচনায় রেজিস্তা হামজার সার্ভিসই বেশি চাইবে বাংলাদেশ।
তবে দিনশেষে ফুটবল একটা দলীয় খেলা। হামজাকে নিয়ে বাংলাদেশের উচ্চাশা থাকাটাই স্বাভাবিক। এবার মাঠে থাকা দেশের বাকি ১০ তারকা হামজাকে কতটা স্বস্তি দিতে পারেন ৯০ মিনিটের খেলায়, সেটাই গড়ে দেবে সব পার্থক্য।
জেএ