শুভ জন্মদিন টেস্ট ক্রিকেট

হেডিংলিতে বেন স্টোকসের কাভার ড্রাইভ... উল্লাসে ফেটে পড়েছে পুরো মাঠ। কলকাতায় শোয়েব আখতারের বলে উড়ে গেল শচীন টেন্ডুলকারের স্টাম্প, চারশ রান নিয়ে ব্রায়ান লারার উল্লাস কিংবা মুম্বাইয়ে প্রচন্ড রোদের নিচে দাঁড়িয়ে ডিন জোন্সের মহাকাব্যিক ইনিংস। শেন ওয়ার্নের ৭০০ অথবা মুরালিধরনের ৮০০... সাদা পোশাকের ক্রিকেট দেখেছে কত রঙ, কত হাসি আনন্দ আর বেদনার কাব্য।
কারো কারো এটাই ক্রিকেট। ৫ দিনের ক্লাসিকাল লড়াই। যেখানে ধৈর্য, সংগ্রাম, নিষ্ঠা আর ক্রিকেটীয় মেধা সবকিছুই হতে হয় নিখুঁত। যাকে বলে পিকচার পারফেক্ট। তাদের হিসেবে, এটাই ক্রীড়াজগতের সবচে জনপ্রিয় খেলা। এটাই জেন্টলসম্যান গেইমের সবচেয়ে সুন্দর রূপ।
টেস্ট ক্রিকেট। আক্ষরিক অর্থেই যা ক্রিকেটারদের টেস্ট করে, পরীক্ষা নেয়। ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের জনপ্রিয়তার বাইরেও শুভ্র সাদা পোশাকের টেস্ট এখনো ক্রিকেট আভিজাত্যের প্রতীক। টেস্ট ক্যাপের মাহাত্ম্য এত বেশি বলেই ডেভিড ওয়ার্নারের মত তারকা ক্যাপ হারিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় ফেলেছিলেন।

টেস্ট নিয়ে এত গুণকীর্তনের বড় কারণ, আজ ১৫ই মার্চ টেস্ট ক্রিকেটের জন্মদিন। ১৪৮ বছরে পা রেখেছে ক্রিকেটের এই বনেদী ফরম্যাট। ১৮৭৭ সালের আজকের দিনে মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে হয়েছিল ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম অফিসিয়াল টেস্ট। প্রথম সেঞ্চুরি, প্রথম উইকেট, প্রথম রান... সবকিছুর শুরুটা আজকের দিনে।
প্রথম সেঞ্চুরিটা ছিল চার্লস ব্যানারম্যানের। বলা হয়, তিনিই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের 'প্রিমিয়াম ব্যাটসম্যান।' প্রথম টেস্টে করেছিলেন ১৬৫ রান। প্রথম আউট হওয়া ব্যাটার ন্যাট থমসন। প্রথম উইকেট অ্যালেন হিলের। ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম ফিফটিও এক ওপেনারের সুবাদে। তিনি হ্যারি ইয়ুপ। বলা চলে সেটাই প্রথম টেস্টের প্রথম ফিফটি। প্রথম ফাইফারও এসেছে এই ম্যাচে। সেটা পেয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার বিলি মিডউইন্টার। আর প্রথম টেস্ট জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। ৪৫ রানের ব্যবধানে।
আরও পড়ুন
সেই থেকে শুরু। এরপর বহুভাবে, বদলেছে টেস্ট ক্রিকেটের রঙ। একটাসময় টেস্ট ক্রিকেটে দিনের সীমাবদ্ধতা ছিল না। ১২ দিন পর্যন্ত খেলা হয়েছে এমন খবরও পাওয়া যায়। এরপর সেটা নেমেছে ৫ দিনে। কত নিয়ম যুক্ত হলো, কত কে এলো আর গেলো। তবু টেস্ট ক্রিকেট রয়ে গিয়েছে তার মতো করেই।
অথচ মাত্র দেড় দশক আগেই অনেকে দেখে ফেলেছিলেন টেস্টের মৃত্যু। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উন্মাদনা, আবেদন। আইপিএলের টাকার ঝনঝনানি, নিষিদ্ধ আইসিএলের জন্য ক্রিকেটারদের নিবেদন... সবমিলিয়ে টেস্টের এপিটাফই লিখে ফেলেছিলেন অনেকে। এমনটা হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। ওয়ানডে ক্রিকেটে উত্থানের পর্বেও। কিন্তু, বরাবরের মতোই টেস্ট টিকে গেছে তার নিজের মতো করে।
টেস্ট বনেদিয়ানার সুঘ্রাণ মুছে ফেলাটাই যেন দায়। ২০২৪ সালের কথাই ধরা যাক। বছরটাই তো ছিল টেস্টের। ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার বোর্ডার গাভাস্কার সিরিজ, অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফ্র্যাংক ওরেল ট্রফি কিংবা শ্রীলঙ্কা-ইংল্যান্ড আর বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজ পুরো দুনিয়াকে আবার বাধ্য করেছে টেস্ট ক্রিকেটে মনোযোগ ফেরাতে। টেস্ট ক্রিকেট এখনো রোমাঞ্চ ছড়াতে জানে, সেটা যেন বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে ২০২৪ সালটা।
অথচ, সবচেয়ে পুরাতন ফরম্যাট হলেও আইসিসি টেস্ট ক্রিকেট ঘিরে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা চালু করেছে সবার শেষে। ২০১৯ থেকে শুরু হয় টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। এখন পর্যন্ত হয়েছে দুই চক্রের শেষ। ২০২৫ সালে হবে তৃতীয় চক্রের ফাইনাল। আর এই প্রতিযোগিতাই নতুন করে টেস্টকে নিয়েছে মানুষের আরও কাছে।
তবে বনেদি এই ফরম্যাটেই বাংলাদেশ যেন সবচেয়ে পিছিয়ে। দীর্ঘ ২৪ বছরে ১৫০ ম্যাচ খেলে জয় মোটে ২২ ম্যাচে। হার ১১০ ম্যাচে। ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে জয় কিছুটা নিয়মিত হলেও টেস্ট ক্রিকেটে এখনও বাংলাদেশ যেন অপরিণত একটা দল।
এরমাঝে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে দ্বিস্তরী টেস্ট ভাবনা। আক্ষরিক অর্থে বড় দেশ এবং তুলনামূলক পিছিয়ে পড়ে দেশগুলোর মাঝে টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে বিভাজনের দাগ টানার সম্ভাবনাও আছে প্রবল। এখানেও আবার টেস্টের ইতি দেখছেন অনেকেই। প্রস্তাবিত নতুন মডেল বাস্তবায়ন হলে ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড একে অন্যের বিপক্ষে প্রতি ৩ বছরে অন্তত ২ বার করে মুখোমুখি হতে পারবে। এতে করে আর্থিকভাবে ব্যাপক আকারে লাভবান হবে ওই তিন দেশের বোর্ড। নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এখন পর্যন্ত আছে টেস্টের উন্মাদনা। আর্থিক সুবিধা পাবে তারাও।
আর পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ের মতো অনেক দেশই। তাতে এসব দেশে টেস্টের সংখ্যা কমে আসবে। যুক্ত হবে আর্থিক ক্ষতির দিকটাও।
যদিও টেস্ট ক্রিকেট বলেই হয়ত এখনই সব উপসংহার লেখা সম্ভব নয়। দেড়শ বছর ধরে যে দাপট চলেছে, তাকে সহসাই দমিয়ে ফেলার সাধ্য কার?
জেএ/এইচজেএস