মিরপুরের উইকেটের জন্য বলির পাঁঠা হয়েছি

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে পা রেখেই বাজিমাত করেছিলেন নাঈম শেখ। অভিষেক সিরিজে ভারতের মাটিতে তাদের বিপক্ষে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে নজর কাড়েন এই ওপেনার। সেই ধারাবাহিকতা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি। উল্টো স্ট্রাইকরেট নিয়ে সমালোচনায় পড়ে জায়গা হারান। সেই কঠিন সময় পেরিয়ে আবারো তার ব্যাটে আশার আলো ফুটতে শুরু করেছে।
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল) টি-টোয়েন্টিতে ৩১৬ রান করেছিলেন নাঈম। যা আসরে কোনো ব্যাটারের সর্বোচ্চ রান। সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও (বিপিএল) সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় শীর্ষে ছিলেন তিনি। এমন ধারবাহিক ব্যাটিংয়ের রহস্য, জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া, ফেরার লড়াই ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা পোস্টের হাসিব সিয়ামের সঙ্গে কথা বলেছেন নাঈম।
ঢাকা পোস্ট : বিপিএলে তিন মাঠেই রান পেয়েছেন, পরিকল্পনা কী ছিল?
বিজ্ঞাপন
নাঈম : মাঠ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আমি ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে খেলার চেষ্টা করেছি। তিন মাঠেই উপভোগ করার চেষ্টা করেছি।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট : গত ডিপিএল ও এনসিএল টি-টোয়েন্টিতেও রানের মধ্যে ছিলেন, সেই ধারাবাহিকতা বিপিএলে মানসিকভাবে এগিয়ে রেখেছিল?
নাঈম : যে টুর্নামেন্টেই খেলি কখনোই এমন মানসিকতা নিয়ে শুরু করি না যে, আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হবো। সবসময় চেষ্টা করি আমার নিজের সামর্থ্যের মধ্যে থাকতে, যা পারি সেটা ঠিকমতো কাজে লাগাতে। সফল হই বা ব্যর্থ হই আমি নিজের পরিকল্পনা এবং সামর্থ্যে বিশ্বাস রাখি। ডিপিএল হোক আর বিপিএল হোক আপনি যখন কোনো আসরে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে আরেকটা বড় আসর শুরু করবেন তখন মানসিকভাবে আপনি ইতিবাচক থাকবেন।
ঢাকা পোস্ট : মিরপুরে স্পোর্টিং উইকেট থাকায় এবার ভালো রান হয়েছে, এটা ব্যাটারদের মানসিকতা পরিবর্তনে কতটা কাজে দেবে?
নাঈম : অবশ্যই মানসিকতা পরিবর্তনে সাহায্য করবে। এবার মিরপুরে যে ধরনের উইকেটে খেলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এমন ধরনের উইকেটই থাকে। এমন উইকেটে আপনি খেলতে খেলতে যখন অভ্যস্ত হবেন এবং কঠিন উইকেট থেকে বের হয়ে আসবেন তখন আপনি টি-টোয়েন্টিতে সহজেই ২০০ রান করতে পারবেন এবং বড় রান তাড়া করে জেতারও সাহস পাবেন। মিরপুরে সবসময় আমরা দেখি, রান একটু কম হয়, কঠিন উইকেট থাকে কিন্তু সেই তুলনায় এবার স্পোর্টিং উইকেট ছিল, এমন উইকেটে খেলা হলে ব্যাটাররা অনেক আত্মবিশ্বাসী থাকে।
ঢাকা পোস্ট : এমন স্পোর্টিং উইকেট সবসময় পাওয়া গেলে সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেটে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে?
নাঈম: প্রতিনিয়ত ২০০ রানের আশে-পাশে করলে বা এমন লক্ষ্য তাড়া করলে আপনি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। বড় রান করতে হলে আপনাকে কোন অ্যাপ্রোচে ব্যাটিং করতে হবে সেটা আপনি শিখে যাবেন। তখন আপনাকে আর বলে দিতে হবে না, এমনিতেই আপনার মানসিক পরিবর্তন হয়ে যাবে। তো এমন উইকেটে খেলা হলে সেটা আমাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবশ্যই সাহায্য করবে।
ঢাকা পোস্ট : উইকেটে পরিবর্তন আসায় আপনার ব্যাটিংয়ের ধরনে কোনো পরিবর্তন এনেছেন?
নাঈম : আমি রেঞ্জ হিটিং নিয়ে কাজ করেছি, বাউন্ডারির জন্য বেশি চেষ্টা করেছি। স্লো উইকেটে বাউন্ডারি মারা আমার জন্য অনেক কঠিন কাজ ছিল, তাই স্পোর্টিং উইকেট হোক কিংবা স্লো উইকেট, আমি সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল, যেকোনো উইকেটে যেন ১৪০ কিংবা ১৫০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করতে পারি।
ঢাকা পোস্ট : ব্যাটিংয়ে টেকনিক্যাল কোনো পরিবর্তন এনেছেন?
নাঈম : আপনি যখন রেঞ্জ হিটিংয়ের জন্য যাবেন, তখন আপনাকে ছোট ছোট কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। না হয় আধুনিক টি-টোয়েন্টির সঙ্গে তালমিলিয়ে আপনি এগোতে পারবেন না। তো ফাঁকা সময়ে আমি এসব ছোট ছোট বিষয়ে কাজ করেছি। ভালো খেলার জন্য যেসব পরিবর্তন আনা দরকার সবই করার চেষ্টা করেছি।
ঢাকা পোস্ট : আপনার ব্যাটিং নিয়ে অনেক দিনের অভিযোগ টানা ডট বল খেলেন, এটা নিয়ে কাজ করছেন?
নাঈম : ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক খেলার পর আমি নিজেও বুঝতে পেরেছি এই ব্যাপারটা। আমি তিন বল ডট খেলে যখন এক রান নিবো তখন ওই তিনটা ডট বলের জন্য আমার নিজের ওপর চাপ বাড়ে একই সঙ্গে আমার অপর প্রান্তের ব্যাটারের ওপরও চাপ পড়ে। আমি এই জায়গায় নিজের উন্নতি করার চেষ্টা করেছি যে, যতটা সম্ভব ডট বল কম খেলা যায় এবং বাউন্ডারি বেশি মারা যায়। আমার হাতে যেন বেশি বেশি বিকল্প থাকে। এক বল ডট খেলে ফেললেও পরের বলে যেন এক রান নেওয়া যায় বা বাউন্ডারি মারা যায়, এসব দিকে খেয়াল রেখেছি। আমার মনে হয়, এসব কারণেই রান করা সহজ হয়েছে এবং ইনিংসগুলো সুন্দর হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : চলমান ক্যাম্পে নিজের কোন দিকটি নিয়ে কাজ করছেন?
নাঈম : এখানে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ে কাজ করছি না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সুযোগ পেলে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি সেটা নিয়েই কাজ করছি। অনুশীলনের চেয়ে ফিটনেসে বেশি নজর দিচ্ছি। লম্বা টুর্নামেন্ট খেলেছি সামনে গরমের দিন আসছে তো এই সময়ে নিজেকে ফিট রাখাটা খুবই কঠিন।
ঢাকা পোস্ট : আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনার শুরুটা দুর্দান্ত ছিল, কিন্তু সেটা ধরে না রাখতে পারার কারণ কী?
নাঈম : আমার স্ট্রাইকরেট নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছিল। প্রথম ১৫-২০ ইনিংসে আমার স্ট্রাইকরেট ১৪০ এর আশে-পাশে ছিল, ব্যাটিং গড়ও ৩০ এর কাছাকাছি ছিল। কিন্তু এরপর নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজগুলোতে ১৪-১৫টা ইনিংস স্লো উইকেটে (মিরপুরে) খেলে আমার ব্যাটিং গড় ও স্ট্রাইকরেট কমে গেছে। যেখানে পুরো দল মিলে ১১০-১১৫ রান করেছি এবং সেটা আবার আমরা ডিফেন্ডও করেছি, সেখানে ১৫০-১৬০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিংয়ের আশা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। সাকিব ভাই তখন একটা কথা বলেছিলেন, ‘এই জায়গায় কারো ব্যাটিং দেখে যদি তাকে বিচার করেন তাহলে সেটা বোকামি হবে।’ তো এই বলির পাঁঠা আর কেউ হয়নি, আমিই হয়েছি। এটা আমার দুর্ভাগ্য বলতে পারেন। ওই সিরিজগুলোর পরই কিন্তু আর কামব্যাক করতে পারিনি, বড় কোনো সুযোগও পাইনি। এরপর ওয়ানডেতে সুযোগ পেয়েছি, তবে সেখানে টপ ক্লাস পারফর্ম করতে পারিনি বলেই হয়তো থিতু হতে পারিনি।
ঢাকা পোস্ট : যখন অফফর্মে ছিলেন তখন ফেরার জন্য কী কী করেছেন?
নাঈম: নিজের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। আমার ঘরোয়া ক্রিকেটের কোচ, বয়সভিত্তিক দলের কোচ এবং অনেক সাবেক ক্রিকেটারও এক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করেছে। তাদের সাহায্য নিয়ে নিজের ঘটতির জায়গাগুলোতে কাজ করেছি, উন্নতি করার চেষ্টা করেছি। সেই জিনিসগুলো ম্যাচে ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করতে পারছি কি না সেদিকেও নজর রেখেছি। এসব কিছুর পারফেক্ট এক্সিকিউশন করতে পেরেছি বলেই আমার মনে হয় সাফল্য পেয়েছি।
ঢাকা পোস্ট : নিজের দুর্বলতা খুঁজে পেতে কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন?
নাঈম : যেসব কোচের সঙ্গে চার-পাঁচ বছর ধরে কাজ করছি তারা দেখলেই বুঝতে পারেন যে আমার কোন জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, তাদের সাহায্য নিয়েছি। তাছাড়া ভিডিও এনালাইসিস আছে, আর আমি নিজেও খুঁজেছি যে কোন জায়গায় আমার ঘাটতি আছে।
ঢাকা পোস্ট : খারাপ সময় গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অনেক নেতিবাচক কথা হয়, এসব কীভাবে সামলেছেন?
নাঈম : মানুষের অনেক প্রত্যাশা ছিল (মেটাতে পারিনি), স্ট্রাগল করেছি, খারাপ লাগাও ছিল। এসব নিয়ে হতাশ ছিলাম তবে একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে আসলে হতাশ থেকে লাভ নেই, এসব চাপ নিয়েই ক্রিকেট খেলবে হবে, যতটা সম্ভব উপভোগ করতে হবে। উপভোগ না করলে এ জায়গায় আপনি টিকতে পারবেন না। আমার সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, উপভোগ করতে হবে আর নেতিবাচকতা থেকে দূরে থাকতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপারগুলো সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি।
‘‘যেখানে পুরো দল মিলে ১১০-১১৫ রান করেছি এবং সেটা আবার আমরা ডিফেন্ডও করেছি, সেখানে ১৫০-১৬০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিংয়ের আশা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। সাকিব ভাই তখন একটা কথা বলেছিলেন, ‘এই জায়গায় কারো ব্যাটিং দেখে যদি তাকে বিচার করেন তাহলে সেটা বোকামি হবে।’ তো এই বলির পাঁঠা আর কেউ হয়নি, আমিই হয়েছি। এটা আমার দুর্ভাগ্য বলতে পারেন।’’
ঢাকা পোস্ট : অফফর্মে যখন ছিলেন সেই সময়ের অনুশীলনের সঙ্গে তুলনা করলে এখনকার অনুশীলনের ধরনে কোনো পরিবর্তন এসেছে?
নাঈম : মূল কথা হচ্ছে শৃঙ্খলা। আপনি অফফর্মে থাকেন আর ফর্মেই থাকেন, আপনাকে অবশ্যই শৃঙ্কলার মধ্যে থাকতে হবে। পার্সোনাল লাইফ, প্রফেশনাল লাইফ দুই জায়গায়ই আপনাকে শৃঙ্কলা মেনে চলতে হবে। হয়তো জাতীয় দলে একটা লম্বা সময়ের দূরত্ব আছে তবে ঘরোয়াতে কিন্তু খুব বেশি দিন অফফর্মে ছিলাম না। অনুশীলনের পার্থক্য খুব বেশি নেই, তবে মানসিকভাবে এখন আমি বেশ শক্ত।
ঢাকা পোস্ট : অনেক তরুণই ঘরোয়াতে পারফর্ম করলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গিয়ে ব্যর্থ হয়, এটা কী ঘরোয়া ক্রিকেটের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে?
নাঈম : আমাদের জাতীয় দলে যেমন শক্তিশালী বোলিং বিভাগ, তো এমন চার-পাঁচজন বোলারের বিপক্ষে ব্যাটিং করা আসলেই চ্যালেঞ্জ। আমাদের যেমন ৬/৭ জন বিশ্বমানের পেসার আছে, ঘরোয়া ক্রিকেটে তারা তো আর একদলে থাকে না, একজন বা দুইজন থাকে, তখন ব্যাটিং করাটা সহজ হয়ে যায়। আসলে এখানে এর থেকে ভালো অপশনও নেই, কারণ আপনি এক দলে জাতীয় দলের চার-পাঁচজন পেসার তো পাবেনও না।
ঢাকা পোস্ট : দেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটারদেরই লম্বা ইনিংস খেলার সময় পায়ে টান পড়ে বা অল্পতেই ক্লান্ত দেখায়, একজন ওপেনার হিসেবে এটা নিয়ে আপনি কাজ করেন?
নাঈম : আপনাকে দেখতে হবে কোন সময়ে খেলা হচ্ছে, কোথায় খেলা হচ্ছে, আবহাওয়া কেমন এসবের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এনসিএল, এনসিএল টি-টোয়েন্টি, বিপিএল হলো এখন আবার ‘লিস্ট এ ’ হবে তো আপনাকে মানসিক এবং শারীরিক দুইভাবেই ফিট থাকতে হবে। আর না হয় টিকতে পারবেন না।
ঢাকা পোস্ট : চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ব্যাকআপের জন্য বিসিবি থেকে কোনো বার্তা পেয়েছেন?
নাঈম : না, এমন কিছু বিসিবি থেকে পাইনি, আর মাথায় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ভাবনাও নেই। আপাতত নিজের মতো করেই কাজ করছি। বিসিবি থেকে যদি কখনো এমন কিছু জানানো হয় তাহলে অবশ্যই নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি রাখবো।
ঢাকা পোস্ট : চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির স্কোয়াড ঘোষণার আগে বিপিএল শেষ হলে, নিজেকে স্কোয়াডে দেখতেন কি না?
নাঈম : এটা পুরোটাই বিসিবির ওপর নির্ভর করে, নির্বাচকদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বা নির্দিষ্ট কোনো টুর্নামেন্ট নিয়ে আমার কোনো লক্ষ্য নেই, যখনই খেলি আমি দেখি আমার কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারছি কি না। আউটপুট নিয়ে আমি কখনো ভাবি না, সময়ের সঙ্গে কতটা উন্নতি করতে পারছি সেটাই আমার ভাবনার বিষয়।
ঢাকা পোস্ট : চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে কাকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখছেন?
নাঈম : আমি চাই বাংলাদেশ ফাইনাল খেলুক, বাংলাদেশ ফাইনাল জিতুক। তবে বাস্তবতা দেখলে ভারত বা দক্ষিণ আফ্রিকার ভালো সম্ভাবনা আছে।
এইচজেএস