রবার্তো ব্যাজ্জিও– ডিভাইন পনিটেইল অথবা ম্যান হু ডাইড স্ট্যান্ডিং

থ্রি ইডিয়টস চলচ্চিত্রে ড. ভিরু শাস্ত্রবুদ্ধির চরিত্রটা সহসা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। নবীন ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে তার দেয়া বক্তব্যটা এখনো অনেকের মনেই দাগ কাটে। জীবনকে যিনি বলেছিলেন রেসের মতো, যেখানে দ্বিতীয় হওয়া কাউকে মনে রাখা হয় না কোনোভাবেই। তবে ভিরু শাস্ত্রবুদ্ধি হয়ত রবার্তো ব্যাজ্জিও নামের এক ইতালিয়ান শিল্পীর সঙ্গে পরিচিত নন।
ব্যাজ্জিও ফুটবলার। চলচ্চিত্রের সঙ্গে যার দূরতম সম্পর্কও হয়ত নেই। তবে যদি কোনো নির্মাতা কখনো আগ্রহী হয়েও পড়েন, সেক্ষেত্রে হতাশ হতে হবে না নিশ্চিত। বারবার ব্যর্থ হয়েও এখনো ইতালিয়ান ফুটবলপ্রেমীদের চোখে তিনি পরিচিত ‘দ্য ডিভাইন পনিটেইল হিসেবে’। অবশ্য ফুটবলের বাকি দুনিয়াটা তাকে চেনে ‘দ্য ম্যান হু ডাইড স্ট্যান্ডিং’ বা দাঁড়িয়ে থেকে মারা যাওয়া একজন মানুষ হিসেবে।
ইন্টারনেটে ব্যাজ্জিওর নামটা সার্চ করলে চোখে আসে একটা ছবিই। লম্বা চুলের ১০ নম্বর জার্সি পরিহিত এক ইতালিয়ান ফুটবলার। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবির আশপাশে ব্রাজিলের হলুদ জার্সিটাও আপনার চোখে পড়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের সবচেয়ে আইকনিক ছবিটাই এমন। একজন হতাশ ইতালিয়ান ফুটবলার।
অথচ, ব্যাজ্জিও সেদিন নায়ক হতেই পারতেন। ব্রাজিল আর ইতালির ফাইনালটা ছিল গোলশূন্য ড্র। পেনাল্টি শ্যুটআউটের শেষ শট। ব্যাজ্জিও গোল করলে টিকে থাকবে ইতালি, নয়ত ব্রাজিলই চ্যাম্পিয়ন। ক্লদিও তাফারেলকে পরাস্ত করতে কিছুটা উঁচুতে শট রাখতে চাইলেন ইতালির নাম্বার টেন। কিন্তু সেই শট চলে যায় গোলবারের অনেকটা ওপর দিয়ে। ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন, মাথা নিচু করে রইলেন ব্যাজ্জিও। অনেকটা সময় ধরেই ওভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। জন্ম নিল ফুটবল দুনিয়ার অন্যতম আইকনিক ছবি ‘দ্য ম্যান হু ডাইড স্ট্যান্ডিং।’
ব্যাজ্জিওর পুরো ক্যারিয়ারের গ্রাফটাই হয়ত এভাবেই সারসংক্ষেপ করা যায়। ইতালির কিংবদন্তি কোচ আরিগো সাচ্চির ভাষায়, ব্যাজ্জিওকে তিনি খোদ ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গেও অদলবদল করতে রাজি নন। সেই ভদ্রলোকের কপালেই কি না লিগ শিরোপা মোটে ২টা। অথচ লিগ রানারআপ হয়েছেন ঢের। উয়েফা কাপ জিতেছেন একবার, কিন্তু রানারআপ হয়েছেন দুবার।
এতকিছুর মাঝেও ১৯৯৩ সালে জুভেন্টাসের জার্সিতে দুর্দান্ত পারফর্ম করে জিতেছিলেন ফিফার বর্ষসেরা। জুটেছিল ব্যালন ডি’ অর ট্রফি। খেলোয়াড়ি জীবনটা ছিল যাযাবরের মতো। জুভেন্টাস, এসি মিলান, ইন্টার মিলান, ভেনেসিয়া, বের্গামো, ফিওরেন্টিনা– খেলেছেন সব ক্লাবের জার্সিতেই।
কিন্তু ব্যাজ্জিও নামটা এলে সময়ের ফ্রেমে চলে আসে কেবল ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপটা। মেক্সিকো, আয়ারল্যান্ড আর নরওয়ের সাথে গ্রুপ ই তে জায়গা হয় তাদের। আরিগো সাচ্চির জোনাল মার্কিং আর ট্র্যাডিশনাল কাতেনাচ্চিওর মিশেলে মাঠে নামেন ব্যাজ্জিওরা। কিন্তু গ্রুপ পর্বে অনেকটা বিশাল গাণিতিক সমীকরণ পেরিয়ে পরের রাউন্ডে যায় ইতালি। আর সেখানেই শুরু হয় ব্যাজ্জিওর আসল জাদু।
ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন, মাথা নিচু করে রইলেন ব্যাজ্জিও। অনেকটা সময় ধরেই ওভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। জন্ম নিল ফুটবল দুনিয়ার অন্যতম আইকনিক ছবি ‘দ্য ম্যান হু ডাইড স্ট্যান্ডিং।’
নাইজেরিয়ার বিপক্ষে রাউন্ড অব সিক্সটিনে ইতালি পিছিয়ে পড়েছিল ২৭ মিনিটে। সেটাই চলল ৮৮ মিনিট পর্যন্ত। ম্যাচটায় যখন ইতালির হার প্রায় নিশ্চিত, তখন ৮৮ মিনিটের মাথায় গোল শোধ করেন ব্যাজ্জিও। এক্সট্রা টাইমে যায় ম্যাচ, ১০২ মিনিটে আবারো পেনাল্টি স্পট থেকে গোল করেন “দ্যা ডিভাইন পনিটেইল।”
পরের ম্যাচ স্পেনের বিপক্ষে। এবার ১-১ সমতা। এই ম্যাচেও ৮৮ মিনিটে ব্যাজ্জিও গোল। ইতালি সেমিফাইনালে। আর সেমিতে জোড়া গোল করে ব্যাজ্জিও দলকে তুললেন ফাইনালে। রোজ বোল স্টেডিয়ামের ফাইনালে ব্রাজিলের সাম্বা আর ইতালির কাতেনাচ্চিওর দ্বৈরথে কেউই পায়নি গোল। স্নায়ুচাপের ফাইনাল গড়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে।
পেনাল্টিতে ব্রাজিলের পক্ষ থেকে মিস করেন মার্সিও সান্তোস। আর ইতালির ফ্রাংকো বারেসি আর মাসারো পেনাল্টিতে নার্ভ হারান। ফলে ব্রাজিল লিড পায় ৩-২ গোলের। ইতালির টিকে থাকতে হলে স্কোর করতেই হবে রবার্তো ব্যাজ্জিওর। এমন অবস্থায় তার পেনাল্টি মিসে নির্ধারণ হয় ভাগ্য। দায় হতে পারতো বারেসি কিংবা মাসারোর। কিন্তু, ব্যাজ্জিওর দায়টাই যেন সবচেয়ে বেশি সেদিনের জন্য।
ব্যাজ্জিও কিছুটা অভাগা পেনাল্টির দৌড়ে। জীবনে তিন বিশ্বকাপের সবকটায় হেরেছেন পেনাল্টির কাছে। অথচ, তার মহিমা এতটাই বড় খোদ পেপ গার্দিওলা ইতালির ক্ষুদ্র ক্লাব ব্রেসিয়ায় খেলতে চেয়েছিলেন ব্যাজ্জিওর সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়। ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ, ফুটবলের সেই দুর্ভাগা রাজপুত্রের পৃথিবীর বুকে আগমনী দিন।
ফুটবলে সর্বজয়ী ফুটবলারের অভাব নেই। বিশ্বকাপ, লিগ শিরোপা কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা তারকা অনেকেই আছেন। তবে ইতালির ব্যাজ্জিওর নামটা বাকি সবার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। কখনো কখনো ক্লাসের সেকেন্ড বয় ছেলেটাও শিরোনামের সব আলো কেড়ে নিতে পারে, দ্য ডিভাইন পনিটেইল হয়ত সেটারই সবচেয়ে বড় উদাহরণ। শুভ জন্মদিন রবার্তো ব্যাজ্জিও।
জেএ /এফআই