কে কাকে ছাপিয়ে গেল, ফিক্সিং সন্দেহ-পারিশ্রমিক বকেয়া নাকি রান-উৎসব

সদ্য সমাপ্ত বিপিএল শুরুর আগে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছিলেন এবারের বিপিএল হবে অন্যরকম। একই সুরে কথা বলেছিলেন বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদও। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে মাঠের বাইরের এসব বাণী ও প্রত্যাশার পারদ ভক্ত-সমর্থকদেরও নজর কেড়েছিল। তবে ২৯ ডিসেম্বর টুর্নামেন্ট উদ্বোধনের দিনেই অব্যবস্থাপনার চিত্রটা শুরু হয় টিকিট ইস্যু নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
এরপর টিকিট ইস্যু ছাপিয়ে টুর্নামেন্টজুড়ে আলোচনার স্থান দখল করে রাখে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বকেয়া ও ফিক্সিংয়ের সন্দেহ। তবে প্রায় প্রতি আসরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে মাঠের ক্রিকেটে রানবন্যা দেখা গেছে এবার। এ ছাড়া দেশি ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের বদৌলতে বিপিএলে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জিতেছে ফরচুন বরিশালের। বিপিএল শেষে এখন সমীকরণ মেলানোর পালা, ফিক্সিং সন্দেহ-পারিশ্রমিক বকেয়া নাকি রান-উৎসব, কে কাকে ছাপিয়ে গেছে! সদ্য সমাপ্ত একাদশ বিপিএলের আলোচিত বিষয়গুলো এক নজরে দেখে নেওয়া যাক–
বিতর্ক নিয়েই বিপিএল আসরের উদ্বোধন
গতকাল ফাইনাল ম্যাচের মধ্যে দিয়ে বিপিএলের একাদশ আসরের পর্দা নেমেছে। এর আগে টুর্নামেন্ট শুরুর ৩০ ডিসেম্বর থেকে শেষদিন পর্যন্ত ছিল টিকিট বিক্রি নিয়ে নানা আলোচনা। বিপিএলের শুরুর দিনেই শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামের মেইনগেটে ভাঙচুর চালায় টিকিট-বঞ্চিত ক্ষুব্ধ সমর্থকরা। টিকিট বুথ থেকে শুরু করে বিপিএলের পোশাকি-সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে লাগানো ব্যানার-ফেস্টুন তারা একপ্রকার তচনচ করে দেয়। একপর্যায়ে প্রবেশ পথের লোহার গেটও ভেঙে ফেলেন দর্শকরা।
বিজ্ঞাপন
কেবল সেখানেই সন্তুষ্ট থাকেননি তারা, বিপিএলের শুরুতে এমন অব্যবস্থাপনার মাশুল আরও বড় অঙ্কে দিতে হয়েছে। টিকিট বুথ স্থাপন করা হয়েছিল মিরপুর সুইমিং কমপ্লেক্সের নিকটবর্তী স্থানে। সেখানেও ভাঙচুর চালায় দর্শকরা, পরে তারা আশপাশের স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই সমস্যা নিরসনে পরে বিসিবি অনলাইনে টিকিট বিক্রির পথে হাঁটে। এরপরও কিছু বিশৃঙ্খলা থেকে যায়। অবশ্য ঢাকায় টিকিট কেলেঙ্কারি থাকলেও, সিলেট-চট্টগ্রামে তেমন কিছু ছিল না।
‘পারিশ্রমিক বকেয়া’য় স্মরণীয় বছর
প্রায় প্রতিটি বিপিএল আসরেই আলোচিত বিষয়ের একটি পারিশ্রমিক বকেয়া রাখা। যা নিয়ে টুর্নামেন্ট শেষেই মূলত বেশি অভিযোগ আসতে দেখা যেত। কিন্তু এবারের বিপিএলের শুরু থেকেই পারিশ্রমিক কাণ্ডে ঘটে যাওয়া বিতর্কে বারেবারে জর্জরিত হয়েছে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। এমন তুলকালামের সিংহভাগ ভূমিকাই ছিল দুর্বার রাজশাহীর। টুর্নামেন্ট শেষ হলেও এখনও প্রতিশ্রুতির পুরো টাকা বুঝে পায়নি দলটির অধিকাংশ ক্রিকেটার।
বিজ্ঞাপন
টুর্নামেন্ট চলাকালে পারিশ্রমিক না পাওয়ায় ক্রিকেটাররা একদিন অনুশীলন বর্জন করেন। আরেকদিন ম্যাচই খেলতে আসেননি রাজশাহীর বিদেশি ক্রিকেটাররা। ফলে তাদের ছাড়াই সেদিন সাজানো হয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজিটির একাদশ। কেবল তাই নয়, রাজশাহীর বিরুদ্ধে হোটেল বিল পরিশোধ এবং টিম বয় কিংবা বাস মালিকের টাকা পরিশোধ করতে না পারার অভিযোগও রয়েছে।

বকেয়া ইস্যু নিয়ে নাম (দুর্নাম) কামিয়েছে চিটাগাং কিংসও। বিপিএলের ফাইনাল খেলা এই দলের বিরুদ্ধে কয়েকজন ক্রিকেটার পারিশ্রমিক না পাওয়ার অভিযোগ করেছিলেন স্বতন্ত্রভাবে। সবমিলিয়ে বিপিএলজুড়ে পারিশ্রমিক বকেয়া রাখা নিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টাও ছিলেন বিরক্ত-বিব্রত। সে কারণে অভিযুক্ত ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে বসেছেন তিনি। এ ছাড়া রাজশাহীর মালিককে তিন কিস্তিতে টাকা পরিশোধের সুযোগ দিয়েছেন, তাতে ব্যর্থ হলে আইনি পথে হাঁটার হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছেন।
ফিক্সিংয়ের জোর গুঞ্জন
এবারের বিপিএলে দেখা গেছে বোলারদের ‘নো’ বল কিংবা ওয়াইড বলের অদ্ভুত সব প্রদর্শনী। যে কারণে সাধারণ দর্শকের সরল মনেও সন্দেহ দানা বেধেছিল। প্রশ্নটা তুলব কি তুলব না ভেবেও কেউ কেউ বলে বসেন– এটা কি ফিক্সিং ছিল? বিপিএলের প্লেঅফ শুরুর আগমুহূর্তে ঢাকাপর্ব চলাকালে একটি গণমাধ্যমের খবরে আসে– সন্দেহজনক পারফরম্যান্সের জন্য ১০ ক্রিকেটার বিসিবির দুর্নীতি বিরোধী ইউনিটের (আকু) তীক্ষ্ণ নজরে আছেন। যেখানে দেশি ক্রিকেটারদের পাশাপাশি রয়েছে বিদেশি ক্রিকেটারের নামও।
যদিও এর মধ্যে দেশি দু’জন ক্রিকেটার তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে সন্দেহ ওঠা ক্রিকেটারদের বিষয়ে এখনও বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে এখনও চলমান রয়েছে তদন্ত কার্যক্রম। একইসঙ্গে বিসিবিও স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয়।
রানবন্যার বিপিএল
বিপিএলে প্রায় প্রতিটি আসরে অন্যতম আক্ষেপে হিসেবে আসত টুর্নামেন্টে ব্যবহৃত ‘পিচ’। দেশীয় ক্রিকেটারদেরও অনেকদিনের চাওয়া ছিল স্পোর্টিং উইকেটে বিপিএল খেলার। সদ্য সমাপ্ত বিপিএল তাদের সেই চাওয়ার ষোলোকলা পূর্ণ করেছে। এই আসরের প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই হাই-স্কোরিং ক্রিকেট ম্যাচ উপভোগ করেছেন দর্শকরা। ঢাকা সিলেট কিংবা চট্টগ্রাম সব ভেন্যুতেই দেখা গেছে রানের ফোয়ারা। সাধারণত মিরপুরের উইকেটে রানের খুব একটা দেখা মেলে না। আসর শুরুর আগে বিসিবি সভাপতি উইকেটে রানবন্যা হওয়ার যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তার অনেকটাই পূর্ণ হয়েছে।

এবারের বিপিএলে ১১টি আসরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (১১ বার) দলীয় দুইশ দেখা গেছে। বিপিএলের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ (২৫৪, ঢাকা ক্যাপিটালস) এসেছে এই আসরে। এবারের বিপিএলে হয়েছে ৮ সেঞ্চুরি। যা এক আসরে সর্বোচ্চ। আগের রেকর্ড ছিলো ২০১৮-১৯ মৌসুমে। এক বিপিএলে সর্বোচ্চ ৩৬ ছক্কা মেরেছেন তানজিদ হাসান তামিম। বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যেও যা এক আসরে সর্বোচ্চ। সবমিলিয়ে এই প্রথমবার ৭০০–এর বেশি (৭১৫) ছক্কা হয়েছে বিপিএলে, হয়েছে সর্বোচ্চ চারও (১১৬৮)।
আলো ছড়ালেন দেশি ক্রিকেটাররা
সবশেষ বিপিএলে দেশি ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিটি দলেই বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা আলো ছড়িয়েছেন। খুলনা টাইগার্সের হয়ে নাঈম শেখ সর্বোচ্চ রান (৫১১) সংগ্রাহক। পুরস্কার জিতেছেন আসরের সেরা ব্যাটারের। ঢাকা ক্যাপিটালসের তানজিদ হাসান তামিম আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান (৪৮৫) সংগ্রাহক। তিনি হয়েছেন ২০২৫ বিপিএলের সেরা উদীয়মান ক্রিকেটার। এ ছাড়া ফিনিশিংয়ে মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন, শামীম হোসেন পাটোয়ারি নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
এছাড়া তামিম ইকবাল, মেহেদী হাসান মিরাজও নিজেদের সেরাটা দিয়ে খেলেছে। বোলিংয়ে তাসকিন আহমেদ সবার সেরা, টুর্নামেন্টের এই সেরা বোলারের শিকার ২৫ উইকেট। এ ছাড়া খালেদ আহমেদ, শরিফুল ইসলামও ছিলেন টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ ছন্দময়। আলিস আল ইসলামও নজর কেড়েছেন রহস্যময় স্পিন ডেলিভারিতে।
বরিশালের রাজত্ব ও একজন তামিম ইকবাল
এ নিয়ে টানা দুইবার বিপিএলের শিরোপা জিতল ফরচুন বরিশাল। টুর্নামেন্টজুড়েই আধিপত্য দেখিয়ে খেলেছেন দলটির ক্রিকেটাররা। টিম কম্বিনেশন কিংবা স্কোয়াড গঠন, সব জায়গাতেই নিজেদের সেরাটা দেখিয়েছে বরিশাল। ড্রাফটের শুরুর দিনে একাধিক তারকা ক্রিকেটারকে দলে যুক্ত করেছিল বরিশাল। বেঞ্চের দলও ছিল বেশ শক্তিশালী। টুর্নামেন্টের শেষ মুহূর্তেও তাদের সাইনিং ছিল অন্য দলগুলোর জন্য ঈর্ষণীয়।
ফরচুন বরিশালের শিরোপা জয়ে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন দলটির অধিনায়ক তামিম ইকবাল। তিনি ছিলেন ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’। শিরোপা নির্ধারণী ফাইনালে চিটাগাং কিংসের লক্ষ্য তাড়ায় তিনি মাত্র ২৪ বলে ফিফটি করেছেন। অধিনায়কত্ব ও মাঠের ক্রিকেট থেকে বাইরে সবখানেই মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। মাশরাফি বিন মুর্তজা ও ইমরুল কায়েসের পর তিনি তৃতীয় কোনো অধিনায়ক হিসেবে বিপিএলে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। এ ছাড়া বরিশাল দলকে নিয়ে নেই কোনো বিতর্কও। ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক–বোনাস নিয়ে কয়েকটি দল যেখানে হিমশিম খাচ্ছিল, সেখানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বরিশাল।
এসএইচ/এএইচএস