কোচ বাটলারের ভুল ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ কি বাফুফের চোখে পড়ে?

ফেডারেশনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ৩০ জানুয়ারি বাফুফে ভবনের নিচে দশের অধিক নারী ফুটবলার কোচ পিটার বাটলারকে বয়কটের ঘোষণা দেন। তাদের এই ঘোষণাকে আবেগী ও যুক্তিহীন বলছেন অনেকে। নারীরা যে ভুল করেছেন, কোচ পিটার বাটলারও আজ প্রায় একই ভুল করেছেন। বাফুফের বিশেষ কমিটি যখন তদন্ত করছে, সেই সময় বাটলারের ‘কয়েকজন নারী ফুটবলার থাকলে তিনি থাকবেন না’– মন্তব্যও অপেশাদার এবং শৃঙ্খলা বর্হিভূত।
কাঠমান্ডু সাফে পাকিস্তানের বিপক্ষে ড্রয়ের পর মিডফিল্ডার মনিকা চাকমা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘কোচ সিনিয়রদের পছন্দ করে না।’ খেলোয়াড় হিসেবে টুর্নামেন্ট চলাকালে তার এই মন্তব্যও ছিল বিধি বর্হিভূত। অথচ শতভাগ পেশাদার দাবি করা পিটার বাটলার শৃঙ্খলা ভেঙেছেন খেলোয়াড়দের চেয়েও বেশি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি বলেছিলেন– ইংল্যান্ডে হলে এই খেলোয়াড়দের বহিষ্কার করতেন। খেলোয়াড়দের ফিটনেস নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন বাটলার। অথচ খেলোয়াড়দের ফিটনেসে সমস্যা থাকলে সেই দায়ও তারই।
যে খেলোয়াড়দের দিকে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সেই খেলোয়াড়রাই চ্যালেঞ্জ নিয়ে সাফে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করেছে। সিনিয়র ফুটবলাররা জোর করে মাঠে নেমে দলকে চ্যাম্পিয়নে বড় অবদান রেখেছেন, অথচ ফুটবল ফেডারেশন শিরোপা জয়ের পেছনে যেন কোচের কৃতিত্বকেই বেশি দেখছে এবং কোচের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনার চেষ্টা করছে। অথচ কোচ যে খেলোয়াড়দের চেয়ে আরও গুরুতর মন্তব্য করেছেন, সেটা যেন ফেডারেশন দেখে-ও না দেখার ভান করছে!
১৮ নারী ফুটবলার বাফুফে সভাপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠির আলোকে বাফুফের বিশেষ কমিটি সেসব ফুটবলার ও কোচের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। বিভিন্ন সূত্রের খবর, সেই কমিটি কোচের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে কয়েকজন নারী ফুটবলারের প্রতি নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ দেবে। এতে শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কয়েকজন ফুটবলারের। কোচের ভুল ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয়টি যেন বাফুফে কর্তাদের চোখে পড়ছেই না।
বাংলাদেশের অনেক নারী ফুটবলারের গুরু গোলাম রব্বানী ছোটন। তিনি অনেকের কাছে পিতৃতুল্যও। ব্যক্তিগত-পেশাগত নানা সংকটে ছোটনের পরামর্শ অনেক ফুটবলার নিয়ে থাকেন। সাফ চলাকালে নারী ফুটবলারদের সঙ্গে ছোটনের যোগাযোগের বিষয়টি বাটলার জেনেছেন তার এক আস্থাভাজন ফুটবলারের অভিভাবকের কাছ থেকে। এমনটাই ধারণা দলসংশ্লিষ্টদের। সেই অভিভাবকের সঙ্গে কোচের যোগাযোগ এবং ছোটনকে নিয়ে মন্তব্য করে পরিবেশ আরও জটিল করায় বাটলারের বড় দায় দেখেন ফুটবলসংশ্লিষ্ট অনেকে।
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের দলনেতা ছিলেন বাফুফে নির্বাহী সদস্য টিপু সুলতান। ওই সময় ফেডারেশনের নির্বাচন থাকায় তিনি ফাইনালের আগে যোগ দেন দলের সঙ্গে। কোচ-খেলোয়াড় দ্বন্দ্ব কাঠমান্ডুতে তুমুল আকার ধারণ করলেও টিম লিডার এই সংক্রান্ত কোনো রিপোর্টই দেননি। এ নিয়ে টিপু সুলতানের যুক্তি– ‘ফেডারেশন থেকে রিপোর্ট চাওয়া হয়নি, তাই রিপোর্ট দেওয়া হয়নি কোনো।’
বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্যরা মূলত ফুটবল ও ফেডারেশনের জন্য অর্থ দেন। নারী ফুটবল দলের সঙ্গে দলনেতা-ম্যানেজার থাকলে অবশ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আর্থিক পুরস্কারও মেলে। বাফুফে দেড় কোটি টাকা বোনাস ঘোষণা করে এখনও পরিশোধ করতে পারেনি। অথচ বাফুফের নির্বাহী সদস্য টিপু সুলতান দলনেতা থাকায় ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থা/প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তার আর্থিক পুরস্কারের পরিমাণ দশ লাখ টাকার কাছাকাছি হয়েছে।
আরও পড়ুন
দেশের নারী ফুটবল গত এক দশকেরও বেশি সময় জুনিয়র-সিনিয়র প্রায় সকল দলেই ম্যানেজার ছিলেন আমিরুল ইসলাম বাবু। বর্তমান সংকট সমাধানে তার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। টিপু সুলতানও অনেক টুর্নামেন্টে দলনেতা ছিলেন। তাকেও দেখা যায়নি। এ নিয়ে তার মন্তব্য, ‘আসলে নারী ফুটবলের বিষয়টি মূলত আপাই (মাহফুজা আক্তার কিরণ) দেখেন।’
মহিলা উইংয়ের প্রধান একজন মহিলা হলেও দলনেতা এবং ম্যানেজার হিসেবে গত কয়েক বছরের মধ্যে কোনো মহিলাকে মনোনয়ন দেননি কিরণ। মহিলা ফুটবল কমিটিতে নাসরিন আক্তার বেবী ও কস্তুরির মতো সংগঠক রয়েছেন। আবার জয়া চাকমার মতো শিক্ষিত কোচ এবং পিঙ্কির মতো সাবেক ফুটবলার থাকলেও কিরণ তাদের কখনও ম্যানেজার করেননি। এই পদটি বাবুর জন্যই যেন নির্ধারিত। ২৬ অক্টোবর বাফুফে নির্বাচন হওয়ায় শুধু কোচিং স্টাফের সদস্য মাহমুদা আক্তার অনন্যাকে ম্যানেজারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
নারী ফুটবলের সংকট ঘনীভূত হওয়ার পেছনে বড় দায় মাহফুজা আক্তার কিরণের। তিনি ফুটবলারদের দাবী হালকাভাবে নিয়ে সমাধানের আগেই দুই বছরের জন্য কোচ চূড়ান্ত করেছেন। বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল আগের মেয়াদে ছিলেন না ফেডারেশনে। তাই তিনি কোচের এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নারী উইংয়ের প্রধানের সুপারিশকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অথচ পিটার বাটলারের কোচিং ইতিহাসে সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজন, নেতিবাচক মন্তব্যের জন্য অন্য দেশে বিপাকে পড়েছিলেন। সাবিনাদের দ্বন্দ্বের মধ্যে বাফুফে এটিও পর্যালোচনা করার প্রয়োজন মনে করেনি।
এজেড/এএইচএস