অলিম্পিয়ানদের পলায়ন-দেশত্যাগেও টনক নড়ে না ক্রীড়া প্রশাসনের!
খেলতে গিয়ে পালিয়ে যাওয়া অথবা খেলা ছেড়ে দেশান্তর হওয়ার চল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে শুরু হয়েছে মূলত নব্বইয়ের দশক থেকে। নব্বইয়ের দশকে কৃতি অ্যাথলেট, সাঁতারু ও অন্য খেলার আরও কয়েকজন উন্নত দেশে খেলতে গিয়ে পালিয়েছেন। এখন খেলতে গিয়ে পালিয়ে যাওয়ার হার কমেছে। তবে এখন শুরু হয়েছে নতুন ধারা। খেলার ভিসা ব্যবহার করে উন্নত দেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা।
গত কয়েক বছরের মধ্যে সাঁতারু আরিফুল ইসলাম, আরচ্যার অসীম ও রুবেলের পর এবার সেই পথের পথিক হচ্ছেন রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী। রোমান ও দিয়া বাংলাদেশের আরচ্যারির সবচেয়ে বড় দুই নাম। তাদের চলে যাওয়া ক্রীড়াঙ্গনে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি করেছে ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরে অন্য ক্রীড়াবিদদের সুযোগ-সুবিধা, সম্মান ও ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার বিষয়টি পাশাপাশি তাদের নিয়ে ক্রীড়াঙ্গন ও সরকারের ভাবনাও।
ক্রীড়া প্রতিভা দেশান্তর প্রতিরোধে নেই কোনো উদ্যোগ
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ ছিলেন বিমল চন্দ্র তরফদার। দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানবও ছিলেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খেলায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আর ফেরেননি। নব্বইয়ের দশকে তার মতো আরও অনেকে এভাবে খেলতে গিয়ে পালিয়েছেন। এর পেছনে কারণ, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার ও অন্য খেলায় অর্থ-কড়ি কম এবং ভবিষ্যত অনিশ্চিত। দুই দশক পরও সেই চিত্র বদলায়নি। এখনও তারকা খেলোয়াড়রা সুযোগ পেলে বিদেশে যাচ্ছেন উন্নত জীবনের আশায়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের যেন তাদের ধরে রাখার সার্মথ্য নেই।
ফেডারেশন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বিকেএসপি, অলিম্পিক ক্রীড়াঙ্গনের প্রায় সব স্তরেই কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বিশিষ্ট সংগঠক ফারুকুল ইসলামের। তার পর্যবেক্ষণ, ‘যারা খেলতে গিয়ে পালিয়েছে তারা রাষ্ট্রের কোনো স্বীকৃতি পাবে না এ রকম একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে। ফলে অনেকেই ক্রীড়া পুরস্কারের যোগ্য হলেও তাদের দেওয়া হয়নি। কিন্তু পালানো রোধে ক্রীড়াবিদদের যে সুরক্ষা প্রদান করা প্রয়োজন সেই উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়।’
সিনিয়র এই ক্রীড়া সংগঠক আরও বলেন, ‘ক্রিকেটাররা প্রতিনিয়ত আফ্রিকা, ইংল্যান্ডে সফর করছে তারা পালায় না কেন বা খেলা ছেড়ে যায় না কেন? কারণ তারা দেশে ক্রিকেটের মাধ্যমে অনেক আয় করছে। তাদের জীবন প্রায় প্রতিষ্ঠিত। অন্য খেলাগুলোতে যতদিন না এটা হবে তত দিন এটা রোধ করা সম্ভব হবে না।’
ভারত্তোলক, সাঁতারু ও অ্যাথলেটরা কি পান
ক্রিকেট, ফুটবলে ব্যর্থতা ও নানা সমালোচনা থাকলেও এই দু’টি খেলা বছরজুড়েই হয়। অন্য অনেক খেলার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপ, লীগ একেবারে অনিয়মিত। ভারত্তোলক মাবিয়া এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের প্রাপ্তি বলতে চ্যাম্পিয়ন হলে কয়েকশ’ টাকা দামের মেডেল, একটা সার্টিফিকেট আর মিডিয়া প্রচার। যদিও সেটা সব সময় না। এর বাইরে তো আর কিছু নেই।’
সাঁতার, অ্যাথলেটিক্সেও প্রায় একই অবস্থা। এই খেলাগুলোতে ক্রীড়াবিদরা সাধারণত সার্ভিসেস সংস্থায় চাকুরি করেন। সেখান থেকে মাসিক ভিত্তিতে বেতন পান অনেকে। আবার অনেকে চুক্তিভিত্তিকও থাকেন। যোগ্যতা-সামর্থ্য ভেদে বেতনের তারতম্যও থাকে। একটি সরকারি চাকুরির আশায় অনেক ক্রীড়াবিদ সাঁতার, অ্যাথলেটিক্সের মতো খেলায় আসেন। পারফরম্যান্স করে অনেকে দ্রুত চাকরি পেলেও আবার অনেকে বছর বছর ঘুরেও স্থায়ী হতে পারেন না।
দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে টানা দুইবার স্বর্ণজয়ী ভারত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত বলেন, ‘ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অন্য খেলার শীর্ষ খেলোয়াড় কারা কম-বেশি সবাই জানে। সরকারের পক্ষ থেকে বা ক্রীড়াঙ্গনের কোনো বড় সংস্থা থেকে অবশ্যই উচিত খেলোয়াড়দের একটি মাসিক ভাতা বা সম্মানী প্রদান করা।’
এনএসসির আয় ২০ কোটির বেশি, বিওএ'র স্থিতি কোটি কোটি আর ক্রীড়াবিদরা দেশ ছাড়ছে
ক্রিকেট বোর্ড ছাড়া অন্য কোনো ফেডারেশনে আর্থিক সামর্থ্য সেই অর্থে নেই। ফলে ক্রীড়াবিদদের প্রতি মাসে ভালো অঙ্ক সম্মানী প্রদান করাও সম্ভব নয়। ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অন্য ফেডারেশনগুলোর আর্থিক সামর্থ্য ও অবকাঠামো সেই অর্থে নেই। ক্রীড়া মেধা পাচার রোধে এগিয়ে আসা প্রয়োজন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনকে। এই তিন শীর্ষ প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে ক্রীড়াবিদদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।
ক্রীড়াবিদরা বিদেশ যাওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ আর্থিক। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয় বছরে ২০ কোটি টাকার বেশি। এত আয় হলেও ক্রীড়াবিদরা সরাসরি কোনো আর্থিক সাহায্য পান না। বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের ফান্ডেও কয়েকটি কোটি টাকা স্থিতি। বিওএ ক্রীড়াবিদ, সংগঠক অসুস্থ বা প্রয়াণে অর্থ সহায়তা করে কিন্তু শীর্ষ খেলোয়াড়দের খেলায় থাকার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে বাংলাদেশের পতাকা বহন করা সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগরের দৃষ্টিতে, 'ফুটবল, ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলার খেলোয়াড়েরা মূলত বিভিন্ন সার্ভিসেস সংস্থার হয়ে খেলে এবং চাকরি করে। ক্রীড়াঙ্গনে নীতি নির্ধারকরা এই সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে ক্রীড়াবিদদের সুরক্ষা ও ভবিষ্যত নিশ্চয়তার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।'
‘কোনো সরকারই অন্য খেলা নিয়ে সিরিয়াস নয়’
১৯৮৯ সালে দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদ উপমহাদেশে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন। ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড কমনওয়েলথ গেমসে আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি শুটিংয়ে স্বর্ণ জেতেছেন। আশির দশকেই এত বড় সাফল্যের পরও ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অন্য খেলাগুলো এখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অদ্যবধি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে জড়িত দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদের দৃষ্টিতে,‘আসলে বাংলাদেশের কোনো সরকারই অন্য খেলাগুলো নিয়ে সেভাবে কোনো সিরিয়াস ছিল না। ফুটবল, ক্রিকেটের সাফল্যের ওপরই ক্রীড়ামন্ত্রী বা সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা মনে করা হয়। ফলে অন্য খেলা সম্ভাবনা থাকলেও মনোযোগ থাকে না। অন্য খেলাগুলো তাই খেলার জন্যই খেলা।’
ফুটবল ও ক্রিকেটে সরকার ও পৃষ্ঠপোষকদের মনোযোগ থাকলেও এই দুই খেলা এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে যেতে পারেনি বলে স্পষ্টই বললেন দেশের কিংবদন্তী ক্রীড়াবিদ,‘বাস্তবিক অর্থে আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আন্তর্জাতিক সাফল্য খুবই কম। শুটিং, দাবা, সাঁতার, আরচ্যারিতে আকস্মিকভাবে আসে সেটা স্থায়ী হয় না। ফুটবলের গণ্ডি দক্ষিণ এশিয়ান পর্যায়েই। এশিয়ান পর্যায়ে যাওয়াটাও কঠিন। আর ক্রিকেটের গণ্ডিই ছোট সেখানেও বড় কোনো সাফল্য নেই।’
অন্য খেলা এগিয়ে নেয়া ও ক্রীড়াবিদদের সুরক্ষায় সরকারকেই এগিয়ে আসার আহ্বান নিয়াজের। তাঁর মতে, ‘দাবা, শুটিং, আরচ্যারির মতো খেলায় দর্শক তেমন থাকবে না ফলে পৃষ্ঠপোষক কম থাকবে। এশিয়ায় এই খেলাগুলোতে যারা এগিয়েছে তারা সরকারের মাধ্যমেই। বাংলাদেশেও সেটা প্রয়োজন।’ বাংলাদেশের দাবায় সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব খেলাগুলোর মধ্যে তুলনার মানদন্ড বুঝতে পারেন না, ‘ক্রিকেটে একটা ম্যাচ বা সিরিজ জিতলে যে পরিমাণ আলোচনা ও পুরস্কার দেখা যায় কিন্তু অন্য খেলায় ৩০-৪০ দেশের মধ্যে পদক না জিতলেও ৭-৮ হলেও সেই আলোচনা দেখা যায় না। আসলে কোন খেলায় কোনটা প্রকৃত অর্জন সেটা সঠিকভাবে নির্ণয় করা প্রয়োজন।’
সাফ গেমসে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তেমন কিছু নয়। এরপরও সাফ গেমসে স্বর্ণজয়ীদের অনেকে রাষ্ট্রীয় অনেক সন্মান পুরস্কার পেয়ে থাকেন। কমনওয়েলথ গেমস বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ গেমস হলেও সেখানে পদকজয়ীদের তেমন স্বীকৃতি নাই জাতীয় পর্যায়ে।
অ্যাথলেট কমিশনের দিয়াই নেই!
বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের অধীনে একটি অ্যাথলেট কমিশন রয়েছে। সেই কমিশন মূলত ক্রীড়াবিদদের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কাজ করে। সেই কমিশনের সদস্য দিয়া সিদ্দিকী। ক্রীড়াবিদদের জীবনে অনিশ্চিয়তা অ্যাথলেট কমিশনের সদস্য দিয়া নিজেই এখন দেশান্তরির পথে। অ্যাথলেট কমিশনের আরেক সদস্য মাহফুজা খাতুন শিলা বলছেন, ‘আমরা খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো অলিম্পিকে প্রস্তাব করি। সাম্প্রতিক সময়ে খেলোয়াড়রা খেলা ছেড়ে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা সামনে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করব গুরুত্ব সহকারে।’
অন্য খেলায় পারিশ্রমিক বাড়েনি, বেড়েছে ব্যয়
নব্বইয়ের দশকে ফুটবলের পরই জনপ্রিয়তায় দ্বিতীয় স্থানে ছিল হকি। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ হকি দল ইতালি সফরে গিয়েছিল। সেই দলের অন্যতম সদস্য রফিকুল ইসলাম কামাল বলেন, ‘সেই সময় আমার পারিশ্রমিক ছিল সাড়ে তিন লাখ টাকা। আমি কেডস কিনেছিলাম দুই হাজার টাকা দিয়ে। এখন যারা শীর্ষ পর্যায়ের হকি খেলোয়াড় তাদের পারিশ্রমিক সেই তিন লাখেই কিন্তু কেডসের দাম বেড়ে দশ হাজারের বেশি।’
ফুটবল, ক্রিকেটে পারিশ্রমিক বাড়লেও অন্য খেলায় সেই হারে না বাড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন সাবেক এই তারকা, 'একটা খেলা যদি নিয়মিত না হয় তাহলে সেই খেলার মান বাড়বে না ফলে খেলোয়াড় দরও বাড়বে না। বিভিন্ন খেলায় এটাই হচ্ছে। '
অন্যরাও আছেন যাওয়ার অপেক্ষায়
খেলতে গিয়ে পালিয়ে যাওয়া অথবা খেলা ছেড়ে বিদেশ যাওয়া নেতিবাচক হিসেবে ধরা হয়। বাস্তবিক অর্থে খেলোয়াড়েরা না পারতেই দেশ ও স্বজনদের ছেড়ে যান। দেশের ক্রীড়া সংস্কৃতি না বদলানোয় বিদেশে স্থানান্তরিত হওয়াকেই শ্রেয় মনে করছেন সাবেক দ্রুততম মানব আব্দুল্লাহ হেল কাফি, 'অ্যাথলেটরা দেশের জন্য খেলেন। দেশ তাদের কতটুকু দেয় সেটাও প্রশ্ন। যারা বিদেশে আছেন প্রায় সবাই ভালোই আছেন। আর যারা দেশে আছেন তাদের অনেকে কোনোমতে জীবনযাপন করছেন।'
'অ্যাথলেটরা দেশের জন্য খেলেন। দেশ তাদের কতটুকু দেয় সেটাও প্রশ্ন। যারা বিদেশে আছেন প্রায় সবাই ভালোই আছেন। আর যারা দেশে আছেন তাদের অনেকে কোনোমতে জীবনযাপন করছেন'-সাবেক দ্রুততম মানব আব্দুল্লাহ হেল কাফি
২০০২ সালে কমনওয়েলথ গেমসে শুটিংয়ে স্বর্ণ জিতেছিলেন আসিফ হোসেন খান। তিনি বলেন,' এটা আসলে সত্যি ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে অন্য খেলায় সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ কম। এজন্য অনেকে সুযোগ পেয়ে বিদেশে যাচ্ছেন উন্নত জীবনের আশায় আবার অনেকে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। ' বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম কিংবদন্তি কামরুন নাহার ডানা বর্তমান সময়ে ক্রীড়াবিদদের বিদেশ যাওয়াকে স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন, 'এখানে ক্রীড়াবিদদের নিরাপত্তা নেই, ফলে তারা সুযোগ পেলে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করবেই।'
এজেড/এফআই