সিলেটের হারিয়ে যাওয়া আবুল হাসান মিস করেন টেস্ট ক্রিকেটকে
আবুল হাসান রাজুর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথ চলা শুরু হয়েছিল টি-টোয়েন্টি দিয়ে ২০১২ সালে। একই বছর টেস্ট অভিষেক হয়ে এই পেসারের। আর লাল বলের ক্রিকেটে পা রেখেই পুরো দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেন। মূলত তিনি একজন পেসার হলেও ব্যাট হাতে অভিষেকেই গড়েন বিশ্বরেকর্ড।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে ১০ নম্বর ব্যাটার হিসেবে উইকেটে গিয়ে সেঞ্চুরি হাঁকান আবুল। টেস্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ১০ নম্বরে নেমে অভিষেকেই তিন অঙ্কের দেখা পান তিনি। ১১৩ রানের সেই ইতিহাসগড়া ইনিংস খেলে আলোচনায় চলে আসেন তিনি।
ঝড়ের মতো উত্থান হওয়া আবুলের পতনও হয়েছে একই বেগে। ব্যাট হাতে আলোচনায় আসলেও আবুলের আসল কাজটা ছিল বল হাতে। যেখানে তিন সংস্করণেই ব্যর্থ ছিলেন তিনি। যা তার পরিসংখ্যানই বলে দেয়। বাংলাদেশের জার্সিতে ৩ টেস্টে তার শিকার ৩ উইকেট। ৫ টি-টোয়েন্টি খেলে নিয়েছেন ৪ উইকেট। আর ওয়ানডেতে তার পারফরম্যান্স গ্রাফের চিত্রটা আরো করুণ! লাল-সবুজ জার্সিতে ৭ ওয়ানডে খেলে কোনো উইকেটের দেখা পাননি এই পেসার।
আরও পড়ুন
বাজে পারফরম্যান্স আর চোট মিলিয়ে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন আবুল। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জুনে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। এরপর আর ঘরোয়া ক্রিকেটেও দেখা যায়নি তাকে। স্বীকৃত ক্রিকেটে সর্বশেষ ২০২২ সালে খেলেছেন বাংলাদেশ লিজেন্ডসের হয়ে। যা সাবেক ক্রিকেটারদের একটি টুর্নামেন্ট।
২০২২ সালের পর দেশের মাটিতে আর কোনো ধরনের ক্রিকেটেই দেখা যায়নি আবুলকে। বাংলাদেশের ক্রিকেট পাড়া থেকে হারিয়ে যাওয়া এই পেসারকে খুঁজেছে ঢাকা পোস্ট। মাস দুয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে আসা এই ক্রিকেটারের সঙ্গে সিলেটে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে ক্রীড়া প্রতিবেদক সাকিব শাওনের।
ঢাকা পোস্ট : আপনার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাই।
আবুল হাসান : এখন সবসময় যক্তরাষ্ট্রে থাকা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটের সঙ্গেই আছি। এখানকার ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলছি। আমি সর্বশেষ টুর্নামেন্ট খেললাম মিশিগান থেকে। গত বছরের শেষ দিকে আমি ভিসার কারণে যেতে পারিনি। তো সবকিছু আবারও ঠিক হয়ে গেছে আমার। আমি জানুয়ারির শেষ দিকে আবার আমেরিকাতে চলে যাব। টার্গেট আসলে মেজর লিগ খেলা।
ঢাকা পোস্ট : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনাকে খুব একটা দেখা যায় না, কেন?
আবুল হাসান : সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকি না। আসলে কিছু কিছু মানুষ থাকে না যে, আসলে এসব পছন্দ করে না, আমি তেমনটাই। আমার নিজেকে এত শো অফ করা বা অন্যান্য একটিভিটিস ফেসবুকে দেওয়া এগুলো আসলে আমি পছন্দ করি না। অনলাইনে থাকি না যে সেটা না, থাকি কিছু সময় অথবা আমার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। অনেকে জিম বা রানিংয়ের কিছু ভিডিও ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এগুলোতে দেয়। আমি আসলে দেই না, আমি যা করছি আসলে নিজের ভেতরেই রাখার চেষ্টা করি সবসময়।
ঢাকা পোস্ট : ৬ বছরের বেশি সময় ধরে জাতীয় দলের বাইরে, ফেরার সম্ভাবনা আছে?
আবুল হাসান : আমি যদি টার্গেট করি যে, আবারো জাতীয় দলের জন্য আমি চেষ্টা করবো তাহলে ইনশাআল্লাহ আমি আত্মবিশ্বাসী (ফিরতে পারবো)। যদি এক থেকে দেড় বছর চেষ্টা করি এবং ঢাকায় থাকি তাহলে আমি ইনশাআল্লাহ ফিরতে পারবো, এটা আমি বিশ্বাস করি।
মূলত ইনজুরি আমাকে ছিটকে ফেলেছে। আমার কিছু ইনজুরির সমস্যা ছিল যে কারণে আমি আসলে আমেরিকাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বাংলাদেশ ক্রিকেট যে, আমার জন্য কিছু করেনি তা না, অনেক প্লান ছিল তাদের।
শেষ যখন ২০১৮ তে আমি খেলেছিলাম তখনও আমার এঙ্কেল এর ইনজুরি ছিল। তো আমি কিন্তু আশাবাদী ছিলাম যে আমি ফিরব। আমি ভেবেছিলাম, টিমের ভেতরে আছি খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েছি তো আমাকে সাপোর্ট করবে বোর্ড। কিন্তু তখন আমার জন্য বোর্ড কিছুই করেনি। পরে আমি নিজের টাকা খরচ করে অস্ট্রেলিয়া যেয়ে সার্জারি করেছি। পরে যখন বাংলাদেশে এসেছি তখন আমি আর ঐরকম রেসপন্সটা পাইনি। তাই আমি আমেরিকায় চলে গেছি।
ঢাকা পোস্ট : ক্রিকেট নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আবুল হাসান : যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় দলে খেলার কোনো ইচ্ছা নেই। মেজর লিগে খেলার ইচ্ছাটা আছে মানুষ দেখুক যে, আমি ফুরিয়ে যাইনি। এখনো ক্রিকেট ছাড়িনি। আমি ওই লক্ষ্যটা নিয়েই আছি। আমারো জিদটা আছে, আমি কাজ করে দেখাতে চাই। আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখে তাহলে আপনারা এ বছর আমাকে দেখতে পারেন মেজর লিগে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রে না আমি পৃথিবীর সব জায়গায় খেলতে চাই। আমার এমন হতে পারে যে পরবর্তী বছর থেকে বিপিএল খেলছি। যুক্তরাষ্ট্রতো অনেক বড়, সব লিগগুলোই আমি খেলতে চাই। বিশ্বের সব জায়গায় আমি খেলতে পারি সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি আগের থেকে অনেক সুস্থ সেভাবে প্লান করছি, সেভাবে আগাচ্ছি।
ঢাকা পোস্ট : বিপিএলে খেলার পরিকল্পনা আছে?
আবুল হাসান : আসলে আমার ফিটনেসের ওপরে এটা ডিপেন্ড করছে। তিন মাস হয়েছে বাংলাদেশে এসেছি। ইচ্ছা করলে ড্রাফটে নাম দিতে পারতাম, ঘরোয়া এনসিএলও খেলতে পারতাম। কিন্তু সেটা আমি করিনি। আমি চিন্তা করি যে আমি ভালোভাবে ফিরতে চাই, শতভাগ যাতে দিতে পারি।
ঢাকা পোস্ট : দেশের ক্রিকেটের কোথাও আপনি নেই, এ নিয়ে কখনো খারাপ লাগা কাজ করে?
আবুল হাসান : দেখেন মাশরাফি ভাই একটা কথা আমাকে সবসময় বলতো, 'রাজু তোর প্লেসটা কিন্তু এখনো ফাঁকা আছে।' বোলিং অলরাউন্ডার যে জায়গাটা আছে...যখন আমি একজন খেলোয়াড় হিসেবে খেলাটা দেখি তখন কিন্তু খারাপ লাগ। আমার ব্লাডে ক্রিকেট...তো অবশ্যই খারাপ তো লাগবেই আমার। বন্ধু, কলিগ, সিনিয়র সবাই খেলছে আমি খেলতে পারছি না। বিশেষ করে যখন টেস্ট ক্রিকেট দেখি ওইটা মিস করি। সুস্থ থাকলে আমিও খেলতে পারতাম, খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক।
ঢাকা পোস্ট : বিসিবির কেউ আপনার সাথে কখনো যোগাযোগ করেছে?
আবুল হাসান : কারো সাথে আসলে তেমন কোনো কমিউনিকেশন ছিল না আমার। কিন্তু লিপু ভাইয়ের সাথে আমার অনেক কথা হতো, যখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। লিপু ভাইয়ের সাথে অনেক বিষয়ে আমার কথা হতো, যোগাযোগটা আছে। এছাড়া বিজয়, সোহান, সৌম্যরা আমার খুবই কাছের বন্ধু। তাদের সবার সাথে আমার যোগাযোগ আছে এখনো।
ঢাকা পোস্ট : আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার লম্বা না হওয়ার কারণ কী?
আবুল হাসান : লম্বা না হওয়ার কারণ এক কথায় ইনজুরি। আগেও যেটা বললাম, শুরুটা খুবই ভালো ছিল। যদি দেখেন আমি শ্রীলঙ্কাতে যখন গেলাম তখন ভালো পারফর্ম করেছিলাম। পরে কোমরে একটা ইনজুরি হল, এরপর একটার পর একটা লেগেই আছে। আমার পিক টাইম ছিল, ইনজুরির কারণে লম্বা করতে পারলাম না আসলে।
ঢাকা পোস্ট : টেস্ট অভিষেকের সেই রেকর্ড আপনার ক্যারিয়ারে কতটা প্রভাব ফেলেছে?
আবুল হাসান : (তৃপ্তির হাসি) সত্যি কথা বলতে ওটা নিয়ে কোনো ফিলিংসই নাই আমার। আমার চিন্তা সবসময় ছিল যে, কীভাবে আসলে জাতীয় দলে প্রবেশ করা যায়। মানুষের জীবনে এরকম হয়, আমি আসলে কনফিডেন্স ছিলাম যে আমি ব্যাটিংটা পারি, বোলিং তো আছেই। শেন জার্গেনসেন আমার সাথে ব্যাটিং নিয়ে অনেক কাজ করেছে। সে আমাকে পছন্দ করত, অনেক বেশি সাহায্য করত। সে বোলিংয়ের পরে ব্যাটিংয়ে আমার সাথে কাজ করতো। এছাড়া ইমন ভাই বা রাসেল ভাই তাদের কথা বলতে হয়। সবমিলিয়ে আল্লাহ আমাকে ওই রেকর্ডটা করার সুযোগ দিয়েছিল।
ঢাকা পোস্ট : এখন যে জায়গায় আছে, সেটাতে আপনি কি সন্তুষ্ট?
আবুল হাসান : এখনো পর্যন্ত আমার যে লক্ষ্য যেটা আছে সেখানে আমি পৌঁছাতে পারিনি। তো আমি আশা করি যে, ২০২৫ সালে আমি ওখানে পৌঁছাব ইনশাআল্লাহ।
ঢাকা পোস্ট : দেশ নাকি বিদেশে সেটেল হবেন খেলা ছাড়ার পরে?
আবুল হাসান : ক্রিকেটার হিসেবে যদি আমি ক্রিকেট টা ছেড়ে দিই আমি এরপর আর ক্রিকেটের সাথে যুক্ত থাকবো না। এই ক্রিকেটার হিসেবে আর থাকবো না। সেটা দেশেও হতে পারে বিদেশও হতে পারে। কেউ আসলে বলতে পারে না আল্লাহ আপনাকে কোথায় কখন নিয়ে যাবে।
এসএইচ/এইচজেএস