সিনেমার মতো হিটলারের ‘হলোকাস্ট’ এড়ানো সেই কিংবদন্তির মৃত্যু
সিনেমার মতো নাটকীয় জীবন, কোনো কোনো গল্প আবার সিনেমাকেও হার মানায়। তেমনই একটি গল্প লিখেছেন হাঙ্গেরির কিংবদন্তি জিমন্যাস্ট আগনেস কেলেটি। যিনি অ্যাডলফ হিটলারের হাতে সৃষ্ট ইতিহাসের ভয়ঙ্কর ‘হলোকাস্ট’ বা গণহত্যা এড়িয়েছেন নিজের পরিচয় লুকিয়ে। এরপর জিতেছেন ১০টি অলিম্পিক পদকও। অলিম্পিক গেমসে সবচেয়ে প্রবীণ স্বর্ণজয়ী সেই কিংবদন্তি ১০৩ বছর বয়সে মারা গেছেন।
গতকাল (বৃহস্পতিবার) হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কেলেটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছে হাঙ্গেরিয়ান অলিম্পিক কমিটি (এইচওসি)। বড়দিনে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২০১৫ সাল থেকে তিনি বুদাপেস্টে বসবাস করে আসছেন। কেলেটির মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি, ‘আগনেস কেলেটি হাঙ্গেরি থেকে আসা সবচেয়ে বড় কিংবদন্তি জিমন্যাস্ট। কিন্তু তার জীবন ও ক্যারিয়ারে জড়িয়ে আছে নিজ দেশের রাজনীতি ও ধর্মের ভয়াবহ মিশ্রণ।’
১৯২১ সালের ৯ জানুয়ারি এক ইহুদি পরিবারে জন্ম কেলেটির। ছোটবেলা থেকে সঙ্গীত ও জিমন্যাস্টিক্সকে বেছে নেন তিনি। পরবর্তীতে জিমন্যাস্টেই হয়ে উঠেন পেশাদার সেলো প্লেয়ার এবং ১৬ বছর বয়সেই জাতীয় জিমন্যাস্টিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম পদক জিতেন। বিশ্বের জনপ্রিয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অলিম্পিক গেমসের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এই অ্যাথলেট সবমিলিয়ে জিতেছেন ১০টি পদক। এরমধ্যে ৫টিই স্বর্ণ। হাঙ্গেরির অলিম্পিক ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সফল অ্যাথলেটও কেলেটি। এমনকি সবচেয়ে সফল ইহুদি অলিম্পিয়ানদের মধ্যেও তিনি অন্যতম।
— The Olympic Games (@Olympics) January 2, 2025
অথচ বাবাসহ আরও কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কেলেটিরও মৃত্যু হতে পারত হিটলারের নাৎসী বাহিনীর হাতে। সেই ডেথক্যাম্প থেকে বেঁচে ফেরার ঘটনা তিনি ২০২০ সালের এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। কেলেটি বলেন, ‘আমি এক ক্রিস্টান বালিকার পরিচয়পত্র নিজের জন্য ব্যবস্থা করি। যে প্রায় আমারই সমবয়সী। পরে দেশ থেকে পালাতে সফল হয়েছি সেই মিথ্যা তথ্য ও নথি দেখিয়ে। এরপর আমি দূরবর্তী একটি গ্রামে থাকতাম, পাশাপাশি কাজ করতাম গৃহ পরিচারিকা হিসেবে।’
হাঙ্গেরির অলিম্পিক কমিটি জানিয়েছে, ১৯৪০ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলেও ওই বছরই কেলেটিকে ইহুদি বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে সকল ক্রীড়া কর্মকাণ্ড থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে টোকিও অলিম্পিকে অংশ নেওয়া হয়নি তার। হাঙ্গেরিও পরিচালিত হতে থাকে নাৎসী বাহিনীর অধীনে। কোনোভাবে নৃশংস মৃত্যু উপত্যকা এড়াতে পারলেও কেলেটি আশ্রয় নেন নিজ শহর বুদাপেস্টেরই একটি গ্রামে। তার মা রোসজা, বোন ভেরা পালাতে সক্ষম হলেও; বাবা ফেরেনক ক্লেইন এবং আরও কয়েকজনের মৃত্যু হয় হিটলার বাহিনীর হাতে।
১৯৪০–৪৪ এর পর ১৯৪৮ অলিম্পিকে কেলেটির সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় তার অ্যাঙ্কলের চোট। ফলে প্রথমবার অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয় ১৯৫২ হেলসিংকি আসরে। তখন তার বয়স ৩১ বছর, যে বয়সে অনেকে জিমন্যাস্ট অবসরে চলে যায়। সেই আসরে জেতেন একটি স্বর্ণপদক। শেষ পর্যন্ত ৫ সোনাসহ মোট জেতেন ১০টি মেডেল।
কেলেটির জীবনে দ্বিতীয়বার রাজনৈতিক বাধা আসে ১৯৫৬ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়নের চোখ পড়ে হাঙ্গেরিতে। ফলে ওই সময় কেলেটিসহ ৪৪ হাঙ্গেরিয়ান অ্যাথলেট আর দেশে ফেরেননি। অস্ট্রেলিয়ান দলকে কোচিং করিয়ে ১৯৫৭ সালে তিনি চলে যান ইসরায়েলে। সেটিকেই ঠিকানা বানিয়ে কাজ করেন দেশটির জিমন্যাস্ট দলের সঙ্গে। পরে ২০১৭ সালে তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘ইসরায়েল প্রাইজ’ দেওয়া হয়।
এএইচএস