এনএসসি : সুরম্য টাওয়ার, ২৩ কোটি আয়, কাটেনি ক্রীড়াঙ্গনের দুঃখ
বাংলাদেশের সকল ফেডারেশন/এসোসিয়েশনের অভিভাবক জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। সকল ক্রীড়া স্থাপনাও সরকারি এই সংস্থার অধীনে। ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম নিয়ন্ত্রক সংস্থা এনএসসি’র বিভিন্ন দিক দিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন করছেন ঢাকা পোস্টের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার আরাফাত জোবায়ের।
আজ (মঙ্গলবার) চতুর্থ ও শেষ পর্বে থাকছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয়, অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং ক্রীড়াঙ্গনের হতাশার বিষয়গুলো।
এনএসসি’র ২০ তলা ভবন যেন ক্রীড়াঙ্গনের ‘হাহাকার’
রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত সড়ক দৈনিক বাংলা মোড়। পথচারীদের সহজেই চোখে পড়বে ‘এনএসসি টাওয়ার’। ২০০৬ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সুউচ্চ ২০ তলা ভবনটি উদ্বোধন হয়। এই ভবনের দিকে পাখির চোখ ছিল ক্রীড়াসংশ্লিষ্টদের। এই ভবনে ফেডারেশনের অফিস এবং ইনডোর খেলাগুলোর ভেন্যুর স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্রীড়াবিদ-সংগঠকরা। বাস্তবে কিছুই হয়নি। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনে কোনো ক্রীড়া ফেডারেশনের জায়গা হয়নি। এনএসসির নিজস্ব বহুতল ভবন থাকা সত্ত্বেও অনেক ফেডারেশনের অফিসের স্থানই নেই, আবার অনেক ফেডারেশন খেলা আয়োজনও করতে পারে না জায়গার অভাবে।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরোনো ভবন সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। পাকিস্তান আমলে সেটি ছিল ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন। স্বাধীনতার পর ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ পরিষদ থেকে সর্বশেষ নামকরণ হয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। ২০০৫ সাল পর্যন্ত পুরোনো ভবনেই কেটেছে এনএসসি’র কার্যক্রম। ২০০৬ সালে নতুন ভবনে ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস শুরু করলেও ক্রীড়াঙ্গনের দুঃখ তেমন লাঘব হয়নি। ২০ তলা ভবনের মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অডিটরিয়াম হিসেবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা, ষষ্ঠ তলা কনফারেন্স কক্ষ, আইটি রুম ও নামাজের ব্যবস্থা; অস্টম ও নবম তলা মূলত প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ ফ্লোর বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়া, আবার কিছু ফ্লোর ফাঁকাও রয়েছে।
২০ কোটি টাকার বেশি নিজস্ব আয়, ক্রীড়ায় ব্যয় এক কোটিরও কম
সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয়ের বিধান রয়েছে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুদানের বাইরে সংস্থাটি নিজস্ব আয়ও করে থাকে। স্টেডিয়ামের দোকান ও এনএসসির ভবন ভাড়া থেকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ১৫ কোটি টাকার বেশি আয় হয়েছে তাদের। এছাড়া বাথরুম, কার পার্ক ইজারা, হলরুম, হোস্টেল ভাড়া ও আরও অন্যান্য খাত থেকে আয় আসে ১০ কোটির মতো। সব মিলিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নিজস্ব আয় দেখিয়েছে ২৯ কোটি ৬৯ লাখ ২৭ হাজার টাকা। তবে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের সম্ভাব্য বাজেটে নিজস্ব আয় প্রায় ২৪ কোটি দেখানো হয়েছে। আগের অর্থ বছরেও সম্ভাব্য আয় কম দেখানো ছিল।
দোকানপাটের জন্য স্টেডিয়ামে খেলাধুলার পরিবেশ থাকে না। সুরম্য অট্টালিকা ক্রীড়া ফেডারেশন ব্যবহারের সুযোগ না পেয়ে উল্টো ভাড়ায় রয়েছে। এ নিয়ে ক্রীড়াবিদ-সংগঠকদের আক্ষেপের শেষ নেই। যার প্রেক্ষিতে ক্রীড়া পরিষদের কর্তারা বলতেন– এই আয় তো ক্রীড়াঙ্গনের জন্যই ব্যয় হয়। আদতে ক্রীড়ায় সরাসরি ব্যয় হয় একেবারে সামান্য। ক্রীড়া সামগ্রী ক্রয়ে সরকারি মঞ্জুরি ৬৬ লাখ টাকার পাশাপাশি ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয় থেকে ৫০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয় থেকে ক্রীড়া সংস্থার মঞ্জুরিতে (অনুদান) ২৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ২০২৪-২৫ সালে অর্থ বছরে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রীড়ায় সরাসরি ব্যয়ের আরেকটি খাত– পুরস্কার প্রদান। যার পরিমাণ মাত্র ১২ লাখ। সব মিলিয়ে এক কোটিও ব্যয় হয় না এনএসসির।
২০০৯-২৪ এই ১৬ বছরের মধ্যে মাত্র তিনবার এজিএম আয়োজন করেছে এনএসসি। অথচ ২০১৮ সালের এনএসসি অ্যাক্ট অনুসারে প্রতি দুই বছর অন্তর এনএসসির এজিএম আয়োজন করার কথা। এজিএমে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পাশাপাশি বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পর্যালোচনা এবং পরামর্শও উঠে আসে অনেক। একই সময়ে সাধারণ সভাও হয়েছে তুলনামূলক কম (৪৭)।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয়ের প্রায় সিংহভাগ ব্যয়ই হয় কর্মচারী পালনে। পণ্য ও সেবা ব্যবহার খাতে ২৬ কোটি টাকার মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয় থেকে নির্বাহ করা হয় ১৫ কোটি ৩১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় কর্মচারীদের বেতন বাবদ সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৫ কোটি টাকার মতো। ক্রীড়া পরিষদের কর্মচারীরা এটা ক্রীড়াঙ্গনের ব্যয় হিসেবেই ধরতে চান। তাদের যুক্তি— ফেডারেশনগুলো অনেক সময় বিদ্যুৎ বিল দেয় না, ফলে এনএসসিকে দিতে হয়। ওই ১৫ কোটি টাকার মধ্যে কর্মচারীদের পোষাক, অফিসের গাড়ির জ্বালানি, আসবাবপত্র, কম্পিউটারসহ নানা বিষয় রয়েছে।
নিজস্ব আয় থেকে অবসরভোগীদের উৎসব, চিকিৎসা ও কল্যাণ অনুদানের তহবিলে বছরে ব্যয় আরও ৭ কোটি ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয়ের ২৩ কোটির মধ্যে ২১ কোটি টাকার বেশি প্রশাসনিক খাতে ব্যয় হয়। ক্রীড়াঙ্গনে ব্যয় মাত্র সর্বসাকুল্যে কোটি টাকা।
ওয়ার্কচার্জড স্টাফ শতাধিক
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সরকারি প্রতিষ্ঠান। এই অফিসের স্টাফদের ব্যয় সরকারি কোষাগার থেকেই হওয়ার কথা। কিন্তু শতাধিকের বেশি স্টাফ ওয়ার্কচার্জড থাকায় এদের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ করতে পারে না। ফলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয় থেকেই এদের টানতে হয়।
১৯৮৩ সালের ২১ ডিসেম্বর বিগ্রেডিয়ার এনামুল হক খান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের একটি অর্গানোগ্রাম করেন। সেখানে ৩৭৭ জন লোকবলের একটি রূপরেখা চূড়ান্ত হয়। এরপর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ চাকরি বিধি তৈরি করা হয় ১৯৯৫ সালে। এনাম কমিশনের রিপোর্ট ও সেই বিধি অনুসারে পরবর্তীতে আরও ৪৭ জনের পদ অনুমোদিত হওয়ায় মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২৪ জনে। যদিও বিগত সময়গুলোতে এনএসসির লোকবল সংখ্যার রিপোর্ট বিভিন্ন সংস্থায় পাঁচ শতাধিকের বেশি প্রেরণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
এই ৪২৪ জনের মধ্যে রাজস্ব খাতে রয়েছেন ১৮১ জন। এই ১৮১ জনের অর্থ সরকার সরাসরি বরাদ্দ করে। বাকি ২৪৩ শূন্য পদের বিপরীতে ওয়ার্কচার্জড হিসেবে কাজ করছেন ১৬৮ জন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয়ের ২০ কোটি টাকার সিংহভাগ অর্থই ব্যয় হয় তাদের পেছনে।
দীর্ঘদিন পর ৩০ জন নিয়মিত, ১৭ জনের বিদায়
ওয়ার্কচার্জড হিসেবে যারা কর্মরত রয়েছেন, তারা নিয়মিতকরণ/স্থায়ীত্বের জন্য দীর্ঘদিন থেকেই মামলা লড়ছেন। ৯৬ জনের ব্যাপারে সম্প্রতি আপিল বিভাগ থেকে আদেশ পেয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। সেই আদেশের পর এনএসসি সংশ্লিষ্ট কমিটি ১৩টি সভা করে নানা বিষয় পর্যালোচনা করেছে। এর প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে নিয়মিতকরণ/স্থায়ীর আওতায় এসেছেন ৩০ জন। ফলে এরা এখন রাজস্ব খাতের অর্ন্তভুক্ত হবেন। আরও ৪৩ জনের ব্যাপারে এনএসসি’র সংশ্লিষ্ট কমিটি সুপারিশ করে চেয়ারম্যানের নিকট পাঠিয়েছে। চেয়ারম্যান অনুমোদন দিলে তারাও রাজস্বের অর্ন্তভুক্ত হবেন।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের দীর্ঘদিনের এই জট অতি সম্প্রতি নিরসন হয়েছে। যেমন অনেকেই দীর্ঘ লড়াইয়ের পর স্থায়ী চাকরি পেয়েছেন। তারা তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও ১৭ জন আবার দুই দশকের বেশি চাকরি করার পরও স্থায়ী হতে পারেননি। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাদের রয়েছে দীর্ঘশ্বাস।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই স্বজনপ্রীতি, দলীয় চাপ/প্রভাব ছিল। এর ফলে অর্গানোগ্রাম ও বিধি অনেক সময় সঠিকভাবে অনুসৃত হয়নি। পরিষদের নিজস্ব আয় থাকায় অর্গানোগ্রামের বাইরে অনেক স্টাফকে টানতে বাধ্য হয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। অথচ ক্রীড়ার মূল ক্ষেত্রে তেমন নজরই দিতে পারেনি।
ইউনিয়নের ‘আধিপত্য’
অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো এনএসসিতেও রয়েছে কর্মচারী ইউনিয়ন। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের এই সংগঠন এনএসসির বেশ প্রভাবকও। অনেক সময় এরা শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাপে রাখেন। আবার কখনও কর্মকর্তাদের পক্ষ হয়েও সোচ্চার হয়ে উঠেন নিজেরা। ইউনিয়নের অধিকাংশই সাধারণ গোছের কর্মচারী হলেও, নেতৃস্থানীয় দুয়েকজন এই সংগঠনকে ব্যবহার করে আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন। বিশেষ করে একজন সাব কন্টাক্টে কাজ করেন। যা এনএসসি ও ক্রীড়াঙ্গনে ওপেন সিক্রেট।
ক্রীড়াঙ্গন বুঝে ওঠার পরই সচিব–পরিচালককে বদলি
এনএসসির চেয়ারম্যান ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী/উপদেষ্টা। তবে ক্রীড়া পরিষদের দাপ্তরিক ও নিয়মিত কার্যাদি সম্পাদন হয় মূলত সচিবের তত্ত্বাবধানে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে সচিব পদায়ন হয়। এনএসসি’র ১৯৯৫ সালের কর্মকর্তা-কর্মচারী বিধি অনুযায়ী শুধুমাত্র সচিব পদই সরকার থেকে পদায়ন হওয়ার কথা। বাকি চার পরিচালক এনএসসি’র নিয়োগকৃত বা চাকরিরতদের মধ্যেই পূরণ হওয়ার যোগ্য। বিগত দুই দশকের বেশি সময় সচিবের মতো পরিচালকরাও আসছেন জনপ্রশাসনের মাধ্যমে।
সচিব ও পরিচালকরা সাধারণত তিন বছর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে থাকেন। কারও সময়সীমা বেশি হলে সেটা সর্বোচ্চ চার বছর। আবার কেউ বছর পেরোনোর আগেই চলে যান। আবার নতুন কেউ আসেন। ক্রীড়াঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ ও বিষয়াদির সঙ্গে পরিচিত হতেই সচিব, পরিচালকদের সময় লাগে। যখন একটু ধাতস্থ ও অভ্যস্থ হয়ে ওঠেন, তখনই দেখা যায় বদলির অর্ডার। নতুন যে আসে তার সঙ্গে আবার ক্রীড়াঙ্গনের ব্যক্তিদের নতুন করে সম্পর্ক এবং তারও বিষয়গুলো বুঝতে হয়। ক্রীড়াসংশ্লিষ্টদের মতে– জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে অন্তত পরিচালক ক্রীড়া পদটি থাকলে ক্রীড়াঙ্গনের কর্মকাণ্ড অনেকটাই সহজ হতো।
ক্রীড়া সামগ্রী ক্রয়ে সরকারি মঞ্জুরি ৬৬ লাখ টাকার পাশাপাশি ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয় থেকে ৫০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব আয় থেকে ক্রীড়া সংস্থার মঞ্জুরিতে (অনুদান) ২৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ২০২৪-২৫ সালে অর্থ বছরে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রীড়ায় সরাসরি ব্যয়ের আরেকটি খাত– পুরস্কার প্রদান। যার পরিমাণ মাত্র ১২ লাখ। সব মিলিয়ে ২৫ কোটির বেশি আয় হলেও, এক কোটি টাকাও ব্যয় হয় না এনএসসির।
নেই আর্কাইভ, ‘অবহেলিত’ সন্তান ক্রীড়াজগত
এনএসসি ক্রীড়াঙ্গনের প্রকৃত অভিভাবক সংস্থা। দেশের সকল খেলার ও ফেডারেশনের তথ্য-উপাত্তের ভান্ডার হওয়ার কথা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। ক্রীড়াঙ্গনের নানা ইতিহাস সংরক্ষিত হওয়ার অন্যতম ক্ষেত্র ছিল এটি। অথচ এখানে নেই কোনো তথ্য ভান্ডার। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের একমাত্র নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশনা রয়েছে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান এনএসসি সত্তর দশক থেকে ক্রীড়া পাক্ষিক ‘ক্রীড়াজগত’ প্রকাশ করে। ক্রীড়া ইতিহাস ও গবেষণা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের অনেকেই ছুটে আসেন ক্রীড়াজগত অফিসে। পুরোনো অনেক দিনের ছবি ও তথ্যের একমাত্র ভরসা যেন ক্রীড়াজগতই।
৪০ বছর পার করা ক্রীড়াজগত দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অমূল্য সম্পদ। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নিজস্ব বিষয় হওয়ার পরও এই পত্রিকার দিকে তেমন নজর থাকে না কর্তৃপক্ষের। লোকবল সংকট ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে ধুঁকছে পত্রিকাটি। অথচ ক্রীড়াজগতের মাধ্যমে এনএসসি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম এবং ক্রীড়া ইতিহাস আরও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যম হতে পারে।
ডিকশনারি নির্ভর লাইব্রেরি, নেই চিকিৎসকও
ক্রীড়া মাঠের বিষয় হলেও উন্নতি ও টেকসইয়ের জন্য পড়াশোনাও প্রয়োজন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রতিষ্ঠার কিছু পর থেকেই ছিল লাইব্রেরি কক্ষ। সেই কক্ষে এখন ক্রীড়াজগত অফিস। লাইব্রেরির বর্তমান অবস্থান হয়েছে ক্রীড়াজগতের পাশের কক্ষেই। সেখানে এখন ক্রীড়াঙ্গনের কেউ ঢু দেয় না। লাইব্রেরিতে ক্রীড়াঙ্গন সম্পর্কিত বইপত্র নেই বললেই চলে। বেশিরভাগই শুধু ডিকশনারি। লাইব্রেরির যেমন ভঙ্গুর অবস্থা, তেমনি চিকিৎসা ব্যবস্থাও। গত পাঁচ বছর যাবৎ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে নেই কোনো চিকিৎসক।
আলোর নিচে অন্ধকার
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ গত দুই-তিন দশকে হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মাণ-সংস্কার উন্নয়ন কাজ করেছে। অথচ সংস্থাটির পুরোনো ভবনের জিমনেশিয়ামের অবস্থা জীর্ণ-শীর্ণ। ফেডারেশনগুলোর এমনিতেই ভেন্যু সংকট। ক্রীড়া পরিষদের জিমনেশিয়াম ভারত্তোলন, কুস্তি, কারাতে, তায়কোয়ান্দো ও জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশন ব্যবহার করত। আলোক স্বল্পতা, বৃষ্টির পানি ঢুকে যাওয়া ও আরও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিভিন্ন ফেডারেশন এ নিয়ে চিঠি দিলেও কোনো প্রতিকার হয়নি। অথচ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকেই হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার নির্মাণ ও সংস্কার কাজ।
আরও পড়ুন
১৫ বছরে মাত্র ৩টি এজিএম
ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম অভিভাবক সংস্থা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশনগুলোর জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্রের চর্চার নির্দেশ দিলেও, নিজেরাই সেটা অনুসরণ করতে পারে না। ২০০৯-২৪ এই ১৬ বছরের মধ্যে মাত্র তিনবার তারা এজিএম আয়োজন করেছে। ২০১৮ সালের এনএসসি অ্যাক্ট অনুসারে প্রতি দুই বছর অন্তর এনএসসির এজিএম আয়োজন করার কথা। এজিএমে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পাশাপাশি বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পর্যালোচনা এবং পরামর্শও উঠে আসে অনেক। ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক সংস্থারই এজিএম অনিয়মিত ফলে ফেডারেশনগুলোর কী চিত্র তা সহজেই অনুমেয়!
এনএসসি অ্যাক্টে নির্বাহী কমিটির সভা তিন মাস অন্তর হওয়ার কথা। ২০০৯-২৪ এই ১৬ বছরে নির্বাহী কমিটির ৬৪টি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সেখানে নির্বাহী কমিটির সংখ্যাও তুলনামূলক কম (৪৭)। তিন মাস অন্তর হিসাবে বছরে চারটি সভা হওয়ার কথা। সেখানে ২০১৭-২২ সাল পর্যন্ত সভা হয়েছে মাত্র ৯টি।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন তারকা ফুটবলার ও বিশিষ্ট সংগঠক বাদল রায়। প্রয়াত এই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন আড্ডায় বলতেন, ‘যেকোনো সংগঠনে ট্রেজারের স্বাক্ষর করার অধিকার থাকে। এনএসসি একমাত্র ব্যতিক্রম।’ ক্রীড়াঙ্গনে অনেকদিন থেকেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী কমিটির আকার ও পদ্ধতির পর্যালোচনার দাবি উঠেছে।
এজেড/এএইচএস