৫৩ বছরেও হয়নি ক্রীড়া-অর্থনীতির বিকাশ, নেই নতুন ভাবনা
প্যারিস অলিম্পিক ২০২৪। সেখান থেকেই উড়ে এলেন বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূস। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে যিনি হাজির হয়েছিলেন তার ক্রীড়া অর্থনীতির মডেল নিয়ে। কিন্তু দেশের বাইরে ক্রীড়া ও অর্থনীতির মেলবন্ধনে এক বাংলাদেশির উপস্থিতি থাকলেও খোদ বাংলাদেশেই এমন কিছু দেখা যায়নি কখনোই।
যদিও ক্রীড়া এবং অর্থনীতির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে সবসময়ই। Sports Economics বা ক্রীড়া অর্থনীতি, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যেন নিতান্তই অপরিচিত এক শব্দ। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের একটা দারুণ অতীত থাকার পরেও খেলার এই জগতের সঙ্গে অর্থনীতির সখ্যতা ঘটেনি কখনোই। যে কারণে কিছুটা অপরিচিতই থেকে গিয়েছে এমন এক ধারণা।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে অর্থনীতির সখ্যতা আটকে আছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, কিছু শো-রুম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কিছু অনলাইন বিপনন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের আর্থিক হালচাল নিয়ে ঢাকা পোস্টের জুবায়ের আহাম্মেদের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় ও শেষ পর্ব। যেখানে আলোকপাত করা হবে দেশের ক্রীড়া অর্থনীতির বর্তমান চিত্র এবং পেছনের গল্প নিয়ে।
ক্রীড়া অর্থনীতির অবস্থান কোথায়?
ক্রীড়া অর্থনীতির কেতাবি সংজ্ঞায়ন থেকেই আলোচনার শুরু করা যেতে পারে। খেলাধুলার সঙ্গে অর্থনীতির সংযোগ, প্রয়োগ এবং উন্মুক্ত বাজারে ক্রীড়ার প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনাই ক্রীড়া অর্থনীতির মূল আলোচ্য বিষয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খেলার সঙ্গে অর্থনীতির সংযোগ কেবল বাজেট প্রস্তাবনা এবং অর্থব্যয়ের মাঝেই আটকে আছে।
আরও পড়ুন
আর উন্মুক্ত বাজারে ক্রীড়াজগত আটকে আছে সাধারণ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাঝে। সারাদেশের স্টেডিয়াম কেন্দ্রিক জার্সি ও ক্রীড়াসামগ্রী বিপনন প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের ক্রীড়া অর্থনীতির খুব একটা বিকাশ ঘটেনি স্বাধীনতা পরবর্তী ৫৩ বছরে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ধারণা একান্তই ক্রিকেট ও জার্সিকেন্দ্রিক। সেটাও খুব একটা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়।
বিভিন্ন গ্রেডের জার্সি ও ক্রীড়া সামগ্রী নিয়ে কাজ করেই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে এসব প্রতিষ্ঠান। একাধিক প্রতিষ্ঠানে আলাপ করে দেখা যায়, স্টেডিয়াম পাড়ার এসব ব্যবসায়ী নিজেদেরকে ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক ব্যবসায়ীর বাইরে কিছু ভাবতে রাজি নন। দেশীয় বাস্তবতায় তারাও নিজেদের পুঁজি এবং ব্যবসা নিয়েই ভাবতে বেশি আগ্রহী।
অতীত বাস্তবতায় পিছিয়ে ক্রীড়া অর্থনীতি
কথা হয়েছিল বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক আবু হাসান চৌধুরী প্রিন্সের সঙ্গে। বাংলাদেশের অন্যতম দর্শকপ্রিয় এই ক্লাবের দায়িত্বে থাকা প্রিন্স জানালেন, অতীতে বিনিয়োগ ও ব্যবসার ভালো পরিস্থিতি থাকলেও ক্লাবগুলোর বাস্তবতা ছিল বেশ কঠিন। অতীতের প্রশ্ন আসতেই বলেছেন এভাবে–
‘একটা ফ্যানক্লাব হলে মোহামেডানের জন্য সবদিক থেকেই উপকার হতো। অর্থনৈতিক দিক থেকেই সব পক্ষের মাঝে উন্নতি হতে পারতো। কিন্তু মোহামেডান শুরু থেকেই ছিল অনুদাননির্ভর ক্লাব। একটা সময় সংগঠকরা নিজেদের বাড়ির গহনা বিক্রি করেও ক্লাব চালিয়েছেন। সেসময় সমর্থকদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া সম্ভব ছিল। তবে ক্লাবগুলোর অবস্থান শক্ত ছিল না।’
আরেক ঐতিহ্যবাহী ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়নের ম্যানেজার আমের খান অবশ্য অতীতের ঘাড়ে দোষ চাপাতে নারাজ, ‘সামাজিক অবস্থা এবং পরিবেশ একটা বড় ইস্যু। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ কিংবা কর্মক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা এক্ষেত্রে নজরে রাখতে হবে। অতীতের কেন এমন কেন কিছু হয়নি এই উত্তর খোঁজ করলে ভবিষ্যতে এগুনো সম্ভব না।’
কথা হচ্ছিল হকির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকা রফিকুল ইসলাম কামালের সঙ্গে। খেলোয়াড় এবং ফেডারেশন দুইভাবেই যুক্ত ছিলেন হকিতে। নিজের আঙ্গিনা নিয়ে তার ভাষ্য, ‘আমাদের হকি খেলায় আগে ছিল প্রথম বিভাগ এবং প্রিমিয়ার লিগ– বাংলাদেশে এই লিগই ছিল অনিয়মিত। যে কারণে আমাদের হকিতে দারুণ সম্ভাবনা থাকলেও সেটা পরবর্তীতে কোনো ক্ষেত্রেই খুব একটা উন্নতি করতে পারেনি।’
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে নজর ক্লাবগুলোর
অর্থনীতির এক জনপ্রিয় ধারণা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি। যেখানে সরকারি নির্দেশনা ও ভর্তুকির ভিত্তিতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশীদার হয়। বাংলাদেশের ক্রীড়া অর্থনীতির উন্নয়নে এই ধারণার দিকেই ইঙ্গিত দিলেন মোহামেডান এবং ব্রাদার্স ইউনিয়নের ক্লাব কর্তারা।
ভবিষ্যতে নিজেদের ক্লাবের আর্থিক অবস্থান এবং সমর্থকদের জন্য কিছু করার ভাবনা জানালেন মোহামেডানের পরিচালক প্রিন্স, ‘মোহামেডানের যদি ১ কোটি গ্রাহকও ফ্যান ক্লাব থেকে জার্সি কেনে, শুধু জার্সিই তো না– সঙ্গে অন্যান্য কিছুও থাকবে ক্লাবের পক্ষ থেকে, সেটা মোহামেডান ক্লাবের জন্যেই ভালো হবে। তবে এজন্য দরকার স্পন্সর। দলবদলের পর দেশের ক্লাবের সাধারণ খরচ ওঠাতেই বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। এজন্য দরকার বেসরকারি বিনিয়োগ।’
ব্রাদার্স ইউনিয়নের ম্যানেজার আমের খানের বক্তব্যটাও এমন। তিনি বিশ্বাস করেন, তরুণ প্রজন্মের সংগঠকরা এই ব্যাপারে কাজ করলে অবশ্যই সুফল পেতে শুরু করবে ক্রীড়া অর্থনীতি, ‘আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যতে অবশ্যই চিত্র বদলাবে। ক্যারিশম্যাটিক কিছু তরুণ এসব নিয়ে ভাববে, এগিয়ে আসবে। তবে আমাদের দেশে তরুণরা এগুতে চায় পুরাতনকে ছেঁটে ফেলে। সেটা নয়। পুরাতনের অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের শক্তি মিলে বর্তমান চিত্র বদলানো সম্ভব।’
সেই বদল কীভাবে আসবে? এমন প্রশ্নে তিন সংগঠকের প্রস্তাবনা একই। ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন, মোহামেডানের আবু হাসান চৌধুরী প্রিন্স এবং ব্রাদার্স ইউনিয়নের আমের খানের বক্তব্য মিলে গেল একই সুরে। সরকারি হস্তক্ষেপে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসার প্রস্তাব তাদের। বহুজাতিক কোম্পানি কিংবা ব্যাংকগুলো এগিয়ে এলে এই চিত্র বদলানো সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন সমস্যা সমাধানে চাইছেন স্থায়ী স্পন্সরশিপ, ‘আমাদের বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় গিয়ে গিয়ে আমাদের সারা বছরের খরচ উঠিয়ে আনতে হচ্ছে। বেসরকারিভাবে কাউকে আনা সম্ভব না। সরকারি একটা গাইডেন্স দরকার হবে এজন্য। এরপরেই ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিকে যুক্ত করা যাবে এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।’
ক্রিকেটে পরিবেশ আছে, নেই পরিকল্পনা
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ বিদ্যমান কেবল ক্রিকেটেই। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে অর্থনীতির দূরতম যোগাযোগ নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে অংশ নিয়ে থাকে মোহামেডান, আবাহনী কিংবা গাজী ট্যাংক ক্রিকেটার্সের মতো ক্লাবগুলো। যাদের পরিকল্পনা এবং আর্থিক বাস্তবতায় নিজস্ব ক্লাবশপ পরিচালনা করা বেশ কঠিন।
তবে বিপিএল কেন্দ্রিক কিছুটা বাণিজ্যের সুযোগ থাকলেও সেটা নিতে আগ্রহ দেখা যায়নি কারোরই। দীর্ঘদিন ধরে বিপিএলে থাকলেও ফরচুন বরিশাল এবং রংপুর রাইডার্স নিজেদের বড় সমর্থকগোষ্ঠীর সুবিধা আদায় করতে পারেনি। রাজনৈতিক পালাবদলের পর হারিয়ে যাওয়া কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স অবশ্য নিজেদের সেরা সময়েও ব্যর্থ হয়েছে সমর্থকদের সঙ্গে নিজেদের যোগাযোগ বাড়াতে।
যদিও বিপিএলের বাস্তবতাও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর বাণিজ্যের পক্ষে নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বছরে বছরে দলের মালিকানা পরিবর্তন বিপিএলের সঙ্গী হয়ে গিয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে যেমন থাকছে সংকটে, তেমনি টুর্নামেন্টের ২ মাসের জন্য বাড়তি বিনিয়োগের ঝুঁকিও এড়াতে আগ্রহী অনেকের। সেই সঙ্গে দেরিতে জার্সি আসা, সমর্থকদের সঙ্গে দূরত্বের কারণেও উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েও বাণিজ্যের সুযোগ হারাচ্ছে ক্রিকেট।
বিনিয়োগের পরিবেশ কতটা বাস্তবসম্মত?
‘এই মুহূর্তে ক্রীড়ার একটা বাজার গড়ে তোলা বেশ কষ্টকর, দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থাও যদি বিবেচনা করা হয় তবে এটা বিনিয়োগের ভালো পরিবেশ নয়। তবে চিত্র বদলাতে পারে যদি সীমিত এই সুবিধার মাঝ থেকেই একটা ভালো ফলাফল আসে।’ – বাংলাদেশের ক্রীড়া অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরছিলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং কলামিস্ট ড. আমিনুল ইসলাম আকন্দ।
অর্থনীতির এই অধ্যাপকের ভাষ্য, ‘একটা নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হলে এর গ্রাহকের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের এই মুহূর্তে অন্যান্য খেলার প্রতি তরুণদের আগ্রহ কম। এই মুহূর্তে কিছু সাফল্য দরকার। যেটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি এনে দেবে আমাদের। তাহলে একটা বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। তবে সেটা রাতারাতি ক্রীড়া অর্থনীতির সুফল আমাদের দেবে না– এটাও স্মরণ রাখতে হবে।’
বাংলাদেশের হয়ে এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদক পাওয়া মাবিয়া আক্তার সীমান্ত অবশ্য এমন কথার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। তার ভাষ্য যেকোনো কাজের মতোই ক্রীড়াক্ষেত্রেও বিনিয়োগটাই আগে দরকার। সেটাই পরবর্তীতে সাফল্য এনে দিতে পারে, ‘কোনো কাজেই সরাসরি সাফল্য পাওয়া সম্ভব না। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতেও একটা সময় পর্যন্ত নিজের শ্রমকে বিনিয়োগ করতে হয়। কেউ চাইলেই রাতারাতি সাফল্য নিয়ে আসতে পারবে না। তাই আগে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের দরকার। সেটাই সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে।’
হকি ফেডারেশনে যুক্ত থাকার সুবাদে অনেকটা দিনই কাছ থেকে বাংলাদেশের খেলার মান ও অবস্থা দেখেছেন রফিকুল ইসলাম। বিনিয়োগের জন্য তিনি বিশ্বাস করেন ফেডারেশনগুলোর একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার, ‘একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার। ফেডারেশনগুলোকে ৪ বছরের পরিকল্পনা সাজাতে হবে। সেটা নিয়ে তারা যাবে স্পন্সরের কাছে। ফেডারেশনের একটা কমিটি চলে গেলেও কাজ যেন থেমে না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে স্পন্সর বা বিনিয়োগ পাওয়া কষ্টকর।’
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্র অবশ্য বেশ সীমিত। খেলার জনপ্রিয়তা ছাড়া ক্রীড়া সামগ্রী নির্মাণের দিকেও আগ্রহ কম অনেকেরই। খেলার জনপ্রিয়তা বাড়াতে করতে অবশ্য ফিরে যেতে হবে বেতন কাঠামো ঠিক করার দিকে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে যে অংশে আছে বড় রকমের আর্থিক অসমতা। কিন্তু বিশাল জালের মতো ছড়িয়ে থাকা এই সমস্যার সমাধান ঠিক কোথা থেকে শুরু করবেন ক্রীড়াঙ্গনের শীর্ষকর্তারা– সেই প্রশ্নের উত্তরটাও এখন পর্যন্ত অজানা।
জেএ