পরিবর্তনের কথা ‘মুখে মুখে’, অব্যবস্থাপনাতেই শুরু হচ্ছে বিপিএল
৫ই আগস্ট, ২০২৪। একটা ভিন্ন রকমের বাংলাদেশের স্বপ্ন সেদিন দেখেছিল সাধারণ মানুষ। ১৫ বছর পর শাসকগোষ্ঠীর পতন দেখার সুযোগ হয়েছে। এরপর এসেছে সংস্কারের কথা। যে সংস্কারের ঢেউ লেগেছিল দেশের ক্রীড়াঙ্গনেও। আর তাতে সবার আগে পরিবর্তন হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে। দীর্ঘ এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা নাজমুল হাসান পাপন সরে সান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির পদ থেকে।
এরপরে বাংলাদেশ হারিয়েছে নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজনের গৌরব। বিসিবির নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদের সামনে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। যার আগে বেশ বড় রকমের বুলিই আওড়েছেন ক্রিকেট কর্তারা। প্রতিশ্রুতি ছিল একেবারেই ভিন্ন এক আয়োজনের। বিসিবিতে নতুন যুক্ত হওয়া পরিচালক নাজমুল আবেদিন ফাহিম আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও আশ্বাস দিয়েছিলেন ভিন্ন কিছুর।
কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরুর আগের রাতে এসেও বিপিএল নিয়ে আলাপচারিতায় হতাশার কথাই বলতে হচ্ছে বেশি। মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে মিউজিক ফেস্ট আয়োজনের বাইরে এখন পর্যন্ত বিপিএল শুরুর বাকি সব চিত্রই দর্শক থেকে শুরু করে সবাইকে করেছে হতাশ।
এখনো দেখা মেলেনি জার্সির
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ব্র্যান্ডিং আর দর্শকদের সঙ্গে দূরত্বের আদর্শ চিত্র হয়ত এটাই। বিশ্বের বাদবাকি ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগের জার্সি আর ফ্যানক্লাব নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি থাকলেও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ শুরু থেকেই পিছিয়ে এমন ব্র্যান্ডিং নিয়ে। অবস্থা এমনই শোচনীয়, ১১তম বিপিএল শুরুর একদিন আগেও ভক্তরা দেখতে পাননি নিজ নিজ দলের জার্সি।
আরও পড়ুন
অফিসিয়াল জার্সির স্বাদ থেকে বরাবরই বঞ্চিত বিপিএল। চলতি বছরেও সেই পুরাতন রীতি থেকে বেরিয়ে আসা হয়নি ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোর। এখন পর্যন্ত বিপিএলে জার্সি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গিয়েছে কেবল রংপুর রাইডার্সের। সেটাও গ্লোবাল সুপার লিগের সুবাদে। এছাড়া ফরচুন বরিশাল, দুর্বার রাজশাহী, খুলনা টাইগার্স এবং চিটাগাং কিংসের জার্সি নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়নি মোটেই।
ঢাকা ক্যাপিটালসের জার্সি সম্পর্কে খানিক ধারণা পাওয়া সম্ভব তাদের মিউজিক ভিডিওর ট্রেইলার থেকে। এর বাইরে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নেই। একমাত্র সিলেট স্ট্রাইকার্স তাদের ম্যাচজার্সি সামনে এনেছে। তাদের অবশ্য ম্যাচ জার্সি পাওয়ার উপায়টাও বলা হয়েছে নিজেদের ফেসবুক পেইজ থেকে। জার্সি নিয়ে বেশ পেশাদার আচরণই দেখিয়েছে বিপিএলের এই ফ্র্যাঞ্চাইজি।
অধিনায়ক ঘোষণা নিয়েও গড়িমসি
কোন দল কার নেতৃত্বে খেলতে নামবেন এটাও যেন জানার সুযোগ নেই দর্শকদের। সোমবার দুপুরে খেলা শুরু হলেও রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে অধিনায়ক ঘোষণার জন্য। আগে থেকে জানা গিয়েছিল কেবল বরিশালের তামিম ইকবাল এবং রংপুর রাইডার্সের নুরুল হাসান সোহানের নাম। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর রোববার দুপুরে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার থিসারা পেরেরাকে অধিনায়ক করার কথা জানায় ঢাকা ক্যাপিটালস।
এরপর একে একে রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং সিলেট জানায় অধিনায়কের নাম। যদিও সেই অধিনায়কদের নামও এক অর্থে হতাশ করেছে ক্রিকেট ভক্তদের। দুর্বার রাজশাহী তাদের অধিনায়ক করেছে আনামুল হক বিজয়কে। চট্টগ্রামের অধিনায়ক করা হয়েছে মোহাম্মদ মিঠুনকে। আর সিলেটের অধিনায়ক অলরাউন্ডার আরিফুল ইসলাম। খুলনা টাইগার্সের অধিনায়ক হিসেবে মেহেদি হাসান মিরাজের অবস্থান অনেকটাই নিশ্চিত। তবে সে ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণাই আসেনি।
দীর্ঘ ১০ বছর পার হলেও নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু এখন পর্যন্ত ঠিক করতে পারেনি বিপিএল। বছরে বছরে নিয়মের পরিবর্তন এসেছে এখানে। নেই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। পিচ এবং কন্ডিশন নিয়েও আছে বড় রকমের বিতর্ক। তারচেয়ে বড় কথা, বিদেশী খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক ইস্যুতে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশের দলগুলো। সবমিলিয়ে বিপিএলের চেয়ে ভিনদেশের অন্যান্য লিগের প্রতিই বেশি আগ্রহী ক্রিকেটাররা।
আর অধিনায়ক ঘোষণা নিয়েই এমন অবস্থার মাঝে হয়নি ক্যাপ্টেন্স ডে। অথচ কদিন আগেই ঘরোয়া ক্রিকেটের আরেক আসর এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে দেখা গিয়েছিল ক্যাপ্টেন্স ডে এর ব্যবস্থা। সেসময় বেশ প্রশংসাই কুড়িয়েছিল বিসিবি। আর তাতে প্রত্যাশাও বেড়ে গিয়েছিল অনেকটা। কিন্তু দিনশেষ সেই হতাশাই উপহার দিলো বিপিএল।
টিকিট নিয়ে চলছে চরম অব্যবস্থাপনা
বিপিএলের প্রস্তুতিকালেই বলা হয়েছিল অনলাইনে টিকিট বিক্রির কথা। কথা হয়েছিল দর্শকদের জন্য টিকিট সহজ করা নিয়েও। কিন্তু আসর শুরুর একদিন আগে টিকিট নিয়ে চিরায়ত হতাশাই হয়েছে সঙ্গী। ভোর থেকে আগ্রহী দর্শকরা ভিড় করেছেন মিরপুরের শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে লাইন বৃদ্ধি ছাড়া কোনো কাজই হয়নি।
দুপুর ১২টার পর ঘোষণা আসে টিকিট নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছে অনলাইন এবং অফলাইন দুই মাধ্যমেই সংগ্রহ করা যাবে টিকিট। বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মধুমতি ব্যাংক এর পক্ষ থেকে। সেখানেও আছে জটিলতা। সন্ধ্যার পরেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের একাধিক মধুমতি ব্যাংক শাখার সামনে দেখা গিয়েছে টিকিটের লম্বা লাইন।
বিদেশি খেলোয়াড়রা আসছেন ‘খণ্ডকালীন চুক্তি’ নিয়ে
এবারও প্রায় বেশিরভাগ বিদেশি ক্রিকেটারদেরই বিপিএলের দলগুলো ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। একইসময়ে মাঠে গড়াচ্ছে চার ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট লিগ। বাংলাদেশে বিপিএল, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আইএল টি-টোয়েন্টি, দক্ষিণ আফ্রিকায় এসএ টোয়েন্টি মাঠে গড়াবে প্রায় একই সময়ে। আর চলমান আছে অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ টুর্নামেন্ট।
দীর্ঘ ১০ বছর পার হলেও নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু এখন পর্যন্ত ঠিক করতে পারেনি বিপিএল। বছরে বছরে নিয়মের পরিবর্তন এসেছে এখানে। নেই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। পিচ এবং কন্ডিশন নিয়েও আছে বড় রকমের বিতর্ক। তারচেয়ে বড় কথা, বিদেশী খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক ইস্যুতে প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশের দলগুলো। সবমিলিয়ে বিপিএলের চেয়ে ভিনদেশের অন্যান্য লিগের প্রতিই বেশি আগ্রহী ক্রিকেটাররা।
যে কারণে এবারেও একাধিক তারকা শুরুর কয়েক ম্যাচ খেলেই উড়াল দেবেন আইএল টি-টোয়েন্টি কিংবা এসএ টোয়েন্টির দিকে। এছাড়া পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড তাদের ক্রিকেটারদের পুরো সময় এনওসি দেয়নি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ভাবনা থেকে। সবমিলিয়ে আরও একবার বিদেশি ক্রিকেটারদের নিয়ে অসন্তোষ রেখেই মাঠে গড়াচ্ছে ঘরোয়া ক্রিকেটের বড় আসর বিপিএল।
জেএ